বাবা নির্মলেন্দু বিশ্বাসের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা শুনেছি। ১৯৭১ সালে আমার ঠাকুরমার বয়স তখন ৪০ বছর। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তাঁর পরিবারকে রক্ষা করার জন্য পাশের একটি গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর গ্রামের ওপর আক্রমণ করল পাকিস্তানিরা। গ্রামের প্রতিটি ঘরই তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল এবং তাঁদের সবকিছু কেড়ে নিল রাজাকাররা। তখন আমার ঠাকুরমা এসব অত্যাচার দেখে আর সহ্য করতে না পেরে তাঁর পরিবার নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন।
আমার বড় জেঠাকে পাঠালেন তাঁর পুত্রবধূকে আনার জন্য। জেঠা যখন পথে বের হলেন, তখন পাকিস্তানিরা তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। তাঁর ওপর অত্যাচার করতে শুরু করল। কিন্তু তাঁকে তারা গুলি করল না। অনেক অনুরোধ করার পর তাঁকে ছেড়ে দিল। আমার ঠাকুরমা দিশেহারা হয়ে আর কোনো উপায় না পেয়ে ভারতের দিকে রওনা হলেন। কিছুক্ষণ পর আমার ঠাকুরমা দেখলেন, আমার জেঠা একা এবং তাঁর শরীর রক্তে ভেজা। ঠাকুরমা তাঁকে দেখে অনেক কান্নাকাটি করলেন।
ভারতে যাওয়ার নৌকাটা একটি ধানখেতের ভেতর রাখা। তখন ছিল গভীর রাত। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু জলের শব্দ। তাঁরা যখন নৌকায় উঠলেন, তখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বড় বড় নৌকা নিয়ে আক্রমণ করল। সবাই দৌড়ে পালালেন, কেউ কেউ পালাতে পারলেন না। তাঁরা জীবন বাঁচানোর জন্য কচুরিপানার ভেতর লুকিয়ে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর হানাদাররা কাউকে না পেয়ে চলে গেল। তখন তাঁরা আবার নৌকায় উঠলেন।
কিছুদিন পর তাঁরা ভারতে পৌঁছালেন। সেখানে দেখলেন তাঁদের মতো নিঃস্ব অনেকেই এসেছেন। তাঁরা সেখানে গিয়ে কিছু খাবার তৈরির জন্য সবকিছু গোছাতে লাগলেন। হঠাত্ অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। তখন তাঁরা একটি ঘরে আশ্রয় নিলেন। বৃষ্টি থামার পর বাইরে এসে দেখলেন একজন গর্ভবতী মহিলা বৃষ্টিতে ভিজে আর হাঁটতে পারছেন না। তাঁর সঙ্গে ছিল এক বৃদ্ধ মহিলা। কিছুদূর যাওয়ার পর ওই মহিলা একটি সুন্দর বাচ্চার জন্ম দিলেন। কিন্তু তখন সুন্দরের কোনো মূল্য নেই। বাচ্চাটি কাঁদতে লাগল। কিন্তু তার মা তাকে কিছুই দিতে পারলেন না। অবশেষে বাচ্চাটিকে একটি কলাগাছের ভেতর ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। ঠাকুরমা এসব দেখে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি কাঁদতে লাগলেন।
শুক্তা বিশ্বাস
শহীদ হেমায়েত উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়
শ্রেণী-নবম, রোল-৪, বাগেরহাট