বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশ ৯ মাসের বীরত্বব্যঞ্জক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়ে বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় সব সময় আনন্দের। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে সুগভীর বিষাদ বা ট্র্যাজিক কোনো ঘটনা। আমাদের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছিল। বরং বলা যায়, বড় বেশি মূল্য দিতে হয় বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। তিরিশ লাখ বাঙালি তাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার শিকার হয়। চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে; শিশুনিধন ঘটে বেশুমার এবং বাঙালি জননীর আত্মার কারিগর বুদ্ধিজীবীদের পৈশাচিক বর্বরতায় হত্যা করা হয় হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায়।

এখানেই শেষ নয়। এত ভয়াবহ ঘটনার পরও মূল উদ্বেগের জায়গায় এখনো হাহাকার। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু এখনো শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের হাতে বন্দী। তাই তাঁকে ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা শুধু অপূর্ণ নয়, অসুরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তখনো জানি না তিনি বেঁচে আছেন, নাকি পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা তাঁকে তথাকথিত বিচারে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। নানা রকম গুঞ্জনে তখন আকাশ-বাতাস ভারী।

২২ ডিসেম্বর প্রথম বাংলাদেশ সরকার কলকাতা থেকে স্বাধীন দেশে ফিরে আসে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমেই বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজয় এখনো অসম্পূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।’ তিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের আহ্বান জানান। নতুন বাংলাদেশ সরকার তখনো জানত না যে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির মিয়ানওয়ালি জেলের সেল থেকে মুক্ত করে রাওয়ালপিন্ডি শহরের কাছে একটি অতিথিশালায় স্থানান্তরিত করেছেন। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু পরে বিখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের কাছে ব্যক্ত করেছেন।

ভুট্টো বেশ কয়েকবার এই গেস্টহাউসে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কখনো নাটকীয় ভাষাভঙ্গি, কখনো বন্ধুত্বপূর্ণ আবেগময়তা বা সূক্ষ্ম চাপ প্রয়োগে তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বার্থের কথা বলেন। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে জানান যে সামরিক শাসকদের অপসারণ করে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন। তবে বাংলাদেশে কী ঘটেছে, অতিথিশালায় বন্দী উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধুকে তা বললেন না। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, তা না বলে তিনি বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়ায় যে আলোচনা চলছিল, তা ভেঙে যায়। তবে আলতোভাবে বলেন যে আপনার লোকদের দ্বারা ঢাকায় একটা প্রশাসন চালু আছে। বিস্তৃতভাবে আর কিছু বলেন না।

ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এই আলোচনায় ড. কামাল হোসেনকেও বন্দিশালা থেকে এনে যুক্ত করা হয়। সে আলোচনায় ভুট্টোকে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু বর্তমান অবস্থায় কোনো প্রতিশ্রুতিই দিতে পারবেন না। তাঁকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হোক। সেখানে ফিরে গিয়ে পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করেই শুধু সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। ভুট্টো তখন কিছু বিগলিত হয়ে বলেন, ‘ইয়াহিয়া আপনাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে জেদ ধরেছিল। কিন্তু আমি তা ঠেকিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি কি এখন মুক্ত এবং পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে যেতে পারি?’ ভুট্টো বলেন, ‘আমার কিছুটা সময় দরকার। জনগণকে এ বিষয়ে প্রস্তুত করতে হবে।’

এভাবে ১০-১২ দিন চলে যায়। অবশেষে ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ ভুট্টো করাচিতে এক জনসভা ডাকেন। সেই জনসভায় তিনি বলেন, দেশকে তিনি সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারমুক্ত করেছেন। দেশে এখন গণতন্ত্র, তথা জনগণের শাসন কায়েম হয়েছে। জনমতের ওপরই সবকিছু চলবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারি না। কারণ, আমরা জনগণের সরকার। আমরা একনায়কত্বকে কবর দিয়েছি।’ নাটকীয় ভঙ্গিতে এসব কথা মানুষকে আবেগাক্রান্ত করে, কিন্তু আকস্মিকভাবেই বলেন, ‘আপনারা কি মুজিবকে মুক্ত করে দিতে আমাকে সম্মতি দেবেন?’ জনগণ উচ্চ স্বরে তা অনুমোদন করে (শেখ মুজিবুর রহমান: ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার, সৈয়দ বদরুল আহসান, নিয়োগী বুকস, ২০১৪)।

এভাবেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানি বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের জাতীয় এয়ারলাইনস পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে ড. কামাল হোসেন, তাঁর পরিবারসহ ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছান। পরবর্তী ইতিহাস আমাদের মোটামুটি জানা আছে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশবাসীর সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নিরসন ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু সগৌরবে দেশে ফিরে আসেন। সেই দিন ছিল আমাদের বিজয়ের পরিপূর্ণতা। প্রকৃত বিজয়োল্লাসের দিন। এটা শুধু আবেগর বা উচ্ছ্বাসের কথা নয়। কারণ, পাকিস্তানি ২৩ বছরের সামরিক স্বৈরশাসনে স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব বাংলা ছিল শোষিত-বঞ্চিত একটি অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ অঞ্চল বা কলোনি। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী শুধু নজিরবিহীন গণহত্যাই চালায়নি, গোটা দেশকে বিধ্বস্ত এবং চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দিয়ে যায়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা, অর্থাৎ রেল-বিমান-সড়ক-সেতু প্রভৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভঙ্গুর ও অচল। বন্দরগুলো, বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রধান বন্দর ছিল বিপজ্জনকভাবে মাইন স্থাপনে বিস্ফোরণোন্মুখ, কোষাগার ছিল শূন্য। ইংরেজি ভাষায় বললে, এটা ছিল হারকিউলিয়ান টাস্ক। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মাপের বিশ্বনন্দিত মহানায়ক ছিলেন আমাদের সেই হারকিউলিস। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক ও হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব ছাড়া সমস্যার পাহাড় ডিঙিয়ে এত অল্প সময়ে আর কারও পক্ষে উজ্জ্বল উদ্ধার সম্ভব ছিল না।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল চালানোর অভিজ্ঞতা নেই, এদের নিয়ে আমাকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশ চালাতে হচ্ছে; এটা কেউ বুঝতে চায় না।’ বঙ্গবন্ধুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিশ্বনেতাকে ফিরে পেয়েছিলাম বলেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় ধীরে ধীরে জেগে উঠে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। দেশ পুনর্গঠনের এই মহাযজ্ঞেও বঙ্গবন্ধুর অবদান যে কত বড় ছিল, তা বলে শেষ করা যায় না।

default-image

তিনি যদি ফিরে না আসতে পারতেন, তাহলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কী অবস্থা হতে পারত, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক গবেষক ও লেখক এবং অন্যতম বিরোধীদলীয় নেতা মওদুদ আহমদের বিশ্লেষণমূলক বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। তাঁর বাংলাদেশ: এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান শীর্ষক ইংরেজি বইয়ের সংশ্লিষ্ট অংশ এভাবে উৎকলিত হয়েছে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসার মুজিব ভাই নামের গ্রন্থে: ‘তিনি (মুজিব) পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে একটি জাতিকে চিরদিনের জন্য গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাকিস্তানি কারাগারে নিহত হলে তিনি হয়তো শহীদ হয়ে অবিস্মরণীয় হতেন। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটত চরম অরাজকতা ও হানাহানি। খণ্ড-বিখণ্ডিত হতো দেশটি। এ সত্যটিও মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে অনেক জনপ্রিয় নেতাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেন নাই। শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে, তিনি দেশ শাসনের দায়িত্ব নিয়ে সেই স্বাধীনতাকে বিপদমুক্ত করেছিলেন। অন্য কারও পক্ষে এই দুরূহ কাজটি করা সম্ভব হতো না। তিনি দেশে ফিরে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু একটি মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ রেখে গেছেন।’

শামসুজ্জামান খান: লোকসংস্কৃতিবিদ ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত