বিজ্ঞাপন
default-image

যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর আবার আমরা বুক ফুলিয়ে দাঁড়াব। জাতি হিসেবে আরও একবার গর্ব করতে পারব, মাথাটা হবে আরও একটু উঁচু।

যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, দেশি বিচারক নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়, দেশি আইনজীবীদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়—সবই দেশি খাস বাঙালি, তখন চারদিকে হইহই-রইরই—এটা তো আন্তর্জাতিক হলো না।

হক কথা। সব কিছু দেশি, এমনকি আইনটাও দেশি আইন।

দেশের ভেতরের ‘গেল গেল’ রব কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুরা এখনো পুরোনো শোকে ডুকরে ডুকরে মাঝেমধ্যেই কেঁদে ওঠেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আন্তর্জাতিক হলো না, আন্তর্জাতিক হলো না চেঁচাক, কাঁদুক—কিছু যায়-আসে না। বিচার আমরা নিজেরাই করছি, নিজেরাই শেষ করব।

২.

দেশীয় আইনে দেশি বিচারক, আইনজীবী, তদন্ত কমিটি আর অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী যাঁরা, তাঁরাও আমাদের সহকর্মী। সবাই দেশি। এভাবে দেশীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার সাহস আগে অতীতে কেউ দেখায়নি। ন্যুরেমবার্গ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ অর্থাত্ কাম্পুচিয়া (কম্বোডিয়া)—সব যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিকতা ছিল। অর্থাত্, বিচারক, আইনজীবী, আইন—কোনো না কোনো ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা ছিল। আমরাই এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যতিক্রম। কারণ একটাই, আমাদের সাহস বেশি।

সাতই মার্চ ডাক এসেছিল—যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই দাঁড়াতে হবে। অবাক কাণ্ড হলো, বাঙালি লাঠিসোঁটা নিয়েই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তত্কালীন বিশ্বের বেশ আধুনিক সামরিক বাহিনীর সামনে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে মাত্র গোটা কতক দেশের আণবিক অস্ত্র আছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার অন্যতম। তখনো ফেলনা ছিল না, এখনো ফেলনা নয়, সামরিক শক্তি হিসেবে।

সেই বাহিনীকেই আজ থেকে ৪১ বছর আগে এই ষোলোই ডিসেম্বরে আমরাই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলাম। পুরো এক লাখ সেনা-অফিসারের একটা বিশালকায় বাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া গত ১০০ বছরে এক লাখ সেনা-অফিসারের কোনো সেনাবাহিনী এভাবে সদলবলে আত্মসমর্পণ করেনি। বন্দুক, ট্যাংক সবই তাদের ছিল। ওই সব নিয়েই পঁচিশে মার্চ রাতে আক্রমণ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হলগুলোর ওপর।

একটা বাহিনী কতটা বীভত্স হলে আধুনিকতম সমরাস্ত্র নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল আক্রমণ করতে পারে, তা ভাবতেই শিউরে উঠি। মার্চের শেষে শুধু লাঠিসোঁটা নিয়ে শুরু করা নয় মাসের মাথায় এক লাখ লোকের একটা আধুনিকতম সমরযন্ত্রকে আমরা বাধ্য করেছিলাম আত্মসমর্পণ করাতে। এত বড় যুদ্ধ জয় খুব কম জাতির সাফল্যগাথায় আছে।

হ্যাঁ, আমরা বড়াই করি না, বরং বেশির ভাগ সময় কাটাই নিজেরা নিজেদের খুঁত ধরতে, সমালোচনা করতে, গালমন্দ করতে।

যে যুদ্ধে ভীষণ ও নৃশংসতম যুদ্ধাপরাধ হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, হয়েছে যত বেশি, তত বেশি শক্তিশালী ছিল অপরাধকারীরা। আপনার সন্ত্রাসী দলের সদস্যসংখ্যা বা সন্ত্রাসী যদি হয় সব মিলিয়ে পাঁচজন, তাহলে কত বড়ই বা অপরাধ করবেন। কিন্তু অপরাধ করতে পারবেন অনেক বেশি, যদি আপনার থাকে ৫০০ জন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর মাস্তান, খুনি। সেই ৫০০ সদস্যের সন্ত্রাসী দলের ১০-২০-৩০ জনকে আটক করে বিচার করে শাস্তি দিলেও শঙ্কা থাকবে, ভয় থাকবে, বাকি তো অনেকগুলো বাইরে থেকে যাচ্ছে। তারা তো পুনর্গঠিত হয়ে আবার অপকর্ম করতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান সেনাবাহিনী যুদ্ধকালে লাখ লাখ নিরপরাধ শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং সর্বোপরি অসহায় বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল ইউরোপের অন্তত গোটা বিশেক দেশে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ডসহ গোটা বিশেক দেশের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে দেশগুলোকে দুর্বল করে নিয়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। নিজ দেশ জার্মানি আর দখলকৃত দেশগুলোতে নির্বিচারে যুদ্ধাপরাধ চালাল বছরের পর বছর।

শেষ পর্যন্ত সেই সেনাবাহিনী পরাজিত হলো। কিন্তু পরাজিত হলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তো নিমেষেই শেষ হয়ে যায়নি। অনেকটা ৫০০ লোকের সন্ত্রাসী বাহিনীর মতো। পাঁচজনের সন্ত্রাসী বাহিনীর তিনজনকে গ্রেপ্তার করেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে ওই বাহিনী আর তেমন কিছু করতে পারবে না; কিন্তু ৫০০ জনের বাহিনীর ৩০ জনকে আইনি প্রক্রিয়ায় কাবু করলেও বাহিনী কিন্তু সক্রিয় থেকেও যেতে পারে। ৫০০ জনের বাহিনীর টপ ফাইভ লিডারকে ধরে জেলে পুরলেও বাহিনীটি আবার অপরাধকর্মে সক্রিয় হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?

যুদ্ধাপরাধের বিচারটা অনেকটা ৫০০ সন্ত্রাসী দলের বিচার করার মতো। জার্মানির নািস বাহিনী যুদ্ধে হেরে গেলেও তারা তো রাতারাতি উবে যায়নি। কাম্পুচিয়া বা তত্কালীন কম্বোডিয়ার পলপত বাহিনী চার বছরে প্রায় ২০ লাখ লোক মেরে ফেলেছিল। পলপতের পার্টির সমর্থক ছিল চীন। যে দল-বাহিনী ২০ লাখ লোক মারতে পারে, তারা তো উবে যায়নি, হাওয়া হয়ে যায়নি। ৩০ বছর পর সেখানে এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে। কারণ, সে দেশের নেতারা এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জড়িত না করে, সঙ্গে না নিয়ে পলপতের অনুসারীদের বিচার করতে সাহস করতে পারছে না। তাই বিচারটা হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক’।

এক যুগ আগে কয়েক সপ্তাহের একটা কাজে কাম্পুচিয়ায় গিয়েছিলাম। তখনো পলপতের দলের কিছু লোক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। আমাদের নিজামী-মুজাহিদের মন্ত্রী হওয়ার মতো।

মোদ্দা কথা, যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধীদের বিচার চাট্টিখানি কথা নয়। অত্যন্ত বিপত্সংকুল বিচার। যুদ্ধাপরাধীরা পরাজিত হলেও শক্তি হারায় না, রাজনৈতিক প্রভাব হারায় না। আর যারা লিপ্ত ছিল জঘন্যতম অপরাধে, তারা নিজেদের বাঁচাতে যেকোনো অপরাধই আবার করতে পারে।

আর যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে যেকোনো অপরাধ-অপকর্ম করতে পারে—এই শঙ্কা থেকেই এ ধরনের বিচারগুলো ‘আন্তর্জাতিক’ভাবে হয়েছে। অর্থাত্, এসব বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রথম থেকে সম্পৃক্ত থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের সম্ভাব্য অপরাধ-অপকর্ম মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, হবে সহজতর।

৩.

যুদ্ধাপরাধের বিচার এসব কারণে ‘আন্তর্জাতিক’ভাবে হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ‘অভ্যস্ত’ হয়ে পড়েছিল সাহায্য করতে। কিন্তু আমরাই প্রথম যারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য না নিয়েই বিচার করছি, এতে আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা রুষ্ট হবে, সেটাও স্বাভাবিক।

অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য না নেওয়ার ফলে এখন বিপদ মোকাবিলায় বেগ পেতে হচ্ছে তা স্পষ্ট। যুদ্ধাপরাধী যারা লাখ লাখ মানুষ মেরে হাত পাকিয়েছে, তারা নিজেদের বাঁচাতে কোনো কিছু করতেই পিছপা হবে না।

‘স্কাইপ’ এর নিদর্শন। সরকার বা সরকারি দল ভুল করছে এই ভেবে যে ‘তারা’ এই বিচার করছে। এই বিচার তারা করছে না, যারা সরকারে নেই, যারা সরকারি দল করে না তারাই এই বিচারের সাহস জোগাচ্ছে, তাদের সমর্থনই এই বিচারপ্রক্রিয়াকে নিয়ে যাবে সুষ্ঠু সমাধানে।

যুদ্ধাপরাধীদের সব বাধা, সব অপকর্ম, সব অপরাধ কাটিয়ে এই বিচার যখন শেষ হবে, তখন আমরা সারা বিশ্বকে আবার দেখিয়ে দেব যে আমরা যেমন শুধু লাঠিসোঁটা আর গাদাবন্দুক দিয়ে শুরু করে কয়েক মাসেই এই বিজয়ের দিনে দুনিয়ার আধুনিকতম সেনাবাহিনীর এক লাখ লোককে আত্মসমর্পণ করিয়ে যুদ্ধ জিতেছি, তেমনি সব বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বব্যাপী অপরাধী চক্রকে পরাস্ত করে এই বিচার আমরা নিজেরাই শেষ করতে পেরেছি।

রাজনীতির শত-সহস্র কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও বিচার শেষ হবেই। বিচার শেষ করে আবার ষোলোই ডিসেম্বরের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়াব। দেশটা তখন দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে যাবে।

ধর্মকে নিয়ে যারা ব্যবসায় লিপ্ত, ধর্মকে যারা লোক ঠকানোর কূটকৌশল মনে করে, ‘রাজনীতি’র নামে আর যারা লাখ লাখ নিরপরাধ নিরীহ মানুষের হত্যার জন্য দায়ী, বিচার হয়ে গেলেও তারা আর দেশটাকে পেছনে ঠেলে দিতে পারবে না।

এই বিজয়ের দিনে আমরা সবাই নিজেদের আবার মনে করিয়ে দিই যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পাশে দাঁড়িয়ে লাখো শহীদের হত্যার দায়ভার কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ নিতে পারে না, নেবে না।

যত দিন আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করব, তত দিন যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণা করব। তাদের পক্ষ নেব না।

এ দেশ আমার দল, স্বাধীনতা আমার নেতা।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত