বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে দুপুর প্রায় বারোটা পর্যন্ত ঢাকাবাসীর মনে নিশ্চিতভাবে একটা প্রশ্নই কাজ করেছে-আমরা বাঁচব তো? না-বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় পুরোপুরি; সামান্য যেটুকু সম্ভাবনা তাও ছেড়ে দিয়ে আছি দৈবের ওপরে, কোনো অলৌকিকতার আশায়।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে প্রতিদিনই নতুন করে বেঁচে থাকার স্বাদ অনুভব করেছি, হতাশা গ্রাস করেছে, আশা জাগিয়ে তুলেছে, কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর সকালে যেন সবকিছু শূন্য হয়ে আসতে থাকে। মৃত্যু ও জীবনের সন্ধিস্থলের স্বরূপ কী, তা বোঝানো সম্ভব নয়।

জীবনের প্রতি মমতা ওই দিনে যেমন গভীরভাবে অনুভব করেছি, সম্ভবত যুদ্ধের পুরো নয় মাসে তেমন করে করিনি। কারণ, ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিন দিনের মাথায়ই যখন নিশ্চিতভাবে জেনে যাই যশোর মুক্ত, একে একে জানতে থাকি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে, অজস্র সংখ্যায় হতাহত হচ্ছে, একটার পর একটা অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা রাজধানী ঢাকার অধিবাসীরা উল্লসিত হই, শিহরিত হই, বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে অনুভব করে উদ্বেলিত হতে থাকি, কিন্তু যখনই সঙ্ষ্ট বুঝে যাই রাজধানীর পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিজয়ই চূড়ান্ত নয়, তখনই মনে হয়েছিল, বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই!

বাঁচতে চাওয়ার আকুতির মধ্যে বড় একটি কারণ ছিল। আমি একাত্তরের আগস্ট থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রাস্তার প্রথম বাড়িটিতে ছিলাম; বাড়িটি আমার বড় ভায়রা মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেমের। মনে আছে, ১৬ তারিখ সকাল ১০টার দিকে তিনতলার ছাদে নয়, চিলেকোঠার ছাদে উঠে দেখলাম পশ্চিম দিগন্তে মুক্ত গ্রাম, ওরা স্বাধীন। শুধু আমরা ঢাকাবাসীই স্বাধীনতার স্বাদ কি জানিনে, জানব কি না তাও জানিনে।

জানতে দিচ্ছে না রাও ফরমান আলী। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ থেকেই আকাশবাণী ফরমান আলীর বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছে-‘হাতিয়ার ডাল দো।’ সাবধানবাণী প্রচার করা হচ্ছে ভারতের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল স্যাম মানেকশর নামে, ডাল দো। কিন্তু সহসা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে-পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক তো জেনারেল এ এ কে নিয়াজি, কিন্তু হুঁশিয়ারি তার নামে নয় কেন? এই ধাঁধায় বুঝতে পারি সবাই ঘুরছে, কিন্তু কোথায় সমাধান বা সদুত্তর, কিছুই জানা নেই। স্যাম ম্যানেকশর হুঁশিয়ারি থেকেই জেনে যাই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী, অর্থাত্ যৌথ বাহিনী চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে রাজধানী ঢাকাকে। এই দাবি যে মিথ্যে নয়, তার প্রমাণ পেতে থাকি তার আগের দিন থেকেই, শুনতে থাকি কামানের বুমবুম আওয়াজ। সে আওয়াজ ক্রমশ এগোচ্ছে। এই সময়ে ঢাকা কাঁপছে অনিশ্চিত আশঙ্কায়, আমরা কাঁপছি নিশ্চিত মৃত্যু সম্ভাবনায়। ‘হাতিয়ার ডাল দো’ অর্থাত্ অস্ত্র সমর্পণ করো, কিন্তু না নিয়াজি না ফরমান আলী না ইয়াহিয়া কেউই কিছু বলে না। অথচ এদের যেকোনো একজনের জবার দেওয়ার চূড়ান্ত সময় ১৬ ডিসেম্বর, সকাল ৯টা।

৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে যৌথ বাহিনীর বম্বিং শুরু হলেও তীব্রতা বৃদ্ধি পায় ১০ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত। ১৩ ও ১৪ তারিখে তো কয়েক মিনিট পরপরই সাইরেন, বিমানের শব্দ ও আক্রমণ, পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের অ্যান্টি এয়ারক্রাফটের নিষ্ফল গুলি চালনা। ৫ ডিসেম্বর থেকেই ঢাকার আকাশে কোনো পাকিস্তানি স্যাবর যুদ্ধবিমান নেই, ঢাকার আকাশ পুরোপুরিই যৌথ বাহিনীর দখলে। ইচ্ছামতো বোমা ফেলে যাচ্ছে, বোমার ভয়াবহতা জানা সত্ত্বেও আমরা ছাদে উঠে, খোলা রাস্তায় বা মাঠে দাঁড়িয়ে বিমান আক্রমণ দেখছি, যেন ওইসব বোমা স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি কারা চেনে, আর স্বাধীনতাবিরোধী কারা তাও চেনে। সেসময়ই ছবিসহ একটা মজার খবর দেখেছি খবরের কাগজগুলোতে। কাগজের ক্যাপশনগুলো বলছে-ছাদের দর্শকরা ভারতের বিমানগুলো কেমনভাবে নাকাল হচ্ছে তা-ই দেখছে।

আমরা হেসে বাঁচিনে। আমার মনে হয় দেশের সুখের বা দুঃখের খবর দেশই জানিয়ে দেয় বাতাসের মাধ্যমে, ছবি এঁকে দেয় আকাশে। যুদ্ধের ভয়ঙ্কর রূপ কমবেশি দেখা থাকলেও, আমার ধারণায় সারা নয় মাসে বাংলাদেশের মানুষ যতটা আতঙ্কের মধ্যে বাস করেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম সাত-আট দিন মানুষ একটা চাপা আনন্দ নিয়ে নির্ভয়ে চলাফেরা করেছে, আশার প্রহর গুনেছে-কবে বা কখন পাকিস্তানি এই নরপশুদের হাত থেকে মুক্তি মিলবে।

সে সময়ে নিজের অনুভবের সঙ্গে একে একে মিলিয়ে দেখেছি, প্রায় প্রত্যেকেই প্রথম দিককার আনন্দের পরিবর্তে মৃত্যুভয়ে ভীত হতে শুরু করেছে। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

সঠিক তারিখটি মনে নেই। সম্ভবত এগারো কি বারোই ডিসেম্বর। গভীর রাত। ব্ল্যাক আউট বলে কোথাও আলো নেই, আমাদের চোখে ঘুম নেই, আশার শেষ নেই, প্রত্যাশারও ঘাটতি নেই, হঠাত্ প্লেনের শব্দ। কিন্তু এ বিমান তো যুদ্ধ বিমান নয়, ভূমি থেকে কোনো বিমানবিধ্বংসী গুলিও করা হচ্ছে না। খুব ধীরগতিতে বিমানের শব্দটি আকাশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সহসা আমরা বুঝে যাই এ বিমান তো প্ল্যান্ট প্রটেকশনের বিমান, এর শব্দ তো আমাদের পরিচিত। এবং বুঝে উঠতে উঠতেই বোমা বিস্ফোরণের শব্দে আমাদের কেউ কেউ বিছানা থেকে ছিটকে মেঝেয় পড়ে যায়।

সারা ঢাকা শহর শুনেছে সে শব্দ, শুনেছে বলে বুঝতে পারি আসলে শেষ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ঢাকা রাতে ঘুমায় না। তবে স্বাধীন দেশের সূর্যটি দেখব-এই আশায় আমরা প্রহর গুণে চলেছি। এর মধ্যে এই বোমাবর্ষণ! আর থাকা নিরাপদ নয়, আর ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়। এই আশঙ্কার সত্যতা মেলে যখন সকালে পাকিস্তান রেডিও জানায়, ভারতীয় বিমান এতিমখানার ওপর বোমা ফেলে এতিম শিশুদের হত্যা করেছে। ভারত এতটা নিষ্ঠুর হবে চিন্তা করে মুষড়ে পড়ি, কিন্তু ১০টা বাজতে না বাজতেই আকাশবাণী জানিয়ে দেয়-যে বোমায় এতিমখানার অজস্র শিশু মারা গেছে, সেই বোমা ফেলেছে পাকিস্তান, কারণ বোমার যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে রয়েছে পাকিস্তানের অস্ত্র কারখানার ছাপ এবং তথ্য নির্ভুল। এই ভারতীয় খবরের কোনো প্রতিবাদ করে না পাকিস্তান; বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাও যখন জানায় সে বোমা ফেলেছে পাকিস্তান, তখনই মানুষ ছুটতে শুরু করে দিগ্বিদিক।

দেশের অন্যান্য অংশের মানুষের চেয়ে রাজধানী ঢাকার মানুষের অনুভব ভিন্ন ছিল। কারণ রাজধানী দখল বা পতন যুদ্ধের শেষ অঙ্ক, সেই অঙ্ক কীভাবে সংঘটিত হবে ইতিমধ্যেই মানুষ অনুমান করতে শুরু করেছে। পাকিস্তানিরা নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে-তার প্রমাণ এতিমখানায় বোমাবর্ষণ! এর মধ্যেই জোর গুজব ছড়িয়ে পড়ে সারা ঢাকায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বাড়িবাড়ি আশ্রয় নেবে। পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য, ঘরে ঘরে আশ্রয় নিয়ে যতটা বাঁচা যায়-এই সম্ভাবনাও বাতাসে ঘোরে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা-ঘরে ঘরে আশ্রয় নেওয়ার পরিণতি কী? হত্যা, লুণ্ঠন, মা-বোন-কন্যাকে ধর্ষণ, আর ভাবতে পারিনে, স্বাভাবিক হতে পারিনে। মনে হয় মৃত্যু দরোজায় মুখ ব্যাদান করে আছে।

সহসা শুনি আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে; দক্ষিণ-পূর্ব ভারত মহাসাগর থেকে যাত্রা শুরু করেছে। এ খবর যেন মুত্যু পরোয়ানা; কিন্তু এই খবরই কিছু কিছু মানুষের চোখে-মুখে আনন্দের রেখা টেনে যায়, বাসার সামনেই দুই অবাঙালির আলাপ কানে আসে-আসছে, এসে গেল বলে, এলে গাদ্দার বাঙালি যাবে কোথায়? শুধু শুনি কিন্তু বলতে পারিনে কিছুই, কারণ দেশটি যে তখনো পাকিস্তান দখল করে আছে, প্রকাশ্যে শুধু তাদেরই অস্ত্র দেখা যায়, তাদেরই লম্ফঝমঙ্ চোখে পড়ে।

আবার সহসাই শুনতে পাই, সোভিয়েত রাশিয়াও যুদ্ধ জাহাজ পাঠাচ্ছে, তার অর্থ পৃথিবীর দুই পরাশক্তি মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এবং তার আরো গভীর ও সুদূরপ্রসারী অর্থ। বাংলাদেশ প্রশ্নে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য। নতুন উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই, বিপন্ন জীবন আর কতদূর নিয়ে যাবে চিন্তা করতে করতে একসময় চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলি। এমনটি যে অনেকের হয়েছিল তা বাড়ির লোকদের কাছে জেনেছি, বিজয় অর্জন করার পর জেনেছি আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের মুখে। সত্যি বলতে, ষোলই ডিসেম্বরে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করছে এই তথ্যটি জানার আগে পর্যন্ত মৃত্যুচিন্তা আমাকে এতটা গভীরভাবে কখনোই অধিকার করেনি।

৩২ বছর পরে এখনো আমার মনে হয়, যুদ্ধের ১৩টি দিন চোখের সামনে ঘটছে, দেখতে পাচ্ছি। তখন নিশ্চিত হয়ে যায় আমি ধানমন্ডির যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছি সেটি আর কোনোদিন পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত হবে না। এই দেশ কক্ষনো পাকিস্তানের অংশ বলে পরিচিত হবে না, তখন সঙ্ষ্ট মনে আছে আমি ছেলেমানুষের মতো কেঁদেছিলাম।

অনুভূতিটা সঙ্ষ্ট মনে আছে; যে মাটিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সেটি আমার, আমার!