আমার চাকরি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। বদলি হয়ে আমি ’৭১-এর ২১ ফেব্রুয়ারি যশোরে এসপির দায়িত্ব নিই। এসপি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে এটি আমার প্রথম পোস্টিং। এর আগে আমি চাকরি করেছি লায়ালপুর, করাচী আর রাওয়ালপিন্ডি। তখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। দেশে নানা ঘটনা ঘটছে। আমরা সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব করে যাচ্ছি। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। সবাই যেন এটা বুঝতে পারছিল। এটা আশঙ্কা, আবার আশাও। সেই দোদুল্যমান অবস্থায় কী হচ্ছে না হচ্ছে এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা, স্থানীয় এমপি মশিউর রহমান সাহেব আমাকে কিছু কিছু বলতেন।
২৫ মার্চ রাত পার হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে যেন সেদিনই বুঝলাম যে, কিছু একটা হবে। টেলিফোন অপারেটর আমাকে টেলিফোনে সাংকেতিক ভাষায় জানালেন, আপনি বাসা ছেড়ে চলে যান। আমি একজনকে কোড ওয়ার্ডে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? উনি বললেন, আমি অলরেডি বাসা থেকে সরে গেছি। কিন্তু আমি তো এভাবে সরে যেতে পারি না। আমার কাছে জেলার দায়িত্ব। আমার এতজন সহকর্মী, কাউকে কিছু না বলে চলে যাব—এটা তো সরকারি চাকরির শিক্ষা নয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাসা ঘেরাও হলো এবং আমাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো।
এখানে ২৫ মার্চের আগের কয়েক দিনের ঘটনার একটু উল্লেখ দরকার। অসহযোগের সময়ে অফিসে যাচ্ছি-আসছি। কিছু কিছু খবর আসছে, আমরা জনসাধারণের কাছ থেকে ফিডব্যাক পাচ্ছি। এক সময় আমার মনে হলো, ইট ইজ হাই টাইম। এখন জেলার পুলিশ লাইনের অস্ত্র বিতরণ করে দেওয়া দরকার। পুলিশ লাইনে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত অস্ত্র বিতরণ করলাম। আমি ঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকিনি। আমার পুলিশ লাইনের পুলিশদের হাতে দিয়ে দিচ্ছি। তারা কাকে দিচ্ছে তা দেখার মতো সময় তখন আমার নাই। দু-একজন আমাকে একটু উপদেশ দিতে চেষ্টা করছেন বা বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু তখন আমার বয়স কম, রক্তও একটু গরম। কারো উপদেশ শোনার সময় ওটা নয়। আর একটা কারণ হলো, সবেমাত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছি। ওখানে আমাদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে তাতে বুঝেছি এদের সঙ্গে আর নয়।
২৫ মার্চের রাতে আমাকে নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। ভেতরে কিছু পরিচিত লোক দেখছি কিন্তু কথা বলতে পারছি না। রাতে জায়গা হল দাউদ পাবলিক হাইস্কুলের হোস্টেলের সব শেষের কোনার রুমটায়। শুনলাম আমার পাশের রুমে জনাব মশিউর রহমানকে রাখা হয়েছে। তারপরের রুমে রাখা হয়েছে মিয়াজী নামে এক ভদ্রলোককে। তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমি দেখতে পাচ্ছি না। কারণ আমি শেষ রুমে। আমাকে দিনে দুবার নিয়ে যাওয়া হয়। যেতে হয় তাদের রুমের সামনে দিয়ে। কোনো দিন তাদের গোঙানির শব্দ পাই, কোনো দিন পাই না। দিনতিনেক পর খেয়াল করলাম ওনাদের রুম থেকে আর কোনো শব্দ পাচ্ছি না। আমার মনে ধাক্কা লাগল, হয় তাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা অন্য কিছু...। পরে বুঝলাম মশিউর রহমান সাহেব আর নাই।
এরপর আমাকে একবার সুযোগ দেওয়া হলো অফিসে যাওয়ার। তারপর আবার নিয়ে আসা হলো। এবার আমাকে রাখল ৫৫ ফিল্ড বালুচ রেজিমেন্টের ওখানে। শুরু হলো দুর্ব্যবহার—শারীরিক এবং মানসিক। শারীরিক নির্যাতন মানে দিনে দুবার ইন্টারোগেশন। ইন্টারোগেট করত এফআইইউ (ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিট)। এখানে দিনের যন্ত্রণা কোনো রকমে সহ্য করা যেত। কিন্তু রাতের বেলা খুব কষ্ট হতো। মনে হতো আল্লাহ, যদি তুমি বাঁচিয়ে রাখো, ভবিষ্যতে আমার কোনো শত্রুকেও যেন এ রকম যন্ত্রণায় পড়তে না হয়।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মিদের সঙ্গে আমাকে একবার মাগুরা নিয়ে যাওয়া হলো। সঙ্গে ডিসি। ডিসি তাদের অপছন্দের লোক ছিল না। ওখানে তারা অপারেশনের মতো কিছু করতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, এখানে তো শান্ত পরিবেশ, খামোকা আপনারা এটা করছেন কেন? উত্তরে সাধারণ এক হাবিলদার বলল, বিসমিল্লাতেই বাধা দিলেন। আজ সকালে একটাও কাজ হয়নি, মানে কাউকে মারতে পারেনি। ফেরার পথে ঝিনাইদহ থেকে আসছি। এক জায়গায় দাঁড়াল। তিনটে লোককে তারা পথে দাঁড় করাল। সামনের লুকিং গ্লাসে দেখতে পাচ্ছি, তাদের পুকুরের ধারে দাঁড় করিয়ে ফায়ার করা হলো। এরপর আমাদের বলা হলো, প্রয়োজনে তোমাদেরও এ অবস্থা হবে।
আমাদের অফিস থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। খবর পেলাম আমার বাসায় বোমা ফেলেছে এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার পরিবার কোথায় আমি জানতে পারছি না। শুনলাম, ওরা বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। তখন স্ত্রীর সঙ্গে আমার দুটো সন্তান। একটা তিন বছর, একটা আড়াই মাস বয়স। ভাই আছে একটা সঙ্গে। শুনলাম ওরা হাসপাতালে জায়গা নিয়েছে। হাসপাতাল নিরাপদ জায়গা মনে করে এলাম। আমি আসার পর কেমন যেন একটা গুঞ্জন উঠল—উনি থাকলে তো আমাদের বিপদ, উনি অস্ত্র বিলিয়ে দিয়েছেন। সবাই আমার পরিবারকে অন্য চোখে দেখতে লাগল। সেখান থেকে জেলখানায় গেলাম। যশোর সেন্ট্রাল জেল। শুনলাম, সেন্ট্রাল জেলের সব কয়েদিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জেল খালি। সেখানে যাওয়ার সময় একটু ছদ্মবেশ নিতে হলো। ছদ্মবেশের কারণ ছিল।
আমি দু দিকেই ধরা পড়তে পারি। মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে বলছিল আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। অনেকবার টেলিফোন করেছে। আমি তাদের সঙ্গে যেতে পারিনি। সত্য বলছি, আমরা আট ভাই এক বোন, আমার বাবা স্কুলশিক্ষক। আমাদের বাড়ি বর্ডারে—রাজশাহীর গোদাগাড়ি থানা। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে ওরা সব শেষ হয়ে যাবে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতিমধ্যে আমার সম্পর্কে খবর ছাপা হয়েছে, যশোরের এসপিকে মেরে ফেলা হয়েছে। যেটা সত্য নয়। তখনকার দিনে বিবিসির সবচেয়ে নামকরা রিপোর্টার মার্ক টালি এসেছেন আমার সাক্ষাত্কার নিতে। সব কিছু জানার পরও আমি কিন্তু দেশত্যাগ করতে চাইনি। কেউ যদি বলে, করেননি কেন? আমি বলব—দেশে থেকেই যা করার করতে চেয়েছিলাম। যারা মনে করেন, মুজিবনগর থেকে কলকাতা গেলেই শুধু মুক্তিযোদ্ধা, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই।
যা-ই হোক, ক্যান্টনমেন্ট থেকে জেলখানা। জেলখানায় কাজ কিছুই না, বসে থাকতে হয়। খাওয়া-দাওয়া বলতে সাধারণ রুটি আর পানি। জেলখানায় আমরা তখন নিজেরাই আশ্রয় নিচ্ছি। জেলখানার ডিআইজি প্রিজন, জেলার, অন্যান্য কর্মচারী, বিশেষ করে ডিআইজি সাহেবের স্ত্রী—এদের সাহায্য আমার পরিবারকে চিরজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ করে রেখেছে। সেই দুর্যোগে আমার স্ত্রী অনামিকা হক লিলির ধৈর্য ও সহযোগিতা ছিল অপরিসীম।
জেলখানায় হঠাত্ একদিন অপারেশনে আসে আর্মি। যে কয়জন লোককে তারা খুঁজছে তাদের মধ্যে ছিলাম আমি, তদনীন্তন ডিসি এবং একজন অধ্যাপক। এই তিনজনের সম্পর্কে তারা মন্তব্য করল। ডিসিকে বললেন, ‘ফেইল্ড টু কন্ট্রোল দ্য ডিস্ট্রিক্ট’, আমাকে বললেন, ‘দ্য রিয়েল কালপ্রিট’ এবং প্রফেসর হলেন ‘দ্য রুট অব অল এভিল’। এবার ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পর আরো অনেক জেরার মুখোমুখি হতে হলো।
জেলখানায় আসার পর কাকে কোথায় রাখল জানি না। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে খবর পেলাম ডিসিসহ সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অপেক্ষা করছি আমাকে কখন নিয়ে যাবে। আমাকে আবারও ৫৫ ফিল্ড রেজিমেন্টে রাখা হলো। এবার স্বাভাবিকভাবে নয়, পায়ে বেড়ি দিয়ে। সেখানকার অনাচার-অত্যাচারের কথা আর কী বলব। দুঃসহ সময় কাটছে। একদিন হঠাত্ শুনলাম, আমাদের নিজেদেরই কিছু একটা করতে হবে। যশোর এয়ারপোর্ট থেকে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সময় যে ফাঁকা মাঠটা তার শেষ মাথায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে তাদের নির্দেশে আমরা নিজেরাই নিজেদের জন্য গর্ত খুঁড়ছি। আমি ছিলাম ছয় নম্বরে। এর মধ্যে দুজন শেষ। একজন অফিসার এসে হঠাত্ বলল, ‘এসপি কে?’ আমি কিছু বলছি না। কারণ, যখনই এসপি হিসেবে আমার পরিচয় পায়, নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। একজন আমাকে দেখিয়ে দিল। অফিসার আমার হাত ধরে ঝটকা একটা টান দিলেন। ‘আসেন।’ বললেন উর্দুতে। নিয়ে জিপে ওঠালেন। গর্ত খোঁড়ার ওখানে যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাকে বললেন, ‘স্টপ দিস।’
এ ভদ্রলোকের নাম কর্নেল শরীফ। উনি এসেছেন মাত্র আগের দিন। তার আগে ছিলেন কর্নেল তোফায়েল—মানুষরূপে শয়তান।
কর্নেল শরীফ জিপে আমাকে বললেন, ‘আমি আপনাকে চিনি না। কিন্তু আমার ছোট ভাই রাওয়ালপিন্ডিতে পুলিশে চাকরি করত। আমি খারিয়ান ক্যান্টনমেন্ট থেকে বদলি হয়ে আসার সময় সে বলল, আমাদের একজন এসপি ছিলেন, তাকে একটু দেখে রেখো। আমি এসে শুনলাম আপনি রংপুর বদলি হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনি রংপুর নেই।’
আসলে আমার অর্ডার ছিল রংপুরেই। পরে যশোরের গুরুত্ব বুঝে বা অন্য কোনো কারণে আমাকে যশোরে পাঠানো হলো। উনি আমাকে বললেন, ‘আপনাকে আমি স্ক্রিনিং করার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আপনি সাবধান থাকবেন। আপনার কিছু হলে আমাকে জানাবেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে জানাব?’ তিনি বললেন, ‘আমি দেখি সে ব্যবস্থা করতে পারি কি না।’
সেদিন, সে মুহূর্তে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এলাম।
জেলখানায় আমরা যে কদিন ছিলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম রোজই। কেউ কেউ যুদ্ধে চলে যেতে চায়। একদিন শুনলাম, তদানীন্তন আইজি ম্যাক চৌধুরী যশোরে এসেছেন। উনি আমাকে চিনতেন। আমি যখন লায়ালপুরের এসপি, তিনি আমার ডিআইজি ছিলেন। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সার্কিট হাউসে গেলাম। যেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কীভাবে জেলখানায়?’
আমি বললাম, ‘ইট’স ডেসটিনি।’ উনি বললেন, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু ট্রান্সফার?’ ‘আপনি যদি ভাবেন, তবে তাই’, আমি বললাম। উনি আমাকে সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। সেখানে জেনারেল টিক্কা খান থাকবেন। আমি টিক্কা খান সম্পর্কে যেটুকু জানি তাতে মনে একটু দুশ্চিন্তা রেখাপাত করল।
ওনারা হেলিকপ্টারে যাবেন। আমি এয়ারপোর্টে এলাম। ম্যাক চৌধুরী বললেন, ‘ইউ অ্যান্ড ইউর ফ্যামিলি সাফারড মাচ। আমরা তোমাকে বদলি করে দেবো। তুমি কোথায় যেতে চাও।’ আমি বললাম, ‘আমার কোনো জেলায় যাওয়ার ইচ্ছা নাই। যদি কোনো স্টাফ জব থাকে, আমাকে দিন।’ স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানিরা আমাকে কোনো স্টাফ জবে নেবে না। কারণ, বিশ্বাস করত না। বললেন, ‘আমি তোমাকে কুমিল্লা পাঠাবো।’
আমি বললাম, ‘স্যার, কুমিল্লা তো আরেকটা ক্যান্টনমেন্ট। আমি জানি, ক্যান্টনমেন্ট কি। আমাকে কোনো অ্যাকাডেমিতে দিন।’ উনি বললেন, ‘তোমার ট্রেনিং আছে?’ আমি বললাম, ‘ওয়াশিংটনে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমির ট্রেনিং আছে আমার।’ ‘ওকে। ইউ গেট দ্য জব।’ উনি টিক্কা খানের কাছ থেকে অনুমতি নিলেন। টিক্কা খান আমাকে শুধু একটা শব্দই বললেন, ‘বিহেভ ইউর সেলফ।’ এটা কেন বললেন বুঝতে পারলাম না।
কর্নেল শরীফ আমাকে বললেন, ‘আপনার অর্ডার এসেছে, সারদা যাবেন। তার আগে স্ক্রিনিং করা হবে। আমি স্ক্রিনিং যা হয় করব কিন্তু আপনি আপনার পরিকল্পনার কথা কাউকে জানাবেন না।’ তিনি আমাকে ইশারা দিলেন, আমি বুঝলাম তার বক্তব্য: তোমার সঙ্গে যে বডিগার্ডটা আছে তার কাছ থেকে দূরে থাক। ভাবলাম কিছু একটা ব্যাপার আছে, যা আমি জানি না। উনি জানেন এবং আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ইশারায় জানিয়ে দিলেন।
কর্নেল শরীফ হঠাত্ একদিন সকালবেলায় বললেন, ‘আজ তুমি সারদায় চলে যাও।’ ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে দুই ঘণ্টার বেশি লাগে না। কারণ আমাদের তো জিনিসপত্র কিছু নাই। একটা স্যুটকেস, দুটো বাচ্চা আর খাবার-দাবার। আগস্টের শুরুতে পরিবার নিয়ে চলে গেলাম রাজশাহী। রাজশাহীর এসপি মারা গেছেন। ডিআইজিরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজশাহীতে সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমিতে গিয়ে দেখলাম এটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সবাই পাকসেনা, কোনো ছাত্র নাই। কোনো ট্রেনিংও চলছে না। আমাকে অর্ডার করা হলো যাতে আমি সবাইকে ডাকি। সময় লাগল। নভেম্বরের মধ্যে আমি মোটামুটি ঠিক করলাম। কিন্তু প্রতিদিনই দেখতাম, কিছু লোককে ডেকে পাঠাচ্ছে। আমার কাছে স্লিপ দেয়, অমুককে পাঠাও। আমি পাঠাই। এক-দুই দিন পাঠানোর পর দেখলাম, স্লিপে যাকে ডাকছে পরদিন তাকে আর পাচ্ছি না। তার মানে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। কী করি? আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। যার নামেই স্লিপ আসছে তাকে অন্যভাবে সরিয়ে দিতে শুরু করলাম। আগের তারিখ দিয়ে ডিসচার্জ দেখাচ্ছিলাম। অর্থাত্ তারা আর অ্যাকাডেমিতে নেই। আমি এভাবে অনেককে ডিসচার্জ করেছি।
ডিসেম্বরে পাসিংওভার প্যারেড হওয়ার কথা। তখন আমার চারজন পিএসপি ছাত্র। তাদের দুজন পরে আইজি এবং একজন এডিশনাল আইজি হয়েছিলেন, একজন হয়েছিলেন সচিব। এদের নিয়ে আমি ছা-পোষা মানুষের মতো অফিসার্স মেসে থাকতাম।
পয়লা ডিসেম্বর। হঠাত্ শুনলাম, আমাদের সবাইকে সারদা ছাড়তে হবে। কারণ, আমি অস্ত্র বিতরণ করেছি, আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে। সারদা থেকে আমাকে নাটোর ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসা হলো। এখানেও সেই একই ধরনের প্রশ্ন: কে অর্ডার দিয়েছিল, কেন অস্ত্র বিতরণ করেছিলে। তখন তো হুকুম লাগত না। এটা ওদের কে বোঝাবে! সে সময় সবই হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
রেডিও খুলে বসে থাকি। কিছু গুজব কানে আসে। আজ এ-খবর পাই, কাল ও-খবর। কোনোটায় খুশি হই, কোনোটায় ঘাবড়ে যাই। ফ্যামিলির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হচ্ছে না। শুনলাম, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারপর ভূটান। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছে। সবাই খুব খুশি খুশি। ১৭ তারিখে আমি এক পাকিস্তানী অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, কী করতে পারি? তিনি বললেন, ‘দি ডিসিশন ইজ ইউরস, ইউ আর ফ্রি টু ডু।’ বুঝলাম, পাক আর্মি চলে যাচ্ছে।
হাঁটা ছাড়া গতি নাই। ১৭ তারিখে আত্মগোপন করে খোঁজ নিলাম, সারদায় কী পরিস্থিতি। যেতে পারব তো! গ্রামের এক ভদ্রলোকের শরণাপন্ন হলাম। তিনি খোঁজ নিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার, সারদা আপনার জন্য ওয়েট করছে।’ তার সঙ্গে আমি সারদা গেলাম। গিয়ে দেখলাম আমার কিছু কলিগ, কিছু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসছে। সঙ্গে আছে ভারতীয় বাহিনী। আমাকে ভদ্রতাসূচক সালাম দিলেন। আমি আমার সিডিআইকে (চিফ ড্রিল ইন্সট্রাক্টর) নিয়ে সারদায় ঢুকলাম। পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর কাজ করলাম। অর্ডার এল মুক্তিযুদ্ধে যারা বাইরে গিয়েছিলেন, তারা আসছেন। আমার জায়গায় আসছেন আমারই ডিএসপি দুর্গাদাস লাহিড়ী। লাহিড়ীবাবু আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে চার্জ বুঝিয়ে দিলাম এবং ওএসডি হয়ে ঢাকায় ফিরলাম।
২০০৫ সালের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একান্তভাবে প্রার্থনা করব আমাদের সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ—সবাই যাতে আমরা মুুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করি। পরবর্তী প্রজন্ম জানুক, সত্যি কী ঘটেছিল।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত