আমাদের বাড়ি থেকে গারো পাহাড়টিকে আবছা দেখা যায়। শীতের দিনে যখন উত্তরের আকাশ মেঘমুক্ত থাকে, তখন কালচে সবুজ পাহাড়টি অধিক দৃশ্যমান হয়। সমতলের মানুষ তার অনভ্যস্ত চোখের কারণেই পাহাড়ের দূরত্ব সঠিক অনুমান করতে পারে না, মনে হয় বুঝি এই তো আর একটু এগোলেই পাহাড়ে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা যে পাহাড়টিকে আমাদের খুব কাছেই বলে মনে করতাম, সেই গারো পাহাড়টি ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ভেতরে। মেঘালয় নামটি আমার খুব ভালো লাগত। চমত্কার নাম মেঘালয়। মেঘের আলয়। মেঘের বাড়ি। মেঘবাড়ি।
আমরা দেখতাম, কালো সাদা কালচে নীলচে—বিচিত্র রঙের বিচিত্র আকারের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে সেই পাহাড়ে। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২০-২৫ মাইল উত্তরে। ছোটবেলায় আমরা যখন ট্রেনে চড়ে বারহাট্টা থেকে নেত্রকোনায় যেতাম, তখন আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া সবুজ অরণ্যাবৃত গারো পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢেউ-খেলানো সারিগুলি স্পষ্ট দেখা যেত। গারো পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকত—‘আয়, আয়।’
আমারও খুব ইচ্ছে হতো যাই। আমারই আজান্তে কখন যে আমি সেই পাহাড়ের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে ফেলেছিলাম, কে জানে। বিধাতা মানুষের অনেক আশাই পূর্ণ করেন তাঁর নিজের নিয়মে। সেই নিয়মের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। আমার আশৈশবের গারো পাহাড় দেখার সাধ পূর্ণ হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি এসে।
পঁচিশে মার্চ রাতে আমি ঢাকায় ছিলাম। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের গণরায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত সমগ্র পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে চলতে থাকা আলোচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা না করেই, ওই রাতে পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রণীত ও জেনারেল জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক সমর্থিত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ প্ল্যান কার্যকর করা হয়। পাক সেনারা সেই কালরাতে মারাত্মক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকার নিরস্ত্র মানুষের ওপর ক্রুদ্ধ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পাক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা আমাদের স্থানীয় দেশীয় লুটেরারা আমাদের বাড়ি লুট করল প্রকাশ্য দিবালোকে। আমরা যতটা সম্ভব আগলে রাখতে পারা পথের সঞ্চয় নিয়ে সাতপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে প্রাণ আর সম্মান বাঁচাতে সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। আমাদের সাতপুরুষের ভিটি, জমিজমা, গরু-বাছুর, মাছভরা পুকুর, মাচাভরা ধান লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়ে যখন বাড়ির সীমানা অতিক্রম করে ভারতের পথে পা বাড়ালাম—তখন থেকেই শুরু হলো আমাদের এক নতুন জীবন, একটি নতুন অধ্যায়, যার নাম শরণার্থী।
আমার মা পেছন ফিরে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের স্কুলঘরের সামনে সবুজ ঘাসের ওপর বসে কাঁদতে শুরু করলেন। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন ওই শতাব্দী-প্রাচীন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। নেত্রকোনা জেলার প্রথম স্কুলগুলির একটি ছিল এটি। আমাদের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডক্টর ইন্নস আলী সাহেব ছিলেন ওই স্কুলের ছাত্র।
আমার মায়ের কাণ্ডজ্ঞান হারানো কাঁদন সংক্রমিত হলো অনেকের চোখে। তাতে আমাদের লজ্জা ও দুঃখ দুটোই বাড়ল। পথচারীরা ভিড় করল আমাদের শেখ মুজিব-প্রীতির এই করুণ পরিণতি দেখতে। তাদের নীরব চাহনির ভেতরে যে অভিযোগটি ফুটে উঠল তা আমার কাছে মনে হলো অনেকটা এ রকম—আমরাও শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছি বটে, কিন্তু তোমরা হিন্দুরা যেভাবে রিলিজিয়াসলি একাট্টা হয়ে মুজিবরকে ভোট দিয়েছ, আমরা তেমন করে দিইনি। আমরা মুসলিম লীগকেও দিয়েছি, মুজিবরকেও দিয়েছি। মুজিবর যে এত ভোট পেল, মুসলিম লীগকে সাত হাত জলের তলায় ডুবিয়ে দিল, সে তো তোমাদের এ রকম একাট্টা হয়ে ভোট দেওয়ার পাগলামির ফলেই।
নইলে তো মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগের ভোটের মধ্যে একটা ব্যালেন্স হতো। ওই ব্যালেন্সটা নষ্ট করে দিয়েছ তোমরা। তার ফল তো হিন্দুদেরই বেশি ভোগ করতে হবে। মুসলমানেরাও ভোগ করবে, কিন্তু হিন্দুর মতো একাট্টা ভোগ করতে হবে না—এটাই স্বাভাবিক। মুসলমান হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগারের আড়ালে মুসলিম লীগার বা মুসলিম লীগারের আড়ালে আওয়ামী লীগারের সাপোর্টাররা লুকাতে পারবে—কিন্তু তোমরা হিন্দুুরা লুকাতে পারবে না। তোমরা ধরা পড়ে গেছ। সুতরাং ইয়াহিয়ার মিলিটারিরা যদি তোমাদের ওপর বিশেষভাবে অপ্রীত বোধ করে, তাতে তাদের বিশেষ দোষ হয় না।
আমি মানি তাদের যুক্তি। বুঝি যে পাক বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়াই যে হিন্দুদের বাড়িঘর নির্বিচারে লুট করা হচ্ছে, তার পেছনে একটা দর্শন কাজ করছে। এটাকে ঠিক সাম্প্র্রদায়িকতা বলা যাবে না। এর ধরনের মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। জলকম্পের সময় সাগর, নদী ও পুকুরের জল যেমন ফুলে-ফেঁপে ওঠে—এ যেন তেমনই। সারা দেশে হিন্দুকম্প রোগ ছড়িয়ে পড়ল জলকম্পের মতো। আমি বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানি মিলিটারি ও নির্বাচনে পরাজিত স্থানীয় মুসলিম লীগারদের পরোক্ষ মদদেই হিন্দুর বাড়িঘর লুট করে তাদের দেশছাড়া করার অপারেশন শুরু হয়েছে। আজকাল এথনিক ক্লিনজিং যাকে বলে।
মনে পড়ল, ঢাকায় আমার প্রতিবেশী, পিটিভির বিশিষ্ট প্রযোজক বেলাল বেগ আমাকে পাকিস্তানি মিলিটারির পরবর্তী স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে এ রকম একটি ধারণা দিয়েছিলেন। ২ এপ্রিল ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, যান কিন্তু ওখানেও থাকতে পারবেন না। পাক মিলিটারিদের অপারেশন সম্পর্কে আমি যতটা জানি, তাতে তাদের পরবর্তী টার্গেট হবে নির্বিচারে হিন্দুরা এবং বিচার সাপেক্ষে আওয়ামী লীগের মুসলমান নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের কট্টর সমর্থকেরা। আমি বেলাল বেগের ধারণার যথার্থতা দেখে মুগ্ধ হলাম। বুঝলাম এটি পাক মিলিটারিদের নীল নকশার অংশ বলেই আমাদের বাড়িঘর এভাবে লুট হতে পারল প্রকাশ্য দিবালোকে। থানা বা স্থানীয় প্রশাসন চুপ করে থেকে দেখল। কিচ্ছুটি বলল না। বুঝলাম বেলাল বেগ-কথিত পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দুমুক্ত করার বড় পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করার প্রয়াস শুরু হয়েছে। তার ফল যে দ্রুতই বুমেরাং হবে তাও আমার মনে হলো। ফলে আমি ব্যাপারটিকে খুব সহজভাবে নিতে পারলাম। আমার ধারণা হলো, এর ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ অনিবার্য ও যুক্তিযুক্ত হয়ে উঠবে।
আমরা জোর কদমে এগিয়ে চললাম আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের মতো। চলো চলো দিল্লি চলো, লাল কেল্লা দখল করো—বলতে বলতে আমরা এগিয়ে চললাম। আমরা স্থির করলাম শরণার্থী হলেও আমাদের একটা রণধ্বনি থাকা দরকার। স্থির হলো জয় বাংলাই হবে আমাদের রণধ্বনি। আমরা বলতে এখানে শুধুই আমার নিজ পরিবারের সদস্যদের বোঝাচ্ছি না। ১৯৭১ সালের অভাবনীয় বাস্তবতায় আমরা, মানে, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আমাদের এলাকার বিভিন্ন গ্রামে বসবাসকারী হিন্দু সমপ্রদায়ের প্রায় সব সদস্যই ওই আমরার অন্তর্গত। আমার কেবলই মনে হতে থাকল—যেন আমরা খুব বড় রকমের একটা পিকনিকে যাচ্ছি। আমরা গারো পাহাড়ে যাচ্ছি। ভারতবর্ষে যাচ্ছি। আমার খারাপের চাইতে ভালো লাগল বেশি। মনে হলো শত্রুর তাড়া খেয়ে আমরা দল বেঁধে যুক্ত হতে ছুটে চলেছি একটি নতুন দেশের জন্ম-প্রক্রিয়ার সঙ্গে।
আমরা দুপুরের দিকে বারহাট্টায় পৌঁছলাম। বারহাট্টার প্রভাবশালী মুসলমান কাদির খানের বিশাল গুদামঘরে আমরা রাত কাটালাম। আমাদের দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। ফলে রাতের মধ্যেই আরও কয়েকটি গ্রাম থেকে লুণ্ঠিত হিন্দুরা লুকিয়ে এসে আমাদের সঙ্গী হলেন। একত্র হলে কাকেরও জোর বাড়ে, সংখ্যালঘু হওয়ার গ্লানিতে ন্যুব্জ হিন্দুরাই বা সেই নিয়মের বাইরে থাকবে কেন? রাতের মধ্যেই আমাদের সদস্যসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেল। তাতে আমাদের যাত্রাপথের ভয় কিছুটা দূর হলো। আমাদের দলে শিশু, নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যেমন আছে—তেমনি আছে আমার মতো অনেক তরুণ যুবা। তা ছাড়া স্থানীয় কিছু মুসলমানও আমাদের অভয় দিতে এগিয়ে এলেন। আমাদের হাতে-হাতে বাঁশের লাঠি। ছোটখাটো চাকু ও দা-কুড়াল। ওইসব অস্ত্র দিয়ে পাক বাহিনীকে ঘায়েল করতে না পারলেও, পথের নবিশ লুটেরাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই লড়া যাবে। এমত বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সূর্য ওঠার আগের কুসুম আলোয় আমরা বারহাট্টা ছেড়ে সীমান্তের পথে পা বাড়ালাম। আমাদের নেক্সট স্টপ হচ্ছে সীমান্ত-সংলগ্ন কলমাকান্দা বাজার। আমি অবশ্য কলমাকান্দা না বলে কমলাকান্দাই বলি। তাতে উচ্চারণমাত্র গাছ থেকে সদ্য পাড়া তাজা কমলার স্বাদ পাওয়া যায়।