বিজ্ঞাপন
default-image

স্বাধীনতার কত বছর পার হলো সে হিসাব সুরবালা রাখতে জানে। কিন্তু গাঁয়ের লোকে ওকে পাগলি সুরু বলে ডাকে। বলে, পাগলি ভাত খাবি?

ও কখনো বিষণ্ন উদাস হয়ে থাকে। কখনো চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলে, ভাত দিবি? দে। ভাত খাবো।

কেউ কেউ ওকে মাঝে-মধ্যে ডেকে ভাত দেয়। কখনো গাঁয়ের বাজারে বসে থাকলে এক টুকরো জিলাপি বা সিঙ্গাড়া পায়। মনের আনন্দে খায়। খেতে ওর ভালো লাগে। খেয়েদেয়ে গুনগুন করে। তারপর শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলে, আজ শনিবার। শ্রাবণ মাস।

সুরবালা এভাবে কথা বলে একটি সময়কে নিজের চিন্তায় গাঁথে। ওর সময়ের টুকরো অনেক এবং একটির সঙ্গে অন্যটির অদৃশ্য গিঁট আছে। একেকটি মুহূর্ত কখনো কোনো অবসরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আবার স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তখন সুরবালা খলখল হাসিতে চারদিক ভরিয়ে দিয়ে বলে, ভাত দে।

সেই সময়ে পাশে কেউ থাকলে এবং ভাত চাইতে শুনলে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, খানকিটা একটা ডাইনি।

কেউ বলে, মাগিটা পেত্নি। মরেও না।

কখনো কোনো কিশোরী আস্তে করে বলে, তোমাকে একটা কাকের মতো লাগছে।

ও চোখ বড় করে বলে, তা হলে আমি উড়ে যাই?

কিশোরী অবলীলায় সায় দিয়ে বলে, যাও।

বিষণ্ন হয়ে যায় সুরবালার চেহারা। আস্তে করে বলে, কোথায় যাব?

কিশোরী আঙুল তুলে দূরের দিকে দেখিয়ে বলে, যেখানে খুশি সেখানে যাও। যেখানে কেউ তোমাকে চেনে না। কেউ জানে না যে, যুদ্ধের সময় তুমি পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বাঙ্কারে ছিলে।

বাঙ্কার! খিলখিল করে হাসে সুরবালা। হাসতে হাসতে বলে, ওখানে বসেই তো আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছি। ওটাই আমার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। ওদের মুখে আঁচড় দিতাম। থুতু দিতাম। তারপর ওরা আমাকে ব্লেড দিয়ে কাটত। দেখো আমার শরীরে কত লম্বা লম্বা কাটা দাগ। এই রক্তের নদী দিয়েছি বলেই তো দেশ স্বাধীন হয়েছে।

থুঃ, তোমার হাসিমুখ দেখলে আমার রাগ হয়। তুমি এতক্ষণ ধরে হাসবে না।

হাসব হাসব—যতক্ষণ আয়ু আছে ততক্ষণই হাসব। হাসতে হাসতে সুরবালা খেতে থাকে। যেদিকে খুশি সেদিকে যায়, যেখানে খুশি সেখানে ঘুমায়। ওর হাতে একটি আখের টুকরো। মনের সুখে ও আখ চিবুচ্ছে। পেছন থেকে মেয়েটি দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে বলে, সুরু পাগলি তুমি আমাদের বাড়িতে চল। ও আখের ছিবড়া মুখ থেকে ফেলে এক ঝটকায় মেয়েটির হাত সরিয়ে দেয়।

মেয়েটি ব্যাকুলকণ্ঠে বলে, আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই খালামণি। মাকে গিয়ে বলব, দেখ একজন যুদ্ধ করা মানুষকে ধরে এনেছি। খালামণিকে ভাত খেতে দাও। যাবেন আপনি?

সুরবালার বিস্মৃত জীবন চারপাশে ধ্বনিত হতে থাকে। ও ঘাড় নাড়ে। মুখে কিছু বলে না। মেয়েটি ওর সম্মতি পেয়ে হাত ধরে আবার। জিজ্ঞেস করে, আপনি কী দিয়ে ভাত খাবেন?

সুরবালা হাতে ধরা আখের টুকরা দূরে ফেলে দিয়ে বলে, খাসির মাংস।

মেয়েটি ভুরু কুঁচকায়। ও জানে, বাড়িতে খাসির মাংস নেই। জিজ্ঞেস করে, ইলিশ মাছ খেতে আপনার ভালো লাগে না?

সুরবালা আবার ঘাড় কাত করে।

মেয়েটি সুরবালাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনি আর আমি ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাব। মাসি আমি এক লোকমা ভাত আপনার মুখে তুলে দেব।

ধুত্তুরি, নিকুচি বলে সুরবালা রাগ প্রকাশ করে। মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে মেঠোপথে এগিয়ে যায়। শনশন বাতাসের শব্দে ঘূর্ণিঝড় ওঠে। ও বিড়বিড় করে বলে, এখন বৈশাখ। বৈশাখের পঁচিশ তারিখে সেনাগুলো এসেছিল। গ্রাম পুড়িয়ে দিল। আমি ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম।

তখন কিশোরী মেয়েটি ছুটে এসে ওর আড়ালে দাঁড়ায়। চারদিকে ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তার ঘটে। ধুলোয় ভরে যায় প্রান্তর। সুরবালা বিড়বিড় করে বলে, বৈশাখ কঠিন মাস। রোদ-আগুন। আগুন-আগুন। দাউদাউ আগুন জ্বলে। সুরবালা ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে। বাতাসের ধাক্কায় নিজেদের সামলানোর জন্য দুজনে গাছের কাণ্ড জড়িয়ে ধরে রাখে। সুরবালা জোরে জোরে বলতে থাকে, বৈশাখ-বৈশাখ। ঝড় ছিল না। আকাশে মেঘ ছিল না। ঝড় উঠেছিল ওর জীবনে। ওকে চ্যাংদোলা করে জিপে উঠিয়েছিল সৈনিকগুলো। ও লাথি দিয়েছিল একজনের পিঠে। ওরা ওকে রাইফেল দিয়ে চেপে রেখেছিল। ও থুতু ছিটিয়েছিল। ওর মুখটা বুট দিয়ে চেপে রেখেছিল। ওহ্ বৈশাখ, বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ!

দিনটি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরবালার শরীরে গুড়গুড় শব্দ হয়। শব্দ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর মনে হয়, পতাকার মতো উড়ছে ওর শাড়ির আঁচল। বাতাসের প্রবল ঝাপটা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় ওকে। কালবৈশাখী ঝড় ধুলোয় ভরে ফেলেছে চারদিক। ঘূর্ণির সঙ্গে উড়ছে শুকনো পাতা। জমা হচ্ছে ওদের পায়ের কাছে। বাতাসের ধাক্কায় সুরবালার কপাল ঠুঁকে যায় গাছের কাণ্ডে। গাছ আঁকড়ে ধরলে মাথাটা ঘুরে ঘুরে ঠুকতে থাকে কাণ্ডের সঙ্গে। মেয়েটি সুরবালার রক্তাক্ত মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে বলতে থাকে, মাসি-মাসি-মাসিগো। মেয়েটি দেখতে পায়, সুরবালার শাড়ি খুলে যাচ্ছে। কোমরের সঙ্গে হালকা গিঁট দিয়ে আটকে রাখা শাড়িটি যেকোনো ঝাপটায় খুলে যাবে। মেয়েটি বুঝতে পারে না, ও কী করবে। চেঁচিয়ে বলে, মাসি তুমি ন্যাংটো হয়ে যাচ্ছ। মাসিগো—। মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে।

সুরবালার মনে হয়, চারদিক অন্ধকার। ও একটি শক্ত বাঙ্কারে শুয়ে আছে। সৈনিকটার সামনে নিজের সবুজ রঙের শাড়ির আঁচল মেলে দিয়ে বলছে, ইয়ে মেরি আজাদিকে পরচম হ্যায়। আহ, ওদের ভাষায় কথা বলতে শিখেছে। ওদের কাছ থেকে শুনে শুনে। কিন্তু কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড থাপ্পড়ে টলে উঠেছিল ওর মাথা। সৈনিকটি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলেছিল, তোমারা পরচম পর ম্যায় পিসাব করতা হু। তোমারা পরচম কভি ইস মুলক পর নেহি লহেরায়েগা। হা-হা করে হাসে সুরবালা। ওর হাসি শুনে ঝিম মেরে যায় মেয়েটির মাথা। কিন্তু স্মৃতি জেগে ওঠে সুরবালার। ভেবে দেখে, স্বাধীনতার পতাকার কথা ওদের বলেছিল শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখে। ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। বাইরে শ্রাবণের তুমুল বৃষ্টি ছিল। আঁধার করে ঘনিয়ে ওঠা আকাশ ও দেখতে পায়নি। বুঝত, শ্রাবণের ঘন মেঘের কথা ভাবলে ওর মোসলেমের কথা মনে হতো। ভালোবাসার সঙ্গে স্বাধীনতার পতাকার গভীর সম্পর্ক ছিল। আহ, সুরবালা জীবনের নিষ্ঠুরতাটুকুই শুধু তুমি দেখলে। নিষ্ঠুরতার উল্টোচিত্রটি তোমার দেখাই হলো না। সুরবালা, তারপরও তুমি ভাগ্যবতী। স্বাধীনতার পতাকাটি তোমার মুলকে উড়ছে। উড়বেই তো। তোমরা যুদ্ধ করেছ, জীবন দিয়েছ সুরবালা। এত ত্যাগের পর পতাকা না উড়ে পারেই না। সুরবালা চোখ খোল!

ও চোখ খুললে একরাশ ধুলোয় চোখ ভরে যায়। জলে পূর্ণ হয়ে ওঠে চোখ। সে জলের দিকে তাকিয়ে কিশোরী মেয়েটি বলে, মাসি তুমি ন্যাংটো হয়ে গেছ। শাড়ির একটা ছেঁড়া টুকরো মাত্র আমি রাখতে পেরেছি। মাসি, শুনতে পাচ্ছ তুমি ন্যাংটো হয়ে গেছ।

চারদিকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়ায়। বলে, সুরবালা তো কবেই ন্যাংটো হয়েছে। কত লাখ বছর আগে, এটা আর ওর কাছে নতুন খবর কী? বাঙ্কারের চার দেয়ালের ভেতরে ওর শরীরে কাপড় রাখা হতো না। যুদ্ধ, যুদ্ধ। সুরবালা, যুদ্ধ মানে নারীর শরীর ন্যাংটো হয়ে যাওয়া। সুরবালা তোমার আর দুঃখ কী। সুরবালা তুমি খুব সুখী নারী। সুখের থইথই সাগরে তুমি ডুবে আছ। তুমি আমাদের অভিবাদন নাও সুরবালা।

খানকি মাগি।

সুরবালার কণ্ঠে সমাজের ধ্বনি। এসব শুনতে শুনতেই তো পাগল হয়ে যাওয়া। তা হলে কারা এসব ফালতু কথা শোনায় ওকে। ও তো এসব শুনতে চায় না। তাহলে কি মোসলেম? যে একদিন শ্রাবণের ঘোর বৃষ্টির সময় মানকচুপাতা মাথায় দিয়ে গাঙপাড়ে দাঁড়িয়ে খুব মৃদুস্বরে বলেছিল, সুরবালা তোমাকে আমি ভালোবাসি।

ভালোবাসি! সেদিন আঁতকে উঠেছিল সুরবালা। মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রেম! ও তো চারদিক থেকে সমাজের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল। ও মোসলেমের কথায় সাড়া দিতে পারেনি। ভয়ে-আতঙ্কে অনরবত কুঁকড়ে যাচ্ছিল। বলেছিল নিজেকে, ঘোর অন্ধকার চারদিকে।

সুরবালার কপাল থেকে রক্ত গড়ায়। কিশোরী মেয়েটি হাতে ধরে রাখা শাড়ির টুকরো দিয়ে কপাল বেঁধে দেয়। নিজের ওড়না জড়িয়ে দেয় সুরবালার কোমরে। সুরবালা নেতিয়ে পড়ে এবং জ্ঞান হারায়। মেয়েটি কানের কাছে মুখ নিয়ে চিত্কার করে ডাকে, মাসি, মাসিগো—। একসময় ওর চিত্কার বাতাসের তোড়ে তীক্ষ হয়ে ওঠে।

ওই কণ্ঠস্বর ধাক্কা দেয় গ্রাম-পুলিশ মোসলেমের কানে। ততক্ষণে ঝড় থেমেছে। ও পথে নেমেছে বিভিন্নজনের খোঁজ নিতে। তাদের মধ্যে একজন আছে ওর প্রিয় মানুষ, যে পথে-ঘাটে পড়ে থাকে। খেতে পেলে খায়, না পেলে উপোস থাকে। পাগলি হয়ে নিজের বোঝা নিজেই টানে। কোনো কিছু না বুঝে। কিশোরীর চিত্কার শুনে মোসলেম সামনে এগোয়। যেতে যেতে ভাবে, সে সময়ে যুদ্ধের ডাক না এলে ও হয়তো সুরবালাকে নিয়ে পালিয়ে যেত শহরে। ওহ কষ্ট, কষ্ট। সেই শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি, কালো মেঘ, আকাশ, হিমেল বাতাস এবং শ্যামলাবরণ সুরবালার আশ্চর্য শরীর, দুই চোখের গভীরে শ্রাবণ দিনের সবটুকু—এক অবিশ্বাস্য সময় হূদয়ের গভীরে গেঁথে গেল। ওই স্মৃতিটুকু থেকে বের হতেই পারল না মোসলেম। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে দেখল সুরবালা হারিয়ে গেছে। এখনো তো খোঁজাই শেষ হলো না মোসলেমের।

মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালে মেয়েটি হাঁ করে তাকিয়ে বলল, কাকা!

কী হয়েছে?

মাসি জ্ঞান হারিয়েছে।

আজ কি শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখ?

কী যে বলেন কাকা, এখন তো বৈশাখ মাস। কালবৈশাখী বয়ে গেল দেখলেন না?

মোসলেম অচেতন সুরবালার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়া একজন যোদ্ধা কেউ। ওর শুশ্রূষা দরকার। ভালো হয়ে উঠেই ও আবার শত্রুর পেছনে ছুটবে। যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে একজন আহত সহযোদ্ধাকে কাঁধে তুলে দৌড়াত শুশ্রূষাকেন্দ্রের দিকে, সেভাবেই ঘাড়ে তুলে নেয় সুরবালাকে। মেয়েটি অবাক হয়ে মোসলেমের দিকে তাকায়। তারপর মোসলেমের পিছু পিছু ছুটতে থাকে।

কলিমুল্লাহর বাড়ির পেছনের দিকে একটি পাতার ছাউনি তুলে সুরবালার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল মোসলেম। সেখানেই নিয়ে এসে মেঝেতে পড়ে থাকা পাটিটা সোজা করে বিছিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয় সুরবালাকে। কিশোরী মেয়েটি ছুটে গিয়ে পানি এনে মুখে ছিটায়। অল্পক্ষণে চোখ খোলে সুরবালা। ঘোলাটে চোখ, যেন কিছু দেখতে পায় না। চোখে কোনো ভাষা নেই। মোসলেম দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে, বাইশে শ্রাবণ—সুরবালা সেদিনের মতো করে একবার তাকাও। সুরবালা একবার তাকাও—সুরবালা...। মোসলেমের অস্ফুট কণ্ঠস্বর শুনে মেয়েটি চমকে তাকায়। বলে, কাকা কিছু বলছেন?

মোসলেম ঢোক গিলে দ্রুতকণ্ঠে বলে, দুলু আমি ওষুধ আনতে যাচ্ছি। তুই তোর মাসিকে দেখিস।

দুলু ঘাড় নাড়ে না। তাকায়ও না। মোসলেম জানে, ও এখানে বেশিক্ষণ থাকবে না। একসময় কুকুর এসে বসে থাকবে ছাউনির দরজায়। নয়তো বিড়ালটা সুরবালার মাথার কাছে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। চালের ওপর একগাদা চড়ই কিচিরমিচির করবে। শুধু মানুষই কম থাকবে সুরবালার পাশে। পথে নেমে মোসলেম স্মৃতির দরজা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধ-প্রেম শব্দের বিশাল ঘটনা। স্মৃতিতে এলোমেলো পড়ে থাকে খুঁটিনাটি বিষয়—এবড়োখেবড়ো, ভাঙাচোরা—এগুলো প্রতিদিনের দিনযাপন। মোসলেমের এখন প্রতিদিনের দিনযাপনে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ওর চুল সাদা হয়েছে, মুখে বলিরেখা পড়েছে। কেউ কেউ বলে, বিয়ে করবে না মিয়া? মেয়ে দেখব?

মোসলেম মৃদু হাসে। কথা বলে না। বিয়ে তো একটা সাধারণ ঘটনা। সবার জীবনে ঘটে। কিন্তু যুদ্ধ ও প্রেমের মতো ঘটনা সবার জীবনে ঘটে না। এই বড় ঘটনা নিয়ে মোসলেম মাথা সোজা রেখে বেঁচে আছে। দুটো ঘটনাই ওর জীবনের সম্পদ।

পথে ওকে আটকায় তবিবর। বলে, কোথায় যাও মুক্তিযোদ্ধা!

গ্রাম-পুলিশের কি কাজের শেষ আছে?

কেবল হেঁয়ালি কর। যাও যাও, যেখানে খুশি সেখানে যাও।

মোসলেম কথা না বাড়িয়ে পাশকাটিয়ে চলে আসে। তারপর খানিকটা এগিয়ে গাছের আড়ালে পথের ধারে বসে থাকে। ভালো লাগে না ওষুধ আনতে যেতে। ভালো লাগে না মানুষের মুখোমুখি হতে। বুকের ভেতরে উড়ে আসে শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ। উপুড় হয়ে নেমে আসে আকাশ।

ও ফিরতে থাকে নিজের ঘরে। ওর বুক ভেঙে কান্না আসছে। ও দুই হাতে চোখ মুছতে মুছতে ভাবে, যুদ্ধ ও প্রেম আলাদা নয়। প্রেম যেমন ফুরোয় না, যুদ্ধও ফুরোয় না। এখনো যুদ্ধ চলছে। নানা কিছুর সংঘর্ষের যুদ্ধ। সুরবালাকে স্মরণে রেখে ও বেঁচে থাকবে আমৃত্যু। যুদ্ধেরও শেষ নেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

ঘরে ফিরে মোসলেম টিনের বাক্স থেকে পতাকা বের করে। অনেক বড় পতাকা। একজন মানুষের শরীর ঢেকে দেওয়া যায়। মোসলেম পতাকাটি খুলে ঝেড়ে আবার ভাঁজ করে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখে। যে আগে মারা যাবে, তার গায়ে প্রথমে উঠবে পতাকাটি। ওর আগে সুরবালা চলে গেলে ও নিজে সুরবালাকে মুড়িয়ে দেবে পতাকাটি দিয়ে। কিন্তু ও মারা গেলে কে দেবে? কাউকে তো এ কথা বলতে হবে। মোসলেম ঠিক করে, কিশোরী দুলুকেই এ দায়িত্ব দেবে। ও ঠিক পারবে কাজটি করতে।

অনেকদিন ফুরিয়ে যায়। একদিন খবর হয়, সুরবালা প্রয়াত হয়েছেন।

দিনটি উজ্জ্বল ছিল। আশ্বিনের শেষদিন। আকাশ মেঘশূন্য। তিনি তাঁর ছাউনির মেঝেতে চিত্ হয়ে পড়ে ছিলেন। শরতের আলোছায়া প্রয়াত সুরবালার কাঠির মতো শরীরে স্নিগ্ধ পরশ ছড়িয়ে রেখেছিল।

খবরটি মোসলেমের কাছে নিয়ে আসে কিশোরী মেয়েটি।

কাঁদতে কাঁদতে বলে, কাকা মাসি মরে গেছে।

প্রথম ধাক্কায় খবরটি বুঝতে না পেরে ও বিমূঢ় কণ্ঠে বলে, কী বললি দুলু?

চলেন, দেখবেন। আমি মাসি মাসি করে চিত্কার করলেও মাসি আমার ডাকে সাড়া দেয়নি।

ততক্ষণে মোসলেম যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। দুলুর হাত ধরে বলে, আয়।

ছাউনির দরজায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় মোসলেম। আলো-ছায়ার অপরূপ দৃশ্যে অপূর্ব দেখাচ্ছে সুরবালাকে। সুরবালার নিমীলিত চোখের তারায় শ্রাবণ দিনের মেঘ জমে আছে। প্রেম-প্রেম। সুরবালাকে ভালোবাসার কথা বলার পর সুরবালা একদিন ওকে চুপিচুপি বলেছিল, তোমার জন্য আমার প্রেম জমে থাকবে আমার বুকে। কোনোদিন সেটা হারাবে না। সারাজীবন একা থাকতে হলেও না।

তারপরই তো শুরু হয় যুদ্ধ। দুজনে দুই রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করে। সুরবালার কাছে গিয়ে ও মাথায় হাত রাখে। চোখের তারায় আঙুল। ঠোঁটে দেয় আঙুলের পরশ। বোঝে শীতল হয়ে গেছে সুরবালার শরীর। অপরূপ সুরবালা। এখন ওর সামনে ভালোবাসার মায়াবি আলো।

সুরবালা তো স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। সমাজের মানুষ ওকে পাগল বানিয়েছে। মোসলেমকে চিনতে পারেনি। কাঁধে রাইফেল এবং একমুখ দাড়ি নিয়ে যুদ্ধশেষে ফিরে এলে ওকে দেখে ভয় পেয়েছিল সুরবালা। তখনই তো মোসলেমের জানা হয়েছিল যে ও অন্য যাত্রায় চলে গেছে। তবুও তো ওকে দেখা যেত, দূর থেকে কিংবা কাছে দাঁড়িয়ে। এখন ও অলৌকিক যাত্রার পথে। আর কোনোদিন ফিরে দাঁড়াবে না।

মোসলেম পকেট থেকে বাক্সের চাবিটি মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে, যা পাতাকাটি নিয়ে আয়।

পতাকা? কেন? দুলুর চোখে বিস্ময়।

নিয়ে তো আয়। পরে দেখবি।

মোসলেমের কাছ থেকে খবর পেয়ে একে-দুয়ে জড়ো হয় অনেকে। নানাজনের নানা কথা ছড়াতে থাকে চারদিকে। সুরবালাকে দাহ করার প্রস্তুতি চলতে থাকে। একসময় আয়োজন শেষ হয়। এখন শ্মশানে যাওয়ার চিন্তা। এতক্ষণ ধরে মোসলেম নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল। কখনো নানাজনের নানা কথায় অংশগ্রহণ করেছে। কেউ কেউ বলে, মুক্তিযোদ্ধা কিছু বলেন না যে?

আমি তো সবার শেষে বলব। কারণ কথা একটাই।

একটা কথা? কী কথা?

বোল হরি, হরিবোল। পেছনে শ্মশানযাত্রীরা তৈরি। মোসলেম দেখতে পায়, পতাকা নিয়ে দৌড়ে আসছে দুলু। ও কাছে আসতেই পতাকা নিয়ে মোসলেম বলে, যোদ্ধা নারীকে মর্যাদার সঙ্গে সত্কার করতে হবে। শ্মশান পর্যন্ত নেওয়ার সময় তাকে পতাকা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

পতাকা দিয়ে? সমবেত কণ্ঠের ধ্বনি।

আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন?

পাগল হব কেন? পাগল হইনি।

তা হলে বলেন, তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র কোথায়?

মোসলেম জড়ো হওয়া মানুষের মুখের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আগুনঝরা চোখে বলে, পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কার।

সমবেত মানুষের আর্তচিত্কার, বাঙ্কার!

মোসলেম দুলুকে বলে, তুই ওই মাথাটা ধর। আয় আমরা বীরযোদ্ধাকে পতাকা দিয়ে সম্মান দেখাই।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত