বিজ্ঞাপন
default-image

অ্যাডল্ফ হিটলারের নািস জার্মানিতে রাইখ থিয়েটার চেম্বার প্রধান হ্যান্স জোস্ট গর্ব করে বলতেন, সংস্কৃতি শব্দটি শুনলে তাঁর হাত পিস্তলে চলে যায়। চ্যান্সেলর হিসেবে হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের পরপর নািস পার্টির সদস্যরা বার্লিনে এক রাতে কুড়ি হাজার বই পুড়িয়ে যে সংস্কৃতি-সংহারক ভূমিকা নেয়, তা অচিরেই নিষ্ঠুরতম মানবসংহারক রূপ গ্রহণ করে। সংস্কৃতির বিষয়ে বর্বর দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জন্মকাল থেকে প্রদর্শন করে আসছে। বাঙালির জাতিসত্তা মুছে দিয়ে ফরমায়েশমাফিক মুসলিম জাতিসত্তা গড়েপিঠে নেওয়ার ধারণা তারা বহন করেছে এবং এই অবাস্তব লক্ষ্য অর্জনে এমনকি আরবি হরফে বাংলা লেখা অথবা আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদ্ভট প্রস্তাবও তাদের কাছে খুব উদ্ভট ঠেকেনি।

এই শাসকগোষ্ঠী সংস্কৃতি-সংহারক থেকে মানবসংহারক রূপ নিতে কিছুটা সময় নিয়েছিল এবং যখন বাঙালি জাতিকে দমনের জন্য গণহত্যামূলক সামরিক অভিযান শুরু করল, তখন সংস্কৃতিশিল্পীরাও তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ দলিলে শত্রু হিসেবে যারা চিহ্নিত হয়েছে, সেই তালিকায় সংস্কৃতিসেবীরাও রয়েছেন। পরিকল্পনার চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, ‘গ্রেপ্তার করতে হবে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের এবং শিক্ষকমণ্ডলী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যকার চরমপন্থীদের।’

শিক্ষা ও সংস্কৃতি, শিক্ষকমণ্ডলী ও সংস্কৃতি-শিল্পী, উভয়েই হয়েছিল বর্বর সামরিক আক্রমণের লক্ষ্য এবং এর ফলে দেখি, গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ একাত্তরের সেপ্টেম্বরে কিছু বই বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে, যার লেখক তালিকায় ছিলেন সত্যেন সেন, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ। এরপর ডিসেম্বরে সংঘটিত হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতম ঘটনা, যা জাতিসত্তা নির্মাণে বুদ্ধিজীবীদের বিপুল অবদানের এক নিষ্ঠুর স্বীকৃতিও বহন করে। হিটলার বাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিল বই, আর পাকিস্তানি বাহিনী জীবন্ত দগ্ধ করল বইয়ের রচয়িতা বুদ্ধিজীবীদের। জাতিসত্তা যা থাকে রক্তে বহমান, তার সঙ্গে ধর্মসত্তা যা আহরিত এবং পরিবর্তনযোগ্য, এর যে কোনো বিরোধ নেই, একই জাতিসত্তার মানুষ বিভিন্ন ধর্মসত্তা অবলম্বন করতে পারে, সেটা কেবল সংগত নয়, স্বাভাবিকও বটে, তা পাকিস্তানি শাসকচক্র কখনো বোঝেনি, বুঝতে চায়নি।

অথচ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের যিনি হোতা, সেই মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন রাজপুত এবং মানুষ যেমন ধর্মান্ধ হতে পারে, তেমনি জাত্যন্ধও হতে পারে। আর তাই যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধর্মান্ধ ফরমান আলী যখন পাকিস্তানে আটক তখন জাত্যন্ধ এক ভারতীয় জেনারেল তাঁকে বলেছিলেন, ফরমান যে এত বুদ্ধিমান কারণ তাঁর শরীরে হিন্দু রক্তের প্রবাহ রয়েছে। নিজের রাজপুত সত্তা ও বুদ্ধিমত্তার সার্টিফিকেট হিসেবে এমন উক্তি উদ্ধৃত করতে ফরমান দ্বিধা করেননি, তবে এটাই তো ইতিহাসের বাস্তবতা, মিলন-মিশ্রণ ও বৈচিত্র্য নিয়ে বিভিন্ন জাতিসত্তা বিকশিত হয়ে ওঠে, ধর্ম-বৈচিত্র্য তার অন্যতম উপাদান।

ধর্মপরিচয়কে সর্বগ্রাসী রূপ দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক যে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলো, তার ভৌগোলিক ফারাক ছিল হাজার মাইলের এবং বাস্তব এই দূরত্ব ও জাতিগত বৈচিত্র্য এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিসত্তার নাগরিকদের একক মুসলমান জাতিতে রূপান্তরে প্রবল প্রাকৃতিক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাস্তববোধের পরিচয় না দিয়ে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার পাকিস্তানি প্রয়াস তাই ক্রমে ক্রমে বর্বর শাসনে রূপ নেয়, রাষ্ট্র হয়ে উঠতে লাগল সংস্কৃতি-সংহারী, কেননা সংস্কৃতি তো জাতি চেতনার আধার।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কার্জন হলে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিবিড় ইতিহাসবোধ ও সংস্কৃতিবোধ নিয়ে বললেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য, আমরা বাঙালি। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই।’ সেই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার, মুসলিম লীগের কাতারে দাঁড়ানো সজ্জন মানুষ, তাঁর অবাঙালি সচিব ফজল আহমদ ফজলী রশীদ লাফ দিয়ে উঠে সব শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে সভাপতির ভাষণের পর দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান শুরু করলেন, বললেন, আমি কলকাতায় আছি না ঢাকায় আছি বুঝতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত হাবীবুল্লাহ বাহার তাঁকে থামিয়ে দেন বটে, তবে পাকিস্তানমনা বর্বরতা তো আর থেমে থাকেনি।

মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কথা যখন আমরা বলতে চাই, তখন এর দীর্ঘ ধারাবাহিকতা স্মরণে আনা জরুরি হয়ে ওঠে। শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক কূপমণ্ডূক সাংস্কৃতিক বর্বরতার বিরুদ্ধে উদার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতির সংগ্রামের হাতিয়ার। তাই ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনে যখন বাধা আরোপ করা হয়, যথার্থভাবে শাসকগোষ্ঠী দ্বারা রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত হন পাকিস্তানের ভাবাদর্শের বিরোধী কবি হিসেবে, তখন জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের যেকোনো আয়োজন হয়ে ওঠে প্রতিরোধের প্রবল অবলম্বন। এভাবে ষাটের দশকে যে সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা ঘটে, তা একদিকে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে এবং পাশাপাশি শৈল্পিক নবসৃজনে ব্রতী হয়। শিল্প ও সৃজনের প্রবাহে জনচিত্ত স্নাত ও আলোড়িত করে দেখতে দেখতে পাকিস্তানি তমসা দূর হয়ে বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণ বিস্তৃত ও অমোঘ হয়ে উঠতে থাকে। চল্লিশের দশকে গণনাট্য সংঘ ও গণসংস্কৃতির ধারা বলবান হয়েছিল শিল্পীদের সৃজনস্পর্শে। ষাটের দশকের বন্দী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি সংস্কৃতির সমগ্রতায় অবগাহন করে সৃজনমুখরতা একে জোগাল নতুন শক্তি। বাঙালি সংস্কৃতির সুকৃতি বৃহত্তর তাত্পর্য নিয়ে ফুটে উঠতে থাকল জনচিত্তে, যার এক অনন্য প্রকাশ ছায়ানটের পয়লা বৈশাখের প্রভাতি অনুষ্ঠান। এই পরিপ্রেক্ষিতে জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ জনপ্রিয় ও আলোড়নসঞ্চারী হয়ে ওঠে পাকিস্তানি জমানায় বাংলার রূপ-বন্দনার কাব্যরূপ হিসেবে।

লোকায়ত সংস্কৃতি তো লোকদৃষ্টির বাইরে একভাবে প্রবহমান ছিল, এক্ষণে সেদিকে দৃষ্টি পড়ছিল বিশেষভাবে। লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নাগরিক নয়, নগর-সংস্কৃতির সৃজনশীল যোগ বলবান করে তুলছিল জাতীয় সংস্কৃতি-সত্তা। উত্সবে-আয়োজনে-গানে-কবিতায়-প্রকাশনায়-চিত্রকর্মে বাঙালি রুচি ও মনন খুঁজে পায় নতুন স্ফূর্তি। ছাত্র আন্দোলনেও দেখা দেয় সাংস্কৃতিক জোয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ ও ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক তত্পরতা, একুশে-কেন্দ্রিক সংকলন প্রকাশনা ইত্যাদি নানা রূপে মূর্ত হয়ে সংস্কৃতি হয়ে উঠতে থাকে শক্তি-সঞ্চারী।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তাই যেমন ছিল গণসংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তেমনি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রতিফল। আর তাই দেখা যায়, একাত্তরের মার্চ মাসে, গণহত্যার সূচনায় পাকিস্তানি বাহিনী কয়েকটি প্রতীকী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, কামানের গোলায় বিধ্বস্ত করেছিল শহীদ মিনার, কেটে ফেলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণের ছাত্রসমাবেশস্থল বটতলার বটবৃক্ষ এবং মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রমনা কালীমন্দির। এভাবে প্রকাশ করেছিল সংস্কৃতিগত ও জাতিগত ঘৃণা ও বাঙালির প্রতিরোধ সমূলে বিনাশের বাসনা।

কিন্তু যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা প্রতিরোধ রচনা করেছিলেন। দুই ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন যে বিপুলসংখ্যক শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মী, তাঁদের অনেকে অচিরে নিজেদের সংগঠিত করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও শিল্পী সংস্থার মাধ্যমে গান-নাটক-কবিতা-কথিকার মধ্য দিয়ে সৃজন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন, গোটা দেশবাসীর কাছে প্রেরণার উত্স হয়ে ওঠেন। দেশান্তরি জীবনের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আরও অনেক সৃজনশীলতার অনুপম স্বাক্ষর রেখে মুক্তিযুদ্ধের সংস্কৃতি তথা প্রতিরোধের সংস্কৃতির কতক উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেন, যার মধ্যে জহির রায়হান নির্মিত তথ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড অনন্য হয়ে রয়েছে। দেশের ভেতরে শ্বাসরুদ্ধকর ভয়ংকর পরিবেশে বিচ্ছিন্ন ও মৃত্যুতাড়িতভাবে দিন কাটাতে হয়েছে অগণিত শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীকে। তবু যে তাঁরা শিল্পের আয়ুধ শাণিত করে লড়ার প্রত্যয় হারাননি, তারও অনেক উদাহরণ মিলবে। তবে শিল্পরূপ নিয়ে প্রকাশ্য হওয়ার কোনো সুযোগ তাঁদের ছিল না, বরং চরম ঝুঁকি নিয়ে করতে হয়েছে সৃজনের কাজ।

এর দুই উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি শামসুর রাহমানের বন্দিশিবির থেকে কবিতাগুচ্ছ এবং আনোয়ার পাশার উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত। শামসুর রাহমান সৌভাগ্যবান, প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে তাঁর পাচার করা কবিতাবলি বেনামিতে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার কারণে। আনোয়ার পাশার দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ঘাতক আলবদর বাহিনী তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি তো কখনো পোড়ে না, নিকোলাই গোগলের এই উক্তি দেশে দেশে নিগৃহীত নিপীড়িত শিল্পী-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে ব্যবহূত হয়ে থাকে। আনোয়ার পাশা নেই, তাঁর পাণ্ডুলিপি বেঁচে আছে। নিষ্ঠুর নির্মম আঘাত সত্ত্বেও তেমনিভাবে সজীব হয়ে আছে বাঙালির সংস্কৃতিধারা। কত রক্তনদী পাড়ি দিয়েছে সংস্কৃতির এই অভিযাত্রা, তা আরও নিবিড়ভাবে জানার রয়েছে, তবেই আমরা বুঝতে পারব মুক্তিযুদ্ধের সংস্কৃতি আমাদের কত বড় সম্পদ, কত গর্বের ধন।

সংস্কৃতির সংগ্রাম যখন মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হয়, জন্ম দেয় মুক্তিযুদ্ধের সংস্কৃতির, তখন এর প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে তাত্পর্যময় হয়ে দেখা দেয়, অতিক্রান্ত পথের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা বুঝতে পারি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি মোচন করে জাতি কীভাবে আপন সত্তা পুনরাবিষ্কার করে জাতি-চেতনায় সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারল। ফলে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি-চেতনা বড়ভাবে লালন করেছিল প্রতিরোধের চেতনা ও রক্তাক্ত আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলেও কখনো পরাভব শিকার করেনি। সংস্কৃতির এই সংগ্রাম তো মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি খুঁজে পায় না, বরং ভিন্ন পরিস্থিতিতে নতুন ধারায় বিকশিত হওয়ার উপায় তাকে খুঁজে নিতে হয়।

default-image

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের সংস্কৃতি বিচার তাই নবতর দায়িত্বের নিরিখে দেখা প্রয়োজন। অতীতের মূঢ়তা, অন্ধতা ও পশ্চাত্মুখিতার জের এখনো নানাভাবে সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, বাঙালি জাতি পরিচয়কে বাংলাদেশিত্বের আবরণে ঠেলে দেওয়া হয় বিভ্রান্তির পথে। ধর্মসত্তা জাতির মানসে যে স্বকীয়তা তৈরি করে, তা যে হয়ে ওঠে সংস্কৃতিরই অঙ্গ, তখন একে আর সম্প্রদায়গত বলে আলাদা করার উপায় থাকে না। আর তাই তো সংস্কৃতি সর্বদা উদার, অপরকে গ্রহণ-আলিঙ্গনে উদ্গ্রীব ও আপন শক্তিতে নানামুখী উপাদান আত্মস্থ করার মধ্যে তার বহমানতা প্রকাশ পায়।

জাতি-চেতনায় উদার আবহ বিনষ্ট করার পাকিস্তানি রাষ্ট্রিক আয়োজন ব্যর্থ হলেও বিভ্রান্তিকর প্রয়াসের তো অন্ত নেই। আর তাই ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী সংস্কৃতির ওপর বারবার রক্তাক্ত হামলা পরিচালনা করেছিল, সংস্কৃতির প্রকাশ তাদের কাছে মনে হয়েছে ধর্মবিরোধী, এমনি ঠুনকো তাদের ধর্মবোধ। অপরদিকে লোকভাষা ও লোকাচারের অভ্যন্তরীণ ফারাক বড় করে তুলে জাতি পরিচয় ও সংস্কৃতি পরিচয় খর্ব ও খণ্ডিত করার চেষ্টাও দুর্লক্ষ্য নয়। সর্বোপরি রয়েছে বিশ্বায়নের অভিঘাত, প্রবল প্রতাপশালী পণ্য-বাজার রাষ্ট্রীয় সীমা মুছে ফেলে ভোগের সংস্কৃতির সমরূপত্ব আরোপে ক্রমেই হয়ে উঠছে সর্বগ্রাসী।

পাকিস্তানি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ফরমায়েশি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গৌরবময় সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল এ দেশের মানুষ হাজার বছরের সংস্কৃতি-শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ নিবিড় করে নতুন সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে একদা জাতি-চেতনা তাত্পর্যমণ্ডিত করে প্রতিষ্ঠা করেছিল জাতিরাষ্ট্র। সেই মহত্ গৌরবের উত্তরাধিকারী জাতি কি আজ এত সহজে রণে ভঙ্গ দিয়ে হয়ে পড়বে ছত্রখান ও বিভ্রান্ত?

মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম সেই প্রশ্ন আমাদের সামনে মেলে ধরে।

মফিদুল হক: লেখক ও ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত