বিজ্ঞাপন
default-image

ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ১০ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার করার সামরিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়েও তাঁরা আলোচনা করেন। আন্দ্রে গ্রোমিকো ইন্দিরাকে জানান, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবের এ ধরনের সরাসরি বিচারের বিপক্ষে। আলোচনায় এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে ঐকমত্য হয়।

ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম সাংসদদের নিয়ে গঠিত প্রতিরক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটিকে বলেন, দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়েও তারা প্রশিক্ষিত। নৌবাহিনীকেও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় আসেন। কলকাতার বিমানবন্দরে নেমেই তিনি রওনা দেন বয়রা সীমান্তের দিকে। স্বচক্ষে সব দেখে এসে দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এই শরণার্থীদের কথা দেশে ফিরে নতুন করে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে তিনি তুলে ধরবেন।

ভারতের দিল্লিতে অন্ধ্র প্রদেশ উর্দু পত্রিকা সমিতির সভাপতি আলী সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রদেশটির ২০টি উর্দু পত্রিকার সম্পাদকেরা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করেন এবং ইয়াহিয়ার একটি কুশপুত্তলিকা পোড়ান। হাইকমিশনে স্মারকলিপি দিতে গেলে সেটি কেউ গ্রহণ না করায় তাঁরা তা ভবনে ছুড়ে দেন। পরে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে গিয়ে ইয়াহিয়া-নিক্সনের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও ধিক্কার জানান।

বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে উ থান্ট

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র ১০ আগস্ট নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের মনোভাব ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের জানান, শেখ মুজিবের কিছু ঘটলে তার প্রতিক্রিয়া পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর বিচার করবে, সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর উ থান্ট মন্তব্যটি করেন।

বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে শান্তির পথ নির্বিঘ্ন করতে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের মুক্তির জন্য সারা বিশ্বের কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কোনো চেষ্টা করা হলে বিশ্বের এই অঞ্চল অগ্ন্যুৎপাতের মুখোমুখি হবে। তিনি সভ্যতা, গণতন্ত্র, মানবতা ও ন্যায়বিচারের নামে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নিঃশর্ত মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানান।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

১২ আগস্ট থেকে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির পূর্ব পাকিস্তান সফরের কর্মসূচিটি পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়। কেনেডির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাতের কর্মসূচিও বাতিল করা হয়।

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার অদূরে মিরকাদিমের কাছে আবদুল্লাহপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহযোগী, শান্তি কমিটির নেতা ও পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম দলের সিনিয়র সভাপতি মাওলানা মাহমুদ মোস্তফা আল মাদানীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। গেরিলাদের গুলিতে তিনি নিহত হন। মাদানী তখন বাংলাদেশবিরোধী সমাবেশে বক্তৃতাকালে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের নির্মূল করার জন্য তাঁর দলের কর্মীসহ উপস্থিত অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন।

মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের একটি বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারি আক্রমণ চালায়। সে আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হন। যুদ্ধে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও পাঁচজন আহত হন।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও তিন; দৈনিক পাকিস্তান, ১১ ও ১২ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১১ ও ১২ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান