বিজ্ঞাপন
default-image

আমার স্বামী সৈয়দ আবদুস সাত্তার পাকিস্তান আর্মির রিটায়ার্ড সুবেদার মেজর ছিলেন। ১৯৭১ সালে আমরা খালিশপুরে ছিলাম। শেখ সাহেবের ৭ মার্চের ভাষণ শুনেই আমার স্বামী এখানে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করলেন। সেই সংগ্রাম কমিটিতে এখানকার আওয়ামী লীগের নেতারাও ছিলেন। তিনি সংগ্রাম কমিটির বোধহয় চেয়ারম্যান ছিলেন। তারপর হাউজিংয়ের এক নম্বরে তিনি যুবক ছেলেপেলেদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করলেন সকাল-বিকেল। লাস্টের দিকে তিনি মুহসিন কলেজের মাঠে ট্রেনিং দিতেন। মানে যুদ্ধের যে ট্রেনিং দেয়, সে রকম ট্রেনিং দিতেন ছেলেপেলেদের। আর্মিদের মতোই ট্রেনিং। তখন এখানকার বিহারিরা মনে মনে তার ওপর খুব রাগ করে। বিহারিরা কানাঘুষা করত, বাঘী কাজটা ভালো করছে না। আমরা বাঘীরে ছাড়ব না। বিহারিরা আমার স্বামীকে বাঘী বলত। প্রতিরোধ যুদ্ধে আমিও স্বামীকে সহায়তা করি।

২৩ মার্চ এখানে বাংলাদেশের পতাকা ওঠানো হয়। তার আগে থেকে কালো পতাকাও ছিল। আমাদের বাসার ছাদেও বাংলাদেশের পতাকা ছিল। ঢাকায় আর্মি আক্রমণের কথা শুনে পরের দিন সকালবেলা সবাই পতাকা নামিয়ে নিয়ে আসছে। আমরা কিন্তু এ খবর জানি না। আমি সকালে বের হয়ে দেখি, পতাকা নেই একটাও। আমার স্বামী তখন ঘরে ছিলেন। আমি তাকে বললাম, বাইরে তো কোনো পতাকা নেই। তিনি বললেন, তাই নাকি! তার পর তিনি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হলেন খুব চিন্তিত অবস্থায়।

এপ্রিলের কথা। তখন চারদিকে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। আর্মি আর বিহারিরা খুলনায় প্রতিদিন মানুষ মারছে। তার পরও আমরা খালিশপুর ছেড়ে কোথাও যেতে পারলাম না। কারণ সে সময় আমার বাচ্চাদের পক্স হয়েছিল।

১০ কি ১১ এপ্রিল আমি রান্না করছি। বাচ্চাদের সবার পক্স তখন প্রায় সেরে উঠেছে। ওই টাইমে আমার বড় ছেলে গেটের সামনে গিয়ে দেখে, বাড়ির সামনে অনেক মিলিটারি। সেটা দেখে ও সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবারে বলছে, বাবা মিলিটারি। এটা শুনেই ওর বাবা বলছে, তাহলে মিলিটারিরা আমারে ধরতে আসছে। এ কথা বলেই সে পেছনের দিকে গিয়ে দেয়াল টপকিয়ে পেছনের এক বাসায় চলে যায়।

দেখলাম তিন গাড়ি আর্মি আর বিহারি। আর্মি পেছন দিক দিয়ে গিয়ে ঘেরাও দিয়ে ওই বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। এরপর আর্মি আর বিহারিরা তাকে ধরে ফেলে বিল্ডিংয়ের সামনের দিকে নিয়ে আসে। তখন তার পিঠ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। আমার বড় ছেলে তখন পায়খানার মধ্যে গিয়ে লুকিয়েছে।

ওকে ওরা পায়খানা থেকে ধরে নিয়ে এল। আমার বড় ছেলেরে বিহারিরা ধরে নিয়ে আসে। তখন আমি ওদের বললাম, বাবুল তো কিছু করেনি। ওর আব্বা না হয় ছেলেপেলেদের ট্রেনিং দিছে আর সংগ্রাম পরিষদ গঠন করছিল। এই বাচ্চা ছেলে কি করছে? সে তো পড়াশোনা করে। তখন আর এক বিহারি গুন্ডা, তার নাম আরেফিন, সে আমারে বলে কি! হাত ছাড়ো, না হলে তোমার সামনেই তোমার ছেলেকে গুলি করব। এ কথা বলে সে রাইফেলটা ওর দিকে তাক করছে।

আর্মিরা ওদের ধরে নিয়ে গেল। তারপর ওরা আর ফিরে আসেনি। তাদের কোনো সন্ধানও পাইনি বা লাশও পাওয়া যায়নি। আমার স্বামী এবং বড় ছেলে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত