১৯৭১ থেকে ২০১১। চল্লিশ বছর। এই চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশের পতাকা আকাশে উড়ছে সগৌরবে। তাতে আঁকা এ দেশের প্রকৃতির চিরসবুজ, অসংখ্য শহীদের শোণিতের লাল। বাংলাদেশের বুক চিরে সূর্য উঠছে, সে-সূর্য কখনো অস্ত যাবে না। এই চল্লিশ বছরে আমাদের অর্জন আছে, ব্যর্থতা আছে, অর্জন ধরে রাখার অপারগতা আছে, আত্মঘাত আছে।
স্বাধীনতালাভের এক বছরের মাথায় বহুনন্দিত সংবিধান রচনা করেছিলাম আমরা। তার দু বছর পর থেকেই সে-সংবিধানের মূল কাঠামো-পরিবর্তনের শুরু। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ-বিসর্জনের পালা আরম্ভ। পনেরোবার সংশোধনের পরেও একাত্তরের চেতনায় ফিরে যাওয়া গেল না, একাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতাবোধের প্রতিফলন ঘটল না। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা আর রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান, তাই আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে উদাসীনতা।
সংবিধান নিয়ে কি খেলা করেছি আমরা—যেমন খেলা করেছি দেশনায়কদের জীবন নিয়ে? বঙ্গবন্ধু, চার নেতা, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ হরণ করেছি, জড়িয়ে পড়েছি একের পর এক আত্মঘাতী সংঘাতে। এর পাশাপাশি আরো একটি কাজ করেছি। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, হাত মিলিয়েছিল হানাদারদের হাতে, তাদের বসিয়েছি দেশ-পরিচালকের আসনে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদেযাগ হয়েছে এতদিনে, তাতেও বাধা আসছে কয়েকবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে।
স্বাধীনতালাভের সময়ে পাটের ওপরে যে-ভরসা ছিল, তা গেছে লোপাট হয়ে। আমরা হারিয়েছি এশিয়ার বৃহত্তম বলে কথিত পাটকল, গর্ব করার মতো ইস্পাত কারখানা। নতুন শিল্প অবশ্য গড়ে উঠেছে তৈরি পোশাকের, আর রপ্তানি হচ্ছে মানুষের শ্রম। এ-দুই ক্ষেত্রের আয় সচল রেখেছে অর্থনীতির চাকা। জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য যে আসছে আমাদেরই মাটি থেকে, এ-সাফল্য সামান্য নয়। বৈরী প্রকৃতির বারংবার আঘাত সত্ত্বেও আমরা যে প্রবৃদ্ধির হারের কথা বলতে পারছি, এও কম কথা নয়।
তবে প্রকৃতির সঙ্গে আমরাও কম বৈরিতা করছি না। এক টুকরো জমি ফেলে রাখতে দিচ্ছি না, জলাশয় ভরে ফেলছি, নদী দখল করছি, পরিবেশ দূষণ করছি। জাহাজ ভাঙতে পরিবেশ নষ্ট করছি, মানুষের জীবন নিয়ে নিচ্ছি। গ্রামাঞ্চলে মাটির ঘরের জায়গায় টিনের ঘর দেখে মনে হয় জীবনযাত্রার মান বাড়ছে, নগরে বহুতল ভবন দেখে ভয় হয়, এর শেষ কোথায়! এই নদীবহুল দেশে জলপথে পরিবহনের বৃদ্ধি ও উন্নতি আরো কেন হলো না, তাতে বিস্ময় লাগে। রেলপথের দুর্গতি দুঃখ দেয়। সড়ক বেড়েছে, তাতে চলাচল বেড়েছে, দূর নিকট হয়েছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানি। আর ঢাকা শহরে—এখন বলতে হবে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ শহরে—চলাচল বিঘ্নিত হওয়াই নিয়ম। কখন রওনা হলে কখন গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে, একথা কেউ বলতে পারে না।
বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বত্র সে-ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার প্রবেশাধিকার নেই। সর্বোচ্চ বিদ্যাক্ষেত্রেও তার ব্যবহার আশাপ্রদ নয়। তার জন্যে বাইরের কেউ নয়, আমরাই দায়ী। বাংলায় উচ্চশিক্ষার বইপত্র আমরা যথেষ্ট লিখতে পারিনি। ভাষাশিক্ষায় আমাদের ত্রুটি আছে—যেমন মাতৃভাষায়, তেমনি দ্বিতীয় ভাষায়। আমাদের মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে বাংলা উচ্চশিক্ষার বাহন হতে পারবে কি না, বাহন হওয়া উচিত হবে কি না। তাই আমরা ঝুঁকছি ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষার দিকে। শিক্ষার হার প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে এখনো সবাই সাক্ষর হয়নি, প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় সবাইকে আনা যায়নি। প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা আনন্দময় করতে নৃত্যগীতবাদ্যচিত্রাঙ্কনের যোগ পৃথিবীর সর্বত্রই ঘটে। তাতে একশ্রেণীর মানুষের মহা আপত্তি। সরকার নাকি দেশের সব মেয়েকে বাইজি বানাবার ব্যবস্থা করছে! এরা যে কেবল নৃত্যগীতের বিরোধী, তাই নয়; চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্যেরও বিরোধী। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যে একসময়ে ভাস্কর্য অপহূত হতে শুরু করছিল, সেকথা ভোলা যায় না। অথচ এসব ক্ষেত্র দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে রাখে। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের অগ্রগতিকে অনেকেই বিস্ময়কর বলে গণ্য করেন। দেশে সংগীতচর্চার যে-প্রসার ঘটেছে, তাও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সাহিত্য এখন বিশ্বদরবারে পৌঁছাতে শুরু করেছে।
দেশে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত। তার মধ্যেও যে কোনো কোনো রোগ থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি, এটা আশার কথা। কিন্তু কিছু কিছু সামাজিক ব্যাধি বিস্তার লাভ করছে বলে মনে হয়। যেমন, ফতোয়াবাজি। ফতোয়ার শিকার হচ্ছে প্রধানত মেয়েরাই। বাংলাদেশের চল্লিশ বছরে নারীর অগ্রগতি নিয়ে আমরা সত্যিই গর্ব করতে পারি। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ আশাপ্রদ। তার সেই অগ্রগতি রোধ করতেই অনেকে তত্পর। ফতোয়া সেই তত্পরতার একটা নিদর্শন মাত্র। যাঁরা ফতোয়ায় ধর্মীয় অধিকার রক্ষার কথা বলেন, তাঁদেরই দেখি জুমার নামাজের পর মিছিল করে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মসজিদ আক্রমণ করতে—তখন তাঁরা নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার মানেন না এবং যাঁরা নিজেদের মুসলমান বলে ঘোষণা করেন, তাঁদেরকেও অমুসলমান ঘোষণার দাবিতে অটল থাকেন। এই ধর্মান্ধতা বাংলাদেশে অভাবিত ছিল, যেমন অভাবিত ছিল ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মতো ঘটনা।
ঠিক তেমনি অপ্রত্যাশিত ছিল বাংলাদেশে সামরিক শাসন। একাধিকবার সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসকদের প্রশাসনের জঙ্গি বাংলাদেশের রাজনীতিকে মন্দের দিকে বদলে দিয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আমাদের নেতাদের আচরণে প্রায় সময়েই ওই স্বৈরাচারীদের হাবভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার কাজে বাংলাদেশের সেনা-পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। হয়তো তা দেশে সামরিক শাসনের ঝুঁকিও কমিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে দিচ্ছেন না। জাতীয় সংসদ যথার্থ কার্যকর নয়। নির্বাহী বিভাগের রাজনীতিকরণ গণতন্ত্রকে সাহায্য করে না, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরো দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। বস্তুত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে আমরা অগ্রসর হতে পারব না।
আনিসুজ্জামান: গবেষক, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক ইমেরিটাস। মুক্তিযুদ্ধকালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত