বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলাদেশের বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলমানের উত্থান এক বিস্ময়কর ঘটনা। দারিদ্র্যপীড়িত ও অশিক্ষিত সেই সম্প্রদায়ের কিছু মুসলমান জমিদার ও সওদাগর ছিলেন, যাঁরা সাধারণত ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে এসেছেন। দরিদ্র কৃষকের মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলে যে ব্রিটিশ-বিরোধিতা ঊনবিংশ শতাব্দীতে গড়ে উঠেছিল, তা ধীরে ধীরে—বিশেষ করে সিপাহি বিদ্রোহের পরে—নিস্তেজ হয়ে যায়। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে সাংগঠনিক তত্পরতা শুধু টিকেই থাকে না, ধীরে ধীরে তা শক্তি সঞ্চয় করে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলমানদের অবস্থা যে দ্রুত উন্নতি লাভ করে, তার দুটো প্রধান কারণ পাট ও ভোট। পাটের বদৌলতে দরিদ্র মুসলমান কৃষক দুটো পয়সার মুখ দেখলেন। ইংরেজি শিক্ষাবিরোধী আন্দোলনের জন্য নয়, মূলত টাকার অভাবে দরিদ্র মুসলমান ছেলেদের শিক্ষা দিতে পারেনি। সামান্য অর্থাগমের ফলেই মুসলমান সমাজে শিক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। রাজনীতির চেয়ে শিক্ষাবিস্তারে মুসলমানরা আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং সাফল্যও অর্জন করে। টাকার জোরে মুসলমান কৃষক প্রজাস্বত্ব আইনের সবটুকু অধিকার অর্জনের জন্য ধনী জমিদারের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়েছে। নিরপেক্ষ মুন্সেফের রায়ে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মুসলমান জোতদারদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নস্থ বহু সরকারি পদে মুসলমানেরা চাকরি পেয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের ভোটের জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বদৌলতে মুসলমানেরা মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। নতুন নতুন পদে মুসলমানেরা চাকরি পেয়েছে। অনগ্রসর মুসলমানদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে রবীন্দ্রনাথ একসময় সুপারিশ করেছিলেন। অথচ তিনিও মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি লক্ষ করে বললেন, ‘মুসলমানরা মুষল ধরেছে।’ একই থানায় ছোট ও বড় দারোগা দুজনই মুসলমান হওয়ায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক উপন্যাসে এক চরিত্র বলছেন, পাকিস্তান তো হয়েই গিয়েছে।
‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান দিলেও লড়াই করে নয়, ভোটের জোরেই মুসলমানেরা পাকিস্তান অর্জন করল। স্বপ্নের পাকিস্তান এত দ্রুত বাস্তবায়িত হওয়ায় সমাজে যে উত্সাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়, তার গতি থমকে দাঁড়ায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। রাষ্ট্রভাষার দাবি ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ২১৪ অনুচ্ছেদে নামেমাত্র স্বীকৃত হলেও কাজেকর্মে সেই স্বীকৃতির প্রতিফলন ঘটল না। আইন করে স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষার প্রয়োগ পিছিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধানের ২১৫ অনুচ্ছেদে উর্দু ও বাংলাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, বলা হলো যে ইংরেজির ব্যবহার ব্যাহত হবে না এবং সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি সরানোর ব্যাপারটা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট একটা কমিশন নিয়োগ করবেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে সে প্রয়োজন আর দেখা দেয়নি। ইতিমধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর এক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু হবে।’
