বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেই যুদ্ধ শিখি। শান্তির সময়ে পদ্ধতিটা হয় অন্য রকম। সবাই যুদ্ধ শেখে। মাঠে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার অনুশীলন করে। ভুল হলে যুদ্ধ খেলা আবার প্রথম থেকে শুরু করে অথবা অন্য স্থানে নতুন করে করানো হয়। প্রকৃত যুদ্ধ আর করা হয় না। যুদ্ধ না করতে পারাটা কোনো অমর্যাদার, অক্ষমতা বা অযোগ্যতার কথা নয়। বিশ্বময় সামরিক বাহিনীর এই-ই-এক বেসাতি। কবে যুদ্ধ হবে, কখনো যদি হয়, তার জন্য তৈরি হওয়া।

আমরা যুদ্ধ শিখিও নাই, প্রস্তুতিও ছিল না। অথচ একটা সুসংগঠিত, অভিজ্ঞ ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। যে সেনাবাহিনীর নিম্ন পদবির সৈনিক তো বটেই অফিসার এবং জেনারেলদের মানসিকতা ছিল নিচুমানের।

একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস। ছেলেরা ছোট ছোট যুদ্ধ করে এবং সাফল্য লাভ করে অনেক বেশি ঋজু। পাঞ্জাবি ও পাঠানদের বিরাট দেহ তারা আর ভয় করে না। এখন তারা বোঝে যে ওই পাঞ্জাবির রাইফেল আর মেশিনগানের গুলি একই। বিষয়টা হচ্ছে কে আগে বিচক্ষণতার এবং নিপুণতার সঙ্গে সেগুলো ব্যবহার করতে পারে।

যে রাস্তাটা ময়নামতি হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গেছে, সে রাস্তায় ১৮ কিলোমিটার গেলে কোম্পানীগঞ্জ, গোমতি নদীর পাড়ে। কোম্পানীগঞ্জের পরে মিরপুর, মাধবপুর, ছতোরা, শাহপুর, সুলতানপুর রাস্তার পাশে কয়েকটি গ্রাম। এ রাস্তাটিকে তখন বলা হতো সিঅ্যান্ডবি রোড। রণকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে পাকিস্তানিদের কাছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাকি বাংলাদেশের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগ সড়ক ছিল এটি। রেল যোগাযোগ মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের প্রায় শুরু থেকেই রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং ব্রিজ ও কালভার্ট ভেঙে অকার্যকর করে ফেলেছে। ঢাকা-সিলেট বিমান যোগাযোগ থাকলেও তা খুবই সামান্য প্রয়োজন মেটাত। তার পরও সিলেট থেকে অন্যত্র যেতে হলে এই সিঅ্যান্ডবি রোডের কোনো বিকল্প ছিল না। পাকিস্তানি সামরিক গাড়ি প্রতিদিনই চলাচল করত। তাদের রসদ, গোলাবারুদ পরিবহন এবং রোগী বা আহত ব্যক্তিদের আনা-নেওয়া করতে হতো গাড়িতে। এই গাড়িগুলো ছিল অ্যাম্বুশের জন্য সহজ টার্গেট। মাঝেমধ্যে বেশি গাড়ির বহর যেত, যেগুলো অ্যাম্বুশ করা আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিল।

একমাত্র এনারগা-৯৪ ছাড়া গাড়ির বহর কার্যকরীভাবে ধ্বংস করার কোনো রকেট লঞ্চার, ব্লেন্ডেসাইড বা রিকয়েললেস রাইফেল আমাদের ছিল না। থাকার কথাও না। এগুলো গেরিলা যুদ্ধের অস্ত্র নয়। আমরা দু-তিনটা গাড়ির বহর পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারি, কোনোভাবেই সহজে নয়। পূর্ব দিকে সালদা নদী প্রতিরক্ষা এলাকা থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ে সুবেদার ওয়াহাব এ কাজটি করতেন সফলভাবে। এ রাস্তায় শত্রুর বহু গাড়ি তিনি অ্যাম্বুশ করেছেন, বহু শত্রুর তিনি প্রাণসংহার করেছেন। বহু সফল যুদ্ধের নায়ক তিনি।

লে. কর্নেল মাযহারুল কাইউমকে বহু পাকিস্তানিসহ হত্যা করেছেন এক অ্যাম্বুশে। অন্য অ্যাম্বুশে কুমিল্লার কুখ্যাত অফিসার ক্যাপ্টেন বোখারিকেও হত্যা করেছেন তিনি। অবাক কাণ্ড; না তাঁর নিজের শরীরে, না তাঁর সহযোদ্ধাদের শরীরে শত্রুর কোনো গুলি কখনো লেগেছে বা ন্যূনতম একটি গুলির আঁচড়ও লেগেছে। গ্রামের লোক সুবেদার ওয়াহাবকে বলতো ‘জিন’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ-সমরের এক কিংবদন্তি সুবেদার আবদুল ওয়াহাব বীর বিক্রম।

কোম্পানীগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চার-পাঁচ মাইল এগিয়ে সিঅ্যান্ডবি রাস্তার পশ্চিম পাশে অ্যাম্বুশ অবস্থান নিয়ে আছি আমরা আটজন। সুযোগের জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা। আমাদের কাছে দুটি এলএমজি, একটি এনারগা-৯৪ রকেট লঞ্চার, একটি ৯ মি.মি. এসএমজি এবং বাকি ৭ দশমিক ৬২ মি.মি. এসএলআর। দুটি গাড়ি মারার জন্য পর্যাপ্ত ফায়ার পাওয়ার। আমরা মোটামুটি নিরাপদ অবস্থানে। রাস্তার দুই দিকে পাঁচ মাইলের মধ্যে কোনো পাকিস্তানি ক্যাম্প নেই। কোম্পাীনগঞ্জে যে ক্যাম্প তাতে পাকিস্তানিদের সংখ্যা ২০ জনের অধিক নয়। ওখানে ওদের গাড়ি আসে-যায়, স্থায়ীভাবে কোনো গাড়ি থাকে না। কাজেই সহসা শত্রুর শক্তিবৃদ্ধি সম্ভব নয়, নিশ্চিত।

সূর্য যখন মাথার ওপরে, তখন দেখলাম একটি পাকিস্তানি বেডফোর্ড ট্রাক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে আসছে। গাড়ি মারতে হলে চাকা ফাটাতে হয় নতুবা চালককে গুলি করে আহত করতে হয়। কোনোটাই সহজ নয়। অন্যথায় গাড়ির অন্য কোথাও গুলি লাগলে গাড়ির কিছুই হবে না। শত্রু একটু দূরে গাড়ি থামিয়ে আমাদেরই বরং আক্রমণ করতে পারে, যাকে বলে অ্যান্টি-অ্যাম্বুশ ড্রিল। আমরাও প্রতিজ্ঞ, গাড়ি মারবই।

গাড়ি ৯০ থেকে ১০০ গজ কাছে আসতেই সব অস্ত্রের একসঙ্গে ফায়ার। রাস্তার পূর্ব পাশে নিচু এবং সেখানে পানি। গাড়িটি গুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গতি বাড়িয়ে দেয়। আমরাও অবিরত ফায়ার করছি। হঠাত্ লক্ষ করলাম গাড়িটি আমাদের অবস্থান পার হয়ে একই গতিতে রাস্তার বিপরীত দিকে গভীর পানিতে ঢুকে গেল। আমরা আরও লোভ করতে পারতাম, হয়েও ছিল। গাড়ির বাকি সেনাদের মেরে অস্ত্র সংগ্রহ করা। নিজেদের সংবরণ করলাম। পশ্চিম দিকে গ্রামের ভেতরে প্রায় চার-পাঁচ মাইল দৌড়ে চলে এলাম। নিরাপদ স্থান। গাছের নিচে ছায়ায় শুয়ে পড়লাম সবাই। ক্লান্ত, বাস্তবিকই ক্লান্ত। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। না আছে আমাদের কোনো টাকাপয়সা, না আছে আশপাশে কোনো দোকানপাট। এ মুহূর্তে প্রধান সমস্যা ক্ষুধা। ক্যাম্প এখনো কম করে এক ঘণ্টা হাঁটার পথ। আমরা যখন খাবার নিয়ে কথা বলছি তখন হঠাত্ দেখি ছয়-সাত বছরের একটি ছোট ছেলে প্রস্তাব করল, ‘আমাদের বাসায় চলেন।

আমাদের বাসায় খাবার আছে।’ তার উপস্থিতি আমরা এতক্ষণে লক্ষই করিনি। ছেলেটির চেহারায় শহুরে ভাব, শুদ্ধ কথার উচ্চারণ। বুঝলাম সপরিবারে শহর ছেড়ে আসা উদ্বাস্তু। বললাম, ‘কোথায় তোমাদের বাসা?’ ছেলেটি কাছেই একটি বাড়ি দেখিয়ে দিল। দেখলাম পাকা ভিটা, সুন্দর টিনের ঘর। ক্ষুধায় আমাদের মাথা ঠিক কাজ করছিল না। না হলে, যে পরিবার বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে এসেছে তাদের সচ্ছলতা নাও থাকতে পারে। আর তা ছাড়া এতটুকু ছেলের কথায় কারও বাড়ি যাওয়া যায় না। যে ঘরে আমরা বসে আছি সেখানে একটা টেবিল, একটা চেয়ার এবং একটা চৌকি। কিছুক্ষণ পর ৩০-৩২ বছরের একজন মহিলা বাঁ হাতে ধরা দুটি গ্লাস এবং ডান হাতে এক জগ পানি এনে টেবিলে রেখে আমাদের বললেন, ‘আপনারা বসেন।’

আমাদের কারও বয়সই কুড়ির ওপরে নয়। ‘আপনারা’ সম্বোধনে তাই অবাক হলাম। এরই মধ্যে ২০-২৫ মিনিট পার হয়ে থাকবে। মহিলা এলেন একটি অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটে অল্প কয়েকটি শুকনো রুটি নিয়ে। বললেন, ‘নেন।’ আমরা আটজন ছেলে, রুটির সংখ্যা তার অর্ধেকের মতো হবে। ঘরে হয়তো অতটুকুই আটা আছে। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘আসলে আমরা তেমন ক্ষুধার্ত নই। আমরা ক্যাম্পে গিয়ে খাব।’ মহিলা যা বোঝার বুঝলেন। আমরা পলকহীন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। আচমকা দেখি তাঁর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এতক্ষণ তিনি আমাদের আপনি করে সম্বোধন করেছেন। এবার বললেন, ‘তোরা আমার ছোট ভাই। আমার ঘরে এইটুকুই আটা ছিল, খা।’ আমি উঠে হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিলাম। চোখের নোনা জল মিশিয়ে মাথা নিচু করে আমরা আটজন পাঁচটা শুকনো রুটি ভাগ করে খেলাম।

এ বয়সে কেউ খাবার সময় কাঁদে?

আমাদের সেই বোন কি আজও বেঁচে আছ? এ লেখাটি যদি তোমার পড়ার সুযোগ হয়, বিনীত অনুরোধ-আমাকে একটু খবর দিও (পত্রিকার ঠিকানায়)। আমি তোমার নাতি-নাতনিদের তোমার সামনে বসিয়ে একাত্তরের সেদিনের মাতৃভূমি ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তোমার অপার ভালোবাসার কথা বলব। বলব, সেদিন তুমি তোমার শিশুপুত্রের আহারের কথা চিন্তা না করে কী করে ঘরের অতি সামান্য শেষ খাবারটুকু আমাদের জন্য তুলে দিয়েছিলে।

প্রায় চার দশক পরে এই সত্তরোর্ধ্ব বয়সে সে কাহিনী শুনতে শুনতে তোমার কপোল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকবে আবারও। গর্বে তোমার নাতি-নাতনিদের বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠবে। আমি দেখব অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট হাতে কয়টা শুকনো রুটি নিয়ে ৪০ বছর আগের স্নেহময়ী বোনটি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আজও।

দুই.

আখতারুজ্জামান মণ্ডল ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের একজন যোদ্ধা, আমার প্রিয় বান্ধব। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী। মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সেনা। তথ্যবহুল এবং হূদয়স্পর্শী একটি বই লিখেছেন উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়। এ বইটিই আমাকে তার কাছে নিয়ে গেছে, যার উপলব্ধি আছে তাকেই নেবে।

২৫ মার্চ ইপিআর, ছাত্র-জনতা সমন্বয়ে তিস্তায় তিস্তা নদী রেল সেতু বরাবর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পাটগ্রাম, ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, উলিপুর, চিলমারীসহ বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। একাত্তরের সে সময় বর্তমানের লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলার কোনো অংশেই সড়ক পথের সংযোগ ছিল না। তিস্তা রেল সেতু ও সিত্তা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরির সময় এই এলাকার শত শত জনতা রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। তাদের মধ্যে তিস্তার পূর্বদিকে তিস্তা নদীর পাড়ে ঘড়িয়ালডাঙ্গা (ঘড়িয়ালডাঙ্গা কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার উত্তরে ঘড়িয়ালডাঙ্গা ছিল উলিপুর থানায়। মধ্য আশিতে উলিপুরের ঘড়িয়ালডাঙ্গাসহ চারটি ইউনিয়ন এবং লালমনিরহাট সদরের তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে রাজারহাট নামে নতুন উপজেলা গঠিত হয়) গ্রামের আনোয়ার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রংপুরের ১০ উইং ইপিআর থেকে পালিয়ে এসে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন আহমেদ কাউনিয়ার পূর্বদিকে সুন্দরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রয় নেন। মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পেরে ৩ এপ্রিল তিস্তা নদীর পাড়ের ঘড়িয়ালডাঙ্গা গ্রামের আনোয়ারের বাড়িকে ব্যবহার করে। আনোয়ারসহ আরও কয়েকজনের সহায়তায় নৌকা দিয়ে তিস্তা নদী পার করে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে নিয়ে আসা হয়। এ সময় আনোয়ার নৌকা সংগ্রহ ও সব ধরনের সাহায্য করে মুক্তিযোদ্ধাদের।

একাত্তরের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে রাত তিনটায় আখতারুজ্জামান মণ্ডল, কাউনিয়ার কুদ্দুস এবং রংপুরের মোখতার এলাহীসহ (পরবর্তী সময়ে শহীদ) ৩৫ জনের একটি দল ঘড়িয়ালডাঙ্গায় হাইড আউটে আশ্রয় নেয়। আখতারুজ্জামান মণ্ডলসহ ১২ জন আশ্রয় নেয় আনোয়ারের বাড়িতে। বাকিরা অন্য বাড়িতে। সবই পূর্বপরিকল্পিত। মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা সম্পর্কে কাউকেই কিছু বলা হয়নি। কেবল আনোয়ার, আনোয়ারের বাবা ও আনোয়ারের স্ত্রী ছাড়া। আনোয়ারের বাবা মোটামুটি সচ্ছল গেরস্থ। বাড়িতে মোট পাঁচটি ঘর—দুটি পুব দুয়ারি, একটি উত্তর দুয়ারি এবং দুটি দক্ষিণ দুয়ারি। আনোয়ার ও তার স্ত্রী তাদের উত্তর দুয়ারি ঘরটি খালি করে সাতজনের জায়গা করে দেয়, সাতজন আশ্রয় নেয় পুব দুয়ারি আরেক ঘরে।

এই দলটির উদ্দেশ্য তিস্তা রেল স্টেশনে অবস্থিত পাকিস্তানি ক্যাম্প রেইড করা। শত্রুর অবস্থান রেকি করতে হবে এই হাইড আউট থেকে। ঘড়িয়ালডাঙ্গা আনোয়ারের বাড়ি থেকে তিস্তা রেল স্টেশনের পূর্ব পাশ দুই-তিন কিলোমিটার পর্যন্ত আখক্ষেত। গাড়ি চলাচলের জন্য কোনো রাস্তা নেই। আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে শুধু গরুর গাড়ি চলার মতো জমিনসমান নামেমাত্র আঁকাবাঁকা কাঁচ পথ। আগের খবর অনুযায়ী পাকিস্তানিরা এদিকে যাতায়াত করে না। রাজাকাররা মাঝেমধ্যে যাতায়াত করে থাকে।

কদাচিত্ যে অস্ত্র গণযোদ্ধাদের দেওয়া হয় তেমন দুটি ৮১ মি.মি. মর্টার আছে এ দলটির সঙ্গে। আরও আছে চারটি এলএমজি, এসএমজি, এসএলআরসহ সব আধুনিক অস্ত্র। আগস্টে তিস্তা নদী বানের পানিতে ফুলে উঠেছে, নদীতে প্রবল স্রোত। রেইড শেষে নৌকা দিয়ে ভাটির পথে শত্রুর আওতার বাইরে সহজেই চলে যাওয়া সম্ভব হবে। বড় দুটি নৌকা সংগ্রহ করে এই দুই বাড়ির পাশে রাখা হয়েছে। পরদিন তিস্তা রেল স্টেশন ও আশপাশে রেকি করে মধ্যরাতে শত্রুর অবস্থান রেইড করা হবে। সাধ্যমতো খুঁতহীন পরিকল্পনা করা হয়েছে।

default-image

পাকিস্তানিরা যে এদিকে আসছে গাইড মুজিবরই দেখে প্রথম। খবর দেয় আনোয়ারের বাবাকে। ভোরে সূর্য ওঠার আগে ফজরের নামাজ শেষে আনোয়ারের বাবা হন্তদন্ত হয়ে খবর দিলেন যে তাদের বাড়ির দিকে পাকিস্তানিরা আসছে। মণ্ডল ঘর থেকে বের হয়ে দেখে পাঁচ-ছয়জন পাকিস্তানি সেনা এগিয়ে আসছে। তবে তাদের গা-ছাড়া ভাব দেখে মনে হলো, এখানে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। কিন্তু বিপদ হলো আশু করণীয় নিয়ে। শত্রু এত কাছে এসে গেছে যে সবাইকে সংঘবদ্ধ করার সময় নেই। মোখতার এলাহীর ২৩ জনের দল অন্য বাড়িতে। পালিয়ে যাওয়ার সময় নেই এবং উচিতও হবে না। দুই ঘরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা চৌকির নিচে দরজা বরাবর এলএমজি বসিয়ে প্রস্তুত রইল। পাকিস্তানিরা যদি ঘরে না ঢুকে চলে যায় তাহলে গুলি করা হবে না। কিন্তু ঘরে ঢুকতে গেলেই গুলি।

বাড়ির উঠানে প্রথমে কামলাদের এনে মারধর করল, তাদের জিজ্ঞাসা করা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে। তারা জানে না বলে জবাব দিল। আদতেই তারা জানে না। কেননা রাত তিনটায় মুক্তিযোদ্ধারা যখন এ বাড়িতে আসে তখন বাড়ির কামলারা সব ঘুমে। এরপর আনোয়ারকেও মারধর করা হলো। আনোয়ার কিছুই প্রকাশ করল না।

একাত্তরে পাকিস্তানিরা গ্রামে প্রবেশ করত। এদের সহযোগী এবং পথপ্রদর্শক হিসেবে সঙ্গী হতো রাজাকাররা। এই রাজাকারদেরও আবার সহযোগী ছিল মুসলিম লীগের তথাকথিত শান্তি কমিটির কিছু বজ্জাত। এরা খবর দিত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের, সুন্দরী মেয়েদের এবং গরু-ছাগল-মুরগির।

পাকিস্তানিদের আগমন সংবাদে সবচেয়ে প্রথম নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা হতো যুবতী মেয়েদের জন্য এবং যুবক ছেলেদের জন্য। আশপাশের বনে-জঙ্গলে, পাটক্ষেতে, আখক্ষেতে লুকিয়ে থাকত এরা। কেননা যুবক ছেলে দেখলে ‘মুক্তি’ বলে গুলি করত এরা। মুক্তিযোদ্ধা বলে বা তাদের সাহায্যকারী হিসেবে কাউকে হত্যা করতে হলে তার হুকুম দিত ‘বাংলাদেশ ভেজ দো’ অর্থাত্ ‘বাংলাদেশে পাঠিয়ে দাও’। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত।

পাকিস্তানিরা যখন উঠানে মারধর করছে তখন হঠাত্ কোত্থেকে আনোয়ারের বউ এল এরই মধ্যে। আখতারুজ্জামান মণ্ডল আমাকে বলেন, আমরা সুন্দর এ মেয়েটিকে ঠিকই আনোয়ারের স্ত্রী হিসেবে অনুমান করলাম, যদিও তাকে আগে কখনো দেখিনি। পাকিস্তানি পশুগুলির সামনে এ মেয়ে কেন এল? সে কেন পালায়নি? আমাদের অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। যে দরজার দিকে মুখ করে আমাদের এলএমজি লাগানো ঠিক তার সামনে দরজার ওপারে মাটির বারান্দায় একটি চাটাই পেতে রেহালের ওপর কোরআন শরিফ রেখে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে গুনগুনিয়ে তেলাওয়াত করা শুরু করল ১৭-১৮ বছরের মেয়ে। কী ভাবছে সে। তার ঘরে আশ্রয় নিয়েছি বলে আমাদের নিরাপত্তার ভার তাকেই নিতে হবে? তার নিজের সম্ভ্রম এবং জীবনের বিনিময়েও? কোরআন শরিফ তেলাওয়াতরত একজন মহিলাকে ডিঙিয়ে পাকিস্তানিরা ঘরে ঢুকবে না—মেয়েটি হয়তো ভাবছে, কারণ তারাও তো মুসলমান। আমরা ভাবছি যদি তাকে সরিয়ে বা ডিঙিয়ে পাকিস্তানিরা ঘরে ঢুকে পড়ে তাহলে বাধ্য হয়েই আমাদের গুলি করতে হবে। আমাদের গুলিতে পাকিস্তানিরা মরবে সত্য, কিন্তু এ মেয়ের কী হবে। এ তো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কয়েক সেকেন্ডের ভাবনায় কোনো কিনারা করতে পারছি না।

না, পাকিস্তানিরা ঘরে ঢোকেনি। উঠান থেকেই চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা গোটা পরিকল্পনা পরিবর্তন করে সকাল সাড়ে সাত-আটটার মধ্যে গ্রাম ত্যাগ করে।

তিন.

আখতারুজ্জামান মণ্ডল আমাকে একাত্তরের কাহিনী শোনান। বলেন, সেদিন গ্রাম ছাড়ার আগে আমাদের সেই ছোট বোনটিকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেলাম। অপরাধীর মতো বলেন, এ কিশোরী মেয়ে আমাদের কাউকেই কোনো দিন দেখেনি। বাংলাদেশ বলতে তার বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি। সেই বাংলাদেশকে এমন করে ভালোবাসতে হয়? বাংলাদেশের স্বাধীনতার যোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের সবটুকুই বিপন্ন করতে হয়?

ষাটের পরও এক-দুই বছর পার করেছেন বন্ধু আখতারুজ্জামান মণ্ডল। শুভ্র কেশে ছেয়ে গেছে মাথা। মুখের ভাঁজ বলে দেয় বেলা হয়েছে। বলতে বলতে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নেন তিনি। বলেন, গল্পটা এখানে শেষ করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কাহিনীটা এখানে শেষ হলো না। সকালে আমরা বাড়ি ছেড়ে আসার পর গ্রামের কোন বেজন্মা যেন পাকিস্তানিদের খবর দেয় যে আনোয়ারদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী ছিল। সেদিনই পাকিস্তানিরা এসে আনোয়ারের বউকে ধরে নিয়ে যায়, আর ফেরেনি।

আমাদের স্বাধীনতার কত ঋণ!

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত