বিজ্ঞাপন
default-image

যুদ্ধের সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে বাবা মোবারক হোসেন আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ভাই চাঁদ আলীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেদিন মায়ের চোখের জল দেখে সহ্য করতে পারিনি। ছুটে গিয়েছিলাম ভাদালিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের কাছে। ক্যাম্পের চারপাশে দেখি, মাটির মধ্যে কাউকে অর্ধেক পুঁতে রাখা হয়েছে, কাউকে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, কারও পা, কারও হাত বেরিয়ে আছে। এই বিশাল লাশের স্তূপের মধ্যে একে একে টেনে তুলি বেশ কটি লাশ। কিন্তু বাবা ও ভাইয়ের লাশ দেখতে না পেয়ে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসি। সেদিন যদি সব লাশ তুলতে পারতাম, তাহলে হয়তো বাবা ও ভাইকে খুঁজে পেতাম। কিন্তু পারিনি, প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম।

সেদিন ছিল ৫ সেপ্টেম্বর। বিকেলের দিকে কুষ্টিয়া সদর থানার বৃত্তিপাড়া থেকে পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া পুলিশ বাহিনীর একটি দল দহকুলা গ্রামের মধ্য দিয়ে আলামপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলার জন্য আসে। দূর্বাচারার বংশীতলায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশের কথা সমগ্র গ্রামে ছড়িয়ে পড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ে। শত্রু মোকাবিলায় প্রতিরোধ-প্রতিবাদে যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে নেমে পড়ে যুদ্ধ করতে। পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া পুলিশ বাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা শুরু করে। এ সময় ভাই চাঁদ আলী মুক্তিসেনাদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। কিন্তু হঠাত্ করে খুব কাছাকাছি স্থান থেকে হামলা হওয়ায় তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি সেনারা বেকায়দায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই একজন পাকিস্তানি সেনা এবং চারজন মিলিশিয়া পুলিশ নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভালো অবস্থানে থাকায় তাদের কেউ আহত বা শহীদ হয়নি। বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ স্থায়ী হয়।

যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে রাজাকারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর চলে যায়। তারা গ্রামের অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং আলামপুর গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে ধরে নিয়ে যায় বাবা মোবারক হোসেন ও ভাই চাঁদ আলীকে। জনসম্মুখে হাত-চোখ বেঁধে মারতে মারতে তাঁদের এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে যায় ভাদালিয়ার দিকে। এরপর তাঁদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর কয়েক দিন পর মায়ের আহাজারিতে ভাই মসলেম উদ্দিনকে নিয়ে ছুটে যাই ক্যাম্পের দিকে। মনে মনে ভাবি, বাবা ও ভাইদের জীবিত খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু লাশ যদি পাওয়া যায় সে আশায়।

এদিকে স্থানীয় রাজাকাররা পরিবারের কাছে তাগাদা দিতে থাকে, টাকা দিলে অন্তত তাঁকে প্রাণে মারা হবে না, বাঁচিয়ে রাখা হবে। তাদের কথা শুনে টাকা দিয়েও যখন জীবিত ফিরে পাওয়া যায়নি, তখন রাজাকারের কাছে লাশ ভিক্ষা চাওয়া হয়। কিন্তু তার পরও কোনো সন্ধান না পেয়ে অবশেষে একদিন দুপুরে ছুটে যাই ভাদালিয়া ক্যাম্পের কাছে। যখন ক্যাম্পের কাছে পৌঁছাই, তখন এর চারদিকে দেখতে পাই, কাউকে অর্ধেক পুঁতে রাখা হয়েছে, নিক্ষিপ্ত পাথরে নাক, মুখ, মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে আছে মৃত অবস্থায়। আবার কারও হাত-পা বেরিয়ে আছে, কারও পোশাক বেরিয়ে আছে। এরপর একে একে কয়েকটি লাশ তুলে হাঁপিয়ে উঠলাম। এরই মধ্যে মনে হলো, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের অবস্থানের কথা টের পেয়ে গেছে। হঠাত্ প্রাণভয়ে পালিয়ে এলাম। যদি সেদিন সব লাশ টেনে তুলতে পারতাম, তাহলে হয়তো বাবা-ভাইকে খুঁজে পেতাম। স্বজন হারানোর ব্যথা আমাকে আজও কাঁদায়।

অনুলিখন: তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া