বাস্তবে সর্বস্তরে বাংলা চালু করা সম্ভব হয়নি। এখনো তাই বাংলা ভাষার সংগ্রাম অসমাপ্ত। আন্তর্জাতিক আলোকিত জনমত যেখানে মাতৃভাষার পক্ষে, এমনকি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা সংরক্ষণের পক্ষে সোচ্চার, সেখানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে গড়িমসি করছি। তবে সুখের বিষয়, গৌরবের বিষয়, ভাষার আন্দোলনে দেশের তরুণদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সকল দেশের ভাষার কথা বলে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এক আকাশের নিচে সমগ্র মানবসমাজের সংহতি স্বরূপ পালিত হচ্ছে।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও বর্ধিষ্ণু বাঙালি মধ্যবিত্ত তাকে যথেষ্ট বলে গ্রহণ করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সেই প্রবৃদ্ধি তাদের কাছে অকিঞ্চিত্কর মনে হয়। তাদের মনে হয়, এ দেশের পাট অন্যান্য রপ্তানি দ্রব্যের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তান সমৃদ্ধি লাভ করে। উনিশ শ সত্তরের নির্বাচনী প্রচারপত্র পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন জনমনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। দেশে দুই অর্থনীতির কথা উঠল। পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের মধ্যে বৈষম্য আলোচনায় ক্ষোভ, তিক্ততা ও বিরক্তির উদ্রেক হলো। ছয় দফার ডাক দিলেন শেখ মুজিব। কয়েক বছর না যেতেই তরুণেরা এক দফার ডাক দিলেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ধর্মভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে বাংলার মুসলমান পাকিস্তান অর্জন করে। সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের ছয় দফার দাবি তোলে। আন্দোলনের প্রাবল্য ও সাফল্যে অতি শিগগিরই বাঙালি মুসলমান স্বাধীনতা-মন্ত্রে দীক্ষিত হলো।
প্রতিবেশী ভারতের নানাবিধ সহায়তা, সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক সাহায্য এবং বিশ্বজনমতের নৈতিক সমর্থনে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন বছর না যেতেই চূড়ান্ত জয়ের মুখ দেখল। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি সকলের মুখে মুখে উচ্চারিত হলো। এসবের প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা অন্যদের ভাবিয়ে তুলল। বাংলা তো এখন দ্বিখণ্ডিত, ‘জয় বাংলা’ বলতে ওরা কোন বাংলার কথা বলছে। ওরা কি যুক্ত বাংলার ধ্বজাধারী! ওরা কি ‘জয় হিন্দ’-এর অনুকরণ-অনুসরণ করছে! এমন দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বিদ্যমান। মাঝেমধ্যে তা এমনই শক্তি অর্জন করে যে, সংবিধান-পরিবর্তন থেকে জয়ধ্বনি-পরিবর্তন ঘটে যায় দ্রুত। পরিবর্তনের গতি প্রগতি হতে পারে, পশ্চাত্গতিও পারে। তার টান যেমন সামনের দিকে সটান হতে পারে, তেমনি পেছনের দিকে পিছু পিছু পিছুটানও হতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ড ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশের অংশ, বৃহদংশ বটে। পাকিস্তান আমলেও তা ছিল একটি প্রদেশ, জনসংখ্যায় ছিল সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। পাকিস্তান আমলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নীতিনির্ধারণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাঙালিদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। সেই অনভিজ্ঞতার দরুন স্বাধীনতার পর আমরা নানা দ্বন্দ্বদোলায় ভুগেছি। পরিস্থিতি ও অবস্থার সুযোগ নিতে যথাসময়ে ঝুঁকি নিতে পারিনি। বৃহত্ প্রতিবেশী সম্পর্কে আমরা আতঙ্কিত ছিলাম। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মালিক হয়েও সংখ্যালঘুর দুঃশ্চিন্তা ও হীনম্মন্যতায় আমরা সাহস অর্জন করিনি।
আমরা যথাসময়ে সাবমেরিন কেব্ল ও এশিয়ান হাইওয়ে সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে মারাত্মক দোলাচলে ভুগেছি। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার নিয়মিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিইনি। আমাদের স্থলসীমা, জলসীমা ও মহীসোপানসীমা এখনো বিতর্কিত। তথ্যাদির অভাব, জ্ঞানের অভাব ও উদ্যোগের অভাবের জন্য প্রায়ই আমরা সীমানাসংক্রান্ত ঝুটঝামেলায় মারাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়ি।
চাকরি-ঘি ভাত এই মতে দৃঢ়বিশ্বাসী চাকুরে বাংলাদেশিরা তাই মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের জন্য দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছু চিন্তা করতে পারেনি। এর চেয়ে তাদের বিশেষ রেয়াতে খাসজমি দান করে বা অন্যভাবে পুরস্কৃত করলে দেশের প্রশাসনে ঈর্ষা-কলহের উপস্থিতি এত ভয়াবহভাবে দেখা দিত না।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুরের ৭ মার্চ ভাষণের পর এমন ঘাড়-ভাঙা দ্রুতগতিতে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের দিকে ধাবিত হলাম যে, আমরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য প্রাকচিন্তার তেমন অবকাশ পাইনি। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এই অঙ্গীকার করে ঘোষণা করেন যে, জাতিসভার এক সদস্য হিসেবে তাঁদের ওপর যে কর্তব্য ও দায়িত্ব বর্তেছে, তাঁরা তা পালন করবেন এবং জাতিসংঘ সনদ মেনে চলবেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার একটা স্বাভাবিক প্রণোদক রণধ্বনি ছিল। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমরা মানবাধিকারের আদর্শকে আহরণ করি এবং একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করি, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। এক সুকঠিন মহান অঙ্গীকার বটে।
বহু বছর ধরে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ আমাদের কখনো হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই-সংগ্রামের সময়ও আমরা ভাবার অবকাশ পাইনি, যে স্বাধীন রাষ্ট্র আমরা রক্ত দিয়ে অর্জন করব, সেটা কীভাবে পরিচালিত করব। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আমরা যে সাহসিকতা, বীরত্ব ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছি, স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। সদ্যস্বাধীন শিশুরাষ্ট্র হিসেবে কিছু ভুলত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের কিছু মহাভুলও ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পরেও শিশুরাষ্ট্রের অজুহাত প্রদর্শন এমনই বালখিল্য যে, সে ব্যাপারে আমাদের কর্ণপাত করার অবকাশ বা প্রয়োজন নেই।
আমাদের প্রশাসন বড় টলমলে। প্রতিটি নির্বাচনের পরে লোকে প্রশাসনে পরিবর্তন আশা করে, আশঙ্কাও করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যা স্পয়েল সিসটেম বলে অভিহিত এবং যাকে আমরা নির্বাচনী যুদ্ধের ‘গানিমা’ বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি বলতে পারি, তার জন্য ছোটাছুটি লেগে যায়। এই স্বাভাবিক প্রবণতা সীমা ছাড়িয়ে যায় যদি সরকার ‘আমাদের লোক’ অন্বেষণে ব্যাপৃত হয়। এই ধরনের অস্থিতি প্রশাসনে বিরাজ করলে কী দশা হয়, তার একাধিক অভিজ্ঞতা সম্প্রতি আমাদের হয়েছে। সরকারের আইন-বিধি মেনে চলা সবচেয়ে বেশি জরুরি। সরকারকে দেখে প্রজাকুল তার আচরণ নির্দিষ্ট করবে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের যা কিছু অর্জন করা বাকি রয়েছে, এখন প্রয়োজন তা অর্জনের চেষ্টা করা; জনপ্রশাসনকে আরও দক্ষ ও কার্যকর করে তোলা।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল সুখী সুন্দর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই ‘সোনার বাংলা’ কীভাবে গড়ে তোলা যায়, সেটাই হওয়া উচিত আমাদের সবচেয়ে বড় ভাবনা ও কাজের বিষয়।
বিজয় দিবসে আমাদের জয়ধ্বনি তিনবার উচ্চারণ করে এই লেখা শেষ করি—জয় বাংলা! জয় বাংলা!! জয় বাংলা!!!
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত