রক্তে ভেজা দিন
নওশাদ নুরীর কবিতা
এই যে অন্ধকার ঝুলে আছে সন্ধ্যে হওয়ার আগে
কোন সে মজলুমের আলুথালু চুলের মতো
তোপের অন্ধকার ধোঁয়ায় দিগন্তে উঠছে চাঁদ
সুর্মারঙা ছাইমাখা কোনো সাধুর মতো
কেন আজানের ছন্দ এমন হঠাৎ গেল ভেঙে
মসজিদে হালাকু খানের মতো কে পড়ল ঝাঁপিয়ে
চুপচাপ দিগন্ত থেকে নেমে এল রোদ
নিষ্পাপ চোখের কোণ বেয়ে ঝরা অশ্রুর মতো
পাছে কারও চোখে পড়ে মানুষ লুকিয়ে ফেরে
শ্বাপদের ভয়ে পালানো অসহায় হরিণের মতো
এই যে চারদিকে ছোটে রক্তের ফোয়ারা
এই যে স্তব্ধ সব জিভ, এই যে মৃত্যুর নীরবতা
কাগমারি, সন্তোষ অথবা টুঙ্গিপাড়া
এই যে উজাড় নীরবতা কথা বলে ফিসফিস করে
আমার ভাবনা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে ফেরে
আমার ভাবনা চারদিকে দেখে শুধু বুটের নিশান
দোহাজারী, সিলেট বা ঝালকাঠি
গোলার ক্ষতচিহ্ন দেখি শুধু দেয়ালের গায়ে
আঙিনায় পড়ে আছে দেখি রামের বোতল
ফৌজির বেলেল্লা চুমোচাটি ঘরের ভেতর
জানালায় দেখি আমি বেয়নেটের নিশানা
রক্তের স্রোতে ভেসে যায় শীতলপাটি
তীক্ষ্ণ ক্ষতের মতো ঢাকায় এখন করাচির কথা
কাগান থেকে রাঙামাটি এখন অনেক দূর
এ প্রেমের ভাঙন ছাড়া পথ নেই আর
যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ নেই বাকি
আর কিছু নেই দেওয়ার শুধু ঘৃণা ছাড়া
(‘লোহু মেঁ শারাবোর দিন’, কবিতার অনুবাদ; পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ ১৯৭১–এ রচিত)
সশস্ত্র সৈনিকেরা
(পাকিস্তানি ফৌজি নীতি)
হাতিয়ার হাতে হে সৈনিকেরা
কল্পনাই তো সেই সীমান্ত
তোমাদের যত দাবানো রায়ত
শুনি নেমে গেছে লড়াই করতে
বাঙালি–শরীর কোমল পেলব
বাঙালির লোহু আলোকমাল্য
রক্তধারাই আঁকছে এখন
দেখায় বাংলা নয়া সীমানার
এত যে সবুজ ধীরে ধীরে আজ
রক্তের লালে হচ্ছে ঘেরাও
অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না
যত আছে ভিত নিচ্ছে ভাসিয়ে
অস্ত্রহীনের রক্তফোয়ারা
দিনে দিনে হয় অঙ্গার–হ্রদ
অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না
লাশেরা এখন তুলছে দেয়াল
অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না
যুদ্ধকুশল দক্ষ সবার
পালাবার কোনো পথ নেই আর
হাতিয়ার হাতে হে সৈনিকেরা
(‘মাসসালাহ ফৌজ’ কবিতার অনুবাদ)
কালবৈশাখী
আহমদ ইলিয়াসের কবিতা
আমি দেখছি
কালো ঝড়ের পেছনে কালো চেহারা, কালো লশকর
কালো বল্লম, কালো বর্শা
কাতারে কাতারে হাতে তুলে কালো পতাকা
আসছে আমাদের গ্রামে
আমি শুনি কালো ঘোড়াদের খুরের আওয়াজ
কানে বাজে কালো বুটের ধ্বনি
আমি দেখছি
গ্রামে আমাদের প্রলয় বয়ে যায়
উপড়ে পড়ে গাছ, ধসে যায় দরজা
কালো ঝড় হাতে নিয়ে কালো পতাকা
বসিয়ে দিচ্ছে মাটির বুকে
সেই বুক ঘোড়ার পায়ে হচ্ছে ক্ষত
আমি দেখছি
ঘর দরজা দেয়ালের চিহ্নমাত্র নেই
জমির বুক আঘাতে রক্তিম
কোথাও বর্শা কোথাও বল্লম
কোথাও বিঁধেছে তার তির
আমি দেখছি ঘরের তরুণ সব মুখ
কালো ঝড়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে
ভোরের আগে চুপচাপ পড়েছে শুয়ে
পলকে পলকে অশ্রু হয়ে
আমি জানি, তবু আমি জানি
কালো ঝড়, এই কালো লস্কর
দুইয়েরই নিয়তি পরাজয়
আমি জানি, আমি জানি
প্রদীপ নিভেছে যে ঘরে
সূর্য সেখানে উঠবেই
(‘কাল ব্যায়সাখি’ কবিতার অনুবাদ)
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত