বিজ্ঞাপন
default-image

আমার বন্ধু ময়নার সঙ্গে দেখা হলে দশটা যদি কথা হয়, অন্তত একটা হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। হবেই–বা না কেন? নাটক করতে শহর ছেড়ে বেরিয়েছিল, তার মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হলো, ময়নার আর ঘরে ফেরা হলো না। সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাল। বাকিটা ইতিহাস। তার লেখা তিনটি বইয়ে আছে। যদি জানতে চান, বইগুলো জোগাড় করে পড়তে পারেন। আমার গল্প যেহেতু অন্য মানুষজন নিয়ে, ময়না আছে শুধু মূল কথকের ভূমিকায়, তাই তার যুদ্ধজীবন নিয়ে জানাশোনাটা জরুরি নয়।

ময়নাকে বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের গল্পের খোঁজে আছি। একটা গল্প দাও। বিজয় দিবস আসছে। বিজয় দিবসে খবরের কাগজগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প বেরোয়। আমাকেও একটা লিখতে হবে।

ময়না বিরক্ত হলো। বিরক্ত হলে সে কথা কমিয়ে দেয়। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম, গল্পটা তাহলে শোনা হবে না। বললাম, চর্চাটা ভালো, বছরের একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধের খোঁজে অন্তত আমরা নামি।

মুক্তিযুদ্ধকে আমরা একটা পার্বণিক উদ্‌যাপনে ফেলে দিয়েছি, ময়না বলল। যারা পাকিস্তানিদের হয়ে মানুষ মেরেছে, তাদের অনেকে এখন গিরগিটি হয়ে গেছে। এই গিরগিটিগুলোও গলায় বেদনা ঢেলে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে। বিজয় দিবসের ধারে-কাছ দিয়ে।

আমার চুপ করে যাওয়া ছাড়া আর কী উপায়?

ময়না বলল, গল্প নয়, তোমাকে একটা অগল্প দিই। অগল্প মানে এতে গল্পের আগামাথা নেই, পোশাকি বাহার নেই। গল্প তো একটা ঘোষণা, তা–ই না? ঘোষণাটা এই: আমাকে লেখা হয়েছে, আমার গায়ে রঙিন পোশাক, আমার মুখে যত্নের প্রসাধন। অতএব আমাকে দেখুন, মানে পড়ুন। আমি যে গল্প বলব, তাতে কোনো বাহারি বেশবাস নেই, প্রসাধন নেই। এটি তোমার মনে ধরতে না-ও পারে। তুমি একে অগল্প বলতে পারো। তবে একাত্তরে এই অগল্পগুলোই আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গল্পটির নকশিকাঁথা বুনেছে।

ময়নার বিরক্তি গেছে। সে এখন নাটকের মানুষের মতো কথা বলছে। তার মানে গল্পটা পাচ্ছি।

সুনামগঞ্জের একটা বড় জায়গা ঘিরে আমাদের কাজকর্ম ছিল, ময়না বলল, যার মধ্যে রামপাশাও ছিল।

আমি চমকে উঠলাম। রামপাশা? হাসন রাজার রামপাশা?

জি, সে বলল। গল্পটাতে হাসন রাজাও আছেন। বলতে পারো উনি থাকার জন্য গল্পটা ঠিক গল্প হয়নি। বাস্তবের গল্পে আজগুবি ঢুকে গেলে গল্প তো মূল ভূমি হারিয়ে ফেলে, কী বলো?

আজগুবি?

আজগুবি না তো কী! একাত্তরে রামপাশা-লক্ষ্মণশ্রীর মানুষ আমাকে বলত, চাঁদনি রাতে দেখার হাওরে হাসনের নাও দেখা যায়। আমাদের শাকুর মজিদ এই আজগুবি নাও দেখা নিয়ে একটা নাটকই লিখে ফেলেছে। নাটকটা নিয়ে আমার যদিও দু-একটা পর্যবেক্ষণ আছে...

ময়নাকে থামাতে হবে। এরপর সে শাকুরের নাটক নিয়ে আমাদের দশ কথার সাত কথাই খরচ করে ফেলবে। আমি বললাম, কথাটা আমাকেও সুনামগঞ্জের কেউ কেউ বলেছে।

মানুষের মাথা থেকে আজগুবি চিন্তা কিছুতেই যাবে না, তাই না?—ময়না অনুযোগের সুরে বলল। এই যেমন মোহন মিয়া, তার স্থির ধারণা, সে হাসন রাজাকে দেখেছে। একবার না, দুবার। হাসন রাজা তাকে বলছেন, মানুষ হয়ে মানুষ খুন করা ঠিক না। এটা আল্লাহপাক সহ্য করেন না।

মোহন মিয়াটা কে?

মোহন মিয়ার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। আমার ধারণা অটিস্টিক ছিল, মৃদু হলেও। তা না হলে আলতাবকে নাগালে পেয়েও কেন সে মারল না? আলতাবকেও অবশ্য পরে মরতে হলো, তারও নিশ্চয় বুদ্ধিসুদ্ধি কম ছিল।

আলতাবটা কে?

মোহনের মায়ের সঙ্গে যুদ্ধের দিনে আমার দেখা হয়নি, হয়েছে পরে। তিনি মোহনের গল্পটা বলেছিলেন, ভালো গল্প। কিন্তু হাসন রাজা ঢুকে পড়ে তাকে অগল্প করে দিলেন।

ময়না নিশ্চয় জনৈক মোহনের গল্প নিয়ে একটা নাটক করতে চেয়েছিল। না পেরে উল্টাপাল্টা বলছে।

রামপাশায় প্রচুর জঙ্গল, ময়না বলল, তখন ছিল, এখন অবশ্য নেই। আলতাবের সঙ্গে মোহনের দেখা হয়েছিল একটা জঙ্গলে, মানে গাছপালা–ঘন একটা জায়গায়। মোহন জঙ্গলে ঢুকে কাঠ কাটত, লাকড়ির কাঠ। ওই কাঠ না হলে তার মা রান্না চড়াতে পারেন না। আগে তিনি একাই যেতেন, জঙ্গল থেকে লাকড়ি জোগাড় করতেন, কিন্তু আলতাবদের মতো ছেলেরা বন্দুক হাতে ঘোরাঘুরি শুরু করলে তিনি যাওয়া বন্ধ করলেন। মোহন মিয়া ছিল আবার মহা মা–ভক্ত। সে লাকড়ি জোগাড়ের দায়িত্ব নিল।

সামান্য কাজ, ঘণ্টাখানেকের পরিশ্রম। কিন্তু ওই ঘণ্টাখানেকের কাজের জন্যও সে গামছায় মুড়ি আর গুড় বেঁধে নিয়ে যেত। মুড়ি ছিল তার প্রিয় খাবার, মুড়ি খেত ভাতের মতো...

মুড়ি যা, ভাতও তা। দুটোই চাল থেকে হয়, আমি বললাম।

ময়না আমার দিকে কড়া চোখে তাকাল। যেন সে ম্যাজিস্ট্রেট, আমি হাসন। আমাকে এরপর সে আঠারো মাসের জেল দেবে।

দিনটা ছিল গরম, ময়না বলল। কাঠ কাটতে বেশ পরিশ্রম হলো ময়নার। সে ভাবল, একটু জিরিয়ে নেবে। মুড়িও খাবে। একটা গাছের নিচে সে বসল। গরম হলেও ঝিরিঝিরি একটা বাতাস দিচ্ছিল। কয়েকটা প্রজাপতি তার চুল স্পর্শ করেই ওড়াওড়ি করছিল। মুড়ি খেতে খেতে প্রজাপতিদের দেখছিল সে। আর বলছিল, তোরা কেন মুড়ি খাস না? দু-একটা তো তোদের দিতে পারতাম।

পাখি-পতঙ্গের জন্য মোহনের দয়ামায়াটা সে পেয়েছিল মায়ের কাছ থেকে। মা তাকে অবশ্য শিখিয়েছিলেন, সাপ কাটতে এলে কীভাবে, কত তাড়াতাড়ি দাটা চালাতে হবে। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে মোহনটা ছিল ছোট। তার জন্য মায়ের মায়াটা একটু বেশি ছিল।

default-image

প্রজাপতি দেখতে দেখতে, মুড়ি খেতে খেতে, মোহনের মনে হলো একটা বড় সাপ যেন কোথাও সরসর করছে। সে দাটা হাতে নিয়ে তাকাল। না, সাপ না। অন্য কিছু। একটা সাদার আভাস দেখা গেল। একটা সাদা গেঞ্জি যে আভাস দেয়। সাদা দেখে মোহনের কেন জানি মনে হলো হাসন রাজা। এই জঙ্গলেই হাসনকে কনাই মিয়া দেখেছে, মানুষের কাছে সে রকমই দাবি সে করেছে। তাঁর গায়ে সে একটা সাদা আলখাল্লা দেখেছে।

কথাটা সত্য নয়, মোহন জানে। হাসনকে দেখা যায় নৌকায়, দেখার হাওরে, পূর্ণিমায়। দুবার সে তাঁকে দেখেছে। একবার হাসন গাইছিলেন, প্রেম বিনা মানুষ অমানুষ হয়। অথবা এ রকম কিছু।

হাসনের কথাটা মোহনকে কিছুটা যেন আনমনা করে দিল। আনমনা ভাবটা কাটলও তাড়াতাড়ি। সে দেখল, পেছন থেকে একটা বন্দুকের নল তার মাথার ওপর দিয়ে সামনে এসে স্থির হলো। বন্দুকটা আলতাবের। আলতাবের গলা শোনা গেল। ওরে মোহন, তোমার দিন শেষ।

মোহন আলুথালু তাকাল।

তোমাকে ধরে নেওয়ার আদেশ আছে। আদেশ জসিম মেম্বারের। এখন চলো।

আলতাব বন্দুকটা ধরে আছে, কিন্তু সেই ধরাটাতে কোনো টেনশন নেই। সে জানে মোহন বোকাসোকা। বন্দুক দেখেই ভয় পাবে। একই বয়সের তারা, মোহনকে সে যদিও একটু করুণার চোখেই দেখে।

কিন্তু মোহন আলতাবের হাতের বন্দুকটাকে সাপ দেখেছে। বন্দুক না, যেন একটা সাপ ধরে রেখেছে আলতাব। তার হাতের দাটা হঠাৎ প্রাণ পেল। বিদ্যুতের গতি পেল। সাপের শরীরের মাঝ বরাবর কোপ পড়ল।

পুরোনো বন্দুক। কাঠের হাতলটা দুর্বল হয়ে গেছে। রামপাশার ভেজা বাতাস সেগুন কাঠকেও এক মৌসুমে কেন, এক মাসেই যৌবনহারা করে। ফলে আলতাবের হাতে ধরা বন্দুকের হাতলটা প্রায় দুই ভাগ হয়ে নলটাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। একটা লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠল মোহন। দায়ের মতো ক্ষিপ্রতায় আলতাবের পেছনে দিয়ে দাঁড়াল। বলল, আল্লাহর নাম নাও।

ভয়ে আলতাবের হাত থেকে প্রায়-দ্বিখণ্ডিত বন্দুকটা পড়েই গেল। তার পা থেকে শক্তি সরে গেল। পা গেড়ে সে মাটিতে বসল।

আলতাবের ভয়ের দুইটা কারণ, ময়না বলল। এক. মোহনের হাতের দা। সপ্তায় এক দিন সেই দায়ে সে শান দেয়, পাথরে ঘষে। অটিস্টিক হোক আর যা-ই হোক, এদিকে তার বিশেষ দক্ষতা।

অটিস্টিকরা আসলে ভিন্নভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত, আমি বললাম, এদের কথা বলার সময় বিষয়টা মাথায় রাখবে।

মাথায় রেখেই তো বলছি, ময়না বলল। মোহন অটিস্টিক না হয়ে তোমাদের মতো তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষ হলে আলতাবকে দায়ের এক কোপেই মেরে ফেলত। কিন্তু আমাদের মোহন, যাহোক... ও, আলতাবের ভয়ের দ্বিতীয় কারণটা বলা হয়নি। সেটা হলো বন্দুকটা নুলো হয়ে যাওয়া। তাকে এটা দেওয়ার সময় জসিম মেম্বার বলেছিল, এই বন্দুক তাকে দিয়েছে ক্যাপ্টেন সাহেব। পাঠান ক্যাপ্টেন সাহেব। এটা যেন সে ঠিকঠাক রাখে। আলতাবের চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভাসল এবং সেটি জসিম মেম্বারের কুপিত মুখের। তার বেজির মতো চোখের। সে শিউরে উঠল।

মোহন বন্দুকটা নিয়ে একটা দৌড় দিল। জঙ্গলের একটা দিকে একটা জলা। কচুরিপানায় ঠাসা। সেই জলায় বন্দুকটা সে বিসর্জন দিল। দিয়ে, মুখে হাসি মেখে ফিরে এসে দেখল আলতাব দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে।

আলতাব, খুব আস্তে করে বলল মোহন, একটু মুড়ি খাও। গামছা থেকে একমুঠো মুড়ি নিয়ে সে আলতাবকে দিল। এক টুকরা গুড়ও। খাও, সে আবার বলল।

মোহনের হাত থেকে আলতাব মুড়ি নিল, কিন্তু হাতে ধরা মুড়ির দিকে কিছুক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে থাকল। তার পলকহীন চোখ দুটি বুঝল, এ–ই তার জীবনের শেষ মুড়ি খাওয়া। তার মুখে কেন জানি একটু হাসি ফুটল। আজগুবি হাসি। এ হাসির কোনো অর্থ হয় না। এ রকম হাসি একটা গল্পকে অগল্প করে দিতে পারে। তারপর সে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে বসল; এবং মুখে কিছু মুড়ি ফেলল। তারপর গুড়ে একটা কামড় দিল। মোহনও তা-ই করল। এবার মোহন হাসল। তোমার কল্লাটা আমি কাটতে পারতাম আলতাব, কিন্তু কাটলাম না হাসনের দায়।

আচ্ছা?

হাসন এক রাতে গেয়ে বলেছেন, মানুষের জান নেওয়া আল্লাহপাক পছন্দ করেন না।

হাসনকে দেখতে হলে এক শ পূর্ণিমা রাত দেখার হাওরে কাটাতে হয়। তুমি কি এক শ রাত কাটিয়েছ? আলতাব জিজ্ঞেস করল।

না, আমি তিন রাতেই তাঁর দেখা পেয়েছি। তিন রাতে একবার, পরের দুই রাতে একবার। মোট দুইবার।

তুমি ভাগ্যবান, আলতাব বলল।

জসিম মেম্বার আমাকে ধরে নিতে কেন বলেছে? মোহন জানতে চাইল।

তোমাকে বলে লাভ নেই, তুমি বুঝবে না, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তোমার মা বুঝবেন।

জসিম মেম্বার আমাদের জমির দখল চায় আলতাব, আমি জানি, মা বলেছেন। আমার বাবা নেই, কিন্তু জমি আছে এগারো কিয়ার। এগারো কিয়ার জমি পাঁচটা শত্রু বানাতে পারে।

আলতাব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর নিচু স্বরে বলল—যেন সে মোহনকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে—হাসনের সঙ্গে আমার দেখা হলে জানতে চাইতাম, জমি কেন মানুষকে শত্রু বানায়?

কথাটা শুনে মোহন বেশ আমোদ পেল। সে হাসল। তোমরা কেন মানুষ মারো? সে আলতাবকে জিজ্ঞেস করল।

মানুষ মারি না, ইসলামের দুশমন মারি, গাদ্দার মারি। তবে আমি না। মানুষ মারব কি, রক্ত দেখলেই আমার ভয় লাগে। কিন্তু এ বন্দুক হাতে নিলে কেন জানি আমার কলিজায় জোর আসে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

তোমার জন্য খবর আছে আলতাব, মোহন বলল।

তা আছে, আলতাব বলল। তার গলাটা বিষণ্ন শোনাল।

তাইলে মুড়ি খাও। শেষ করে ফেলো। গুড়টাও। আমি লাকড়ি নিয়ে বাড়ি যাব। আমি গেলে মা রান্না করবেন।

ঠিক আছে, আলতাব বলল, এবং গাছের সঙ্গে গা ঠেস দিয়ে মুড়ি খেতে থাকল। অল্প অল্প করে, অনেকক্ষণ ধরে। যেন মুড়ি খাওয়া শেষ হলে আজরাইল ফেরেশতার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে। আলতাবের চোখের সামনে তার মায়ের মুখটা ভেসে উঠল। কত দিন মাকে দেখে না! বারো দিন তো হবেই। ফৈয়াজ মুন্সি তাকে জসিম মেম্বারের কাছে নিয়ে এসেছে। এখন মেম্বারের বাড়িতে সে থাকে। মেম্বারের নাম শুনে মা ভয় পেয়েছেন। বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার আগে মা তার চুলে হাত বুলিয়েছেন, তারপর একটা দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে বলেছেন, ফি আমানিল্লাহ।

তার বাবা থেকেও নেই। গাছ থেকে পড়ে পিঠ ভেঙেছেন, এখন দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকেন। গা হাত পা শুকিয়ে কাকলাস। বাবার কথা মনে পড়ে তার কান্না এল।

দড়ি দিয়ে লাকড়িগুলো বেঁধে গাট্টিটা কোলে নিয়ে মোহনও বসে থাকল। তার কেন জানি মনে হতে থাকল, জঙ্গলে একটা ছায়া অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছে। সে আলতাবকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হয় হাসন এই উজানিবেলায় এই জঙ্গলে দেখা দেবেন?

ধুর পাগল, আলতাব বলল। হাসন আসেন চান্নি রাতে।

যে ছায়াটাকে আশপাশে টের পাচ্ছিল মোহন, ময়না বলল, তা ছিল সিল্লু মিয়ার, জসিম মেম্বারের আসল লোক, মেইন ম্যান। নয়জনের একটা দলের প্রধান। সে যে মোহন-আলতাব দুজনকেই ধরে নিয়ে গেল, তার কারণ ওই হাসন। হাসনের গল্প বলতে বলতে দুজন কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল, সময়টা খেয়াল ছিল না, মোহনের দা-ও বিশ্রামে গিয়েছিল। মোহনের মা আমাকে বলেছিলেন, লাকড়িগুলো সে এক ঘণ্টা আগেই কেটেছিল। কেন তারপরও এতক্ষণ সে বসে ছিল, আলতাবের মতো একটা বাজে ছেলের সঙ্গে গল্প করছিল, যেন তারা কত দিনের বন্ধু, তা-ও তিনি বুঝতে পারেননি। ময়না বলল, সিল্লু যখন আলতাবকে নিয়ে যায়, তার হাতে কয়েক দানা মুড়ি অবশিষ্ট ছিল। একটুখানি গুড়ও। আধা ছটাক মুড়ি খেতে দুজনের এতক্ষণ লাগে?

এই গল্পে হাসন না ঢুকলে এটা গল্প হতো, ময়না বলল। এর শেষটা আগে থেকে বলে দেওয়া যেত না। অথচ এখন তো শেষটা তুমিই বলে দিতে পার।

আমি আর কী বলি! ময়না বলল, মোহনের মাকে ডেকে ছেলের লাশ বুঝিয়ে দিয়ে জসিম মেম্বার বলেছিল, একে কোথাও পুঁতে জিনিসপত্র সব বাঁধো। তারপর রামপাশা ছাড়ো। ইন্ডিয়া যাও। আগে বলেছিলাম, শোনো নাই। এখন শুনবে। সাত দিন সময় দিলাম। মোহনের মাকে আলতাবের লাশটাও সে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিল্লু মিয়াই তাকে তার বাড়ি নিয়ে গোর দিয়েছিল।

অবাক কাণ্ড, জলাটায় তিনজন মানুষ নামিয়েও বন্দুকটা আর পায়নি জসিম। মোহনের মা জানতে চাননি, তারপরও তাকে বলেছিল জসিম মেম্বার, দেশটা এখন বিপদে। ইসলাম বিপদে। এখন একটা বন্দুকের দাম দশটা আলতাবের থেকে বেশি।

ময়না গল্পটা শেষ করল। বলল, এটা পছন্দ না হলে আরেকটা বলব। আগামীকাল।

আগামীকাল তো আমি ঢাকা ফিরব, কাতর কণ্ঠে বললাম।

তাহলে ফেরো, ময়না বলল। গল্প তোমার সঙ্গে ঢাকা যাবে না।

ঠিক আছে, আমি ভাবলাম, বিজয় দিবসের কিছু দেরি আছে। এর মধ্যে আরেক দিন আসব।

ময়নার চোখ বন্ধ। সে মাঝেমধ্যে বসে বসেই ঘুমায়। তাকে বিরক্ত করব কি না ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, মোহনের মা কি তারপর ইন্ডিয়া চলে গেলেন?

ময়না চোখ খুলল। অবাক কাণ্ড, সে বলল, এক সকালে মোহনের মা দেখলেন মোহনের দাটা তার ঘরের দাওয়ায় ঠেস দেওয়া। তিনি ভেবেছিলেন সিল্লু মিয়া মোহনকে যখন নিয়ে যায়, তার দাটাও তুলে নিয়ে যায়। তাহলে এটা কোথা থেকে এল? চকচকে, শান দেওয়া দা। তার খেয়াল হলো, মোহন সাত দিন আগেও দাটা শান দিয়েছিল, সাত দিনে এক দিন যেমন দিত। তিনি আস্তে দাটা তুলে নিলেন। তারপর তাতে একটা চুমু দিলেন। যেন ছেলের হাতে চুমু দিচ্ছেন। ছেলের হাতের স্পর্শটা, গন্ধটা, উত্তাপটা এখনো লেগে আছে দাটাতে।

উজানিবেলায় মুনশি আর সিল্লু মিয়া আসবে বাড়ির দখল নিতে, মোহনের মা বললেন দাটাকে। তা হতে দেওয়া কি ঠিক হবে?

ময়না থামল। তার মুখে একটা হাসি। যেন সে একটা মধুর নাটকের মহড়া দিয়ে তৃপ্ত।

তারপর? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সুনামগঞ্জ অপারেশন নিয়ে আমার লেখা বইটিতে ‘তারপর’টা লেখা আছে। বইটা তোমাকে দিয়েছি, পড়ে নিয়ো, ময়না বলল। এখন যাই, রাত অনেক হলো। জানালা দিয়ে চাঁদটাকে দেখো, খামোখাই কী যে আলো ফোটাচ্ছে!

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসািহত্যিক।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত