বিজ্ঞাপন
default-image

‘যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হতেই দেখা গেল, শত্রু নেই। পালিয়ে গেছে।’

যুদ্ধের মাঠে এ রকম ঘটনা কমই ঘটে। আফসির করিম যখন এ কথা বলছিলেন, তখন তাঁর ঠোঁটের কোনেও মৃদু হাসির রেখা। এই ঘটনা ঘটেছিল একাত্তরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে। সে কাহিনীই বলছিলেন তিনি।

৬০ দশকের শেষদিকে কলকাতায় এসেছিলেন আফসির করিম। তখন পশ্চিমবঙ্গে নকশালদের তত্পরতা বেড়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে সেই নকশাল বিদ্রোহ দমন করার লক্ষ্যেই তাঁর কলকাতায় আগমন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি ছিলেন কলকাতায়। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার কর্মকর্তা। যুক্ত হয়েছেন প্যারাব্যাটালিয়ন কমান্ডে। প্যারাসুটের মাধ্যমে যুদ্ধ বিমান কিম্বা হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করে যুদ্ধে অংশ নেয়া ছিল এই কমান্ডের কাজ।

ভারত যখন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, তখনই ডিসেম্বরের শুরুর দিকে একটি অভিযানে অংশ নিলেন আফসির। কথা ছিল ঝিনাইদহে নামবে তাঁর প্যারাব্যাটেলিয়ান কমান্ড। সরাসরি যুদ্ধ করবে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধের এ সময়টায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা এতোটাই নাজুক হয়ে পড়েছিল যে, যুদ্ধের মাঠেই তাদের পাওয়া গেল না। আফসিরের বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েও যুদ্ধ করা হলো না তাঁর। কী আর করা! ‘অগত্যা হেলিকপ্টার আর জঙ্গি বিমানের পরিবর্তে হেঁটে হেঁটেই শত্রুর পিছু নিয়েছিলাম।’ হাসতে হাসতে বললেন আফসির করিম।

৬ ডিসেম্বর দুপুরে গুলশানের একটি হোটেলে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আফসির করিম বললেন সেই যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগেই শত্রুরা পালিয়েছিল। তিনি এ কথা বলেন আর হাসেন।

৫ ও ৬ ডিসেম্বর লেকশোর হোটেলে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) আয়োজিত বাংলাদেশ-ভারত সংলাপে অংশ নিতে মেজর জেনারেল (অব.) আফসির করিম ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ভি আর রাঘবন ঢাকায় এসেছিলেন। তারা দুজনেই কথা বললেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

আমুদে আফসির করিম বলতে থাকেন একাত্তরের কথা। একাত্তরের পাঁচ ডিসেম্বর সহযোদ্ধাদরে নিয়ে তিনি বাংলাদেশে পা রাখেন। আর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে যান কলকাতায়। দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে থাকার সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল তাঁর। তাদের কারো সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তাঁর যোগাযোগ আর থাকেনি। পরিচয় ছিল প্রয়াত জাসদ নেতা মেজর (অব.) আব্দুল জলিলের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্য একটি বিষয়ও মনে দাগ কেটেছিল আফসিরের। এ কথা বলতে গিয়ে আফসির ফিরে যান একাত্তরে। বলতে থাকেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা ও তান্ডবলীলা আমি কম দেখিনি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর যে নৃশংসতা আমি দেখেছি, তাতে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। সৈন্য হলেও রক্ত আর ধ্বংসের চিত্র আমাকে প্রবলভাবে বিচলিত করেছিল। এখনো ভেবে বিস্মিত হই, কিভাবে একটা দেশ ধ্বংসের তাণ্ডব ও পশুত্বের আস্ফাালনের বিরুদ্ধে লড়ে এত অল্প সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করল।

তবে আমাকে স্পর্শ করেছিল কৃষ্ণনগর শরণার্থী শিবির। এমন করুণ দৃশ্য আমি জীবনে কখনো দেখিনি। সে দৃশ্য এখনো আমাকে তাড়া করে ফেরে। শিবিরে আশ্রিত উদ্বাস্তু মানুষদের অবস্থা এতটা করুণ ছিল, যা দেখে কারো পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব ছিল না। একটি যুদ্ধ মানুষের জীবনকে কোথায় এনে ফেলতে পারে, তা মানুষটির জীবনকে কতটা নির্মম পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, তারই প্রতিচ্ছবি ছিল যেন কৃষ্ণনগর শরণার্থী শিবির। একটি যুদ্ধ এক একটি পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। এমন লাখ লাখ পরিবারে হয়েছে। যাদের সব ছিল, তারাই একেবারে নিঃসহায় হয়ে স্থান করে নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। সেই দৃশ্য দেখলে সত্যিই স্বাভাবিক থাকা যায় না।

যুদ্ধের অন্য ছবির বর্ণনা দিতে গিয়ে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ’একাত্তরে কলকাতার মানুষ এতটা স্বতঃষ্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল, যে তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কলকাতায় আমি সব সময় শুনতে পেতাম ’জয় বাংলা’ ধ্বনি। বাংলাদেশের প্রতি কলকাতার মানুষের সমর্থন অব্যাহত ছিল স্বাধীনতার পর বহুদিন পর্যন্ত। ’

তাঁর সঙ্গে কথা হয় দুদেশের বর্তমান সম্পর্কের বিষয়টি নিয়েও। বর্তমানে দিল্লির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। আমরা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টি হূদয়ে ধারন করি, যারা সে সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি, তাঁরা মনে করি, দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো বিকশিত হতে পারত। কিন্তু বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী এই দুই দেশের সম্পর্ক যেখানটায় থাকতে পারত ঠিক সেখানটায় নেই। এক দেশের প্রতি অন্য দেশের আস্থাহীনতার দরুণ সম্পর্ক ঠিক সেভাবে এগোয়নি। এজন্য তিনি মূলত দায়ী করলেন আমলাদের।

আফসির বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে লোকজনের ঢুকে পড়া, উলফা (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) সহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের বাংলাদেশে অবস্থানের ব্যাপারে দুই পক্ষের অবস্থান আংশিক সত্য, পুরোপুরি নয়। তবে সীমান্তের দুই পাড়ে নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিস্থিতির উন্নতির আভাস মিলছে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে আসা-যাওয়া যতো বাড়বে, সম্পর্কোন্নয়নে তা আরো বেশি প্রভাব ফেলবে।

ভি আর রাঘবন কথা শুরু করেন ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় নিয়ে। বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের জন্য বিরাট আঘাত। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ভি আর রাঘবন এখন দিল্লি রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক। বাংলাদেশের মুক্তিযদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল পরোক্ষ। তিনি বলেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পর অনেক চড়াই উত্ড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। বাংলাদেশ ও ভারতে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ফলে সম্পর্ক উন্নতি হবে বলে আশাবাদী রাঘবন। তিনি বললেন, একাত্তরে ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। এখন দু দেশে এই দুটি দলই ক্ষমতায়। ফলে এখন দুদেশের সম্পর্কোন্নয়নে একটি বিশেষ মাত্রা যুক্ত হতে যাচ্ছে, আমরা তার আভাস পাচ্ছি।

‘আপনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে জড়ালেন?’—প্রশ্ন রাখি তাঁর কাছে।

রাঘবন বলেন, সে সময় লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে আমি ভারতীয় সেনা সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলাম। আমার কাজই ছিল মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনী এবং সম্পদের বিষয়টির সমন্বয় করা। আমি সরাসরি রণাঙ্গনে ছিলাম না, কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, পরিকল্পনার কেন্দ্রে থেকে বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মিলিত লড়াইয়ের ফসল স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মাত্র দুই সপ্তাহে স্বাধীনতা অর্জনকে আমি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে মনে করি।

মুক্তিযুদ্ধ খুব দূরের কোনো বিষয় নয়। এখনো মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের অনেকেই বেঁচে আছেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে সেনা সদস্যরা সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছে, ভারতীয় জনগণের যে অংশ সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে, তারাও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছেন এখন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এরও একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে।

ভারতের এই দুই জেনারেল যেন ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্বই করলেন। জানিয়ে গেলেন, দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক হোক, সেটাই তাঁদের প্রত্যাশা।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত