বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেসরকারি প্রয়াসের ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। কোনো একদিন কাজটা সম্পন্ন হবে বলে আশা করি। তাতে নানাদেশের মানুষের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদেযাগের পরিচয় লিপিবদ্ধ থাকবে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে এদেশের মানুষের যেসব প্রয়াস তার কথাও নিশ্চয় থাকবে। সেই সময়সাপেক্ষ ও যত্নসাধ্য কাজটি এখনই করা যাচ্ছে না। এই প্রবন্ধে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বাঙালিরা কী ধরনের কাজ করেছে, মোটাদাগে সে-সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। কোথাও ব্যক্তির নাম-পরিচয় উল্লেখ করা যাবে, কোথাও উদেযাগের আড়ালের মানুষদের চিনিয়ে দেওয়া যাবে না—সে-সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই বলে।

২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র ও নিঃসহায় জনসাধারণের ওপরে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী উঁচু মানের মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন হাজার হাজার মানুষ যেমন প্রাণ দেয়, তেমনি কিছু কিছু প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। আত্মরক্ষার্থে হলেও পিলখানায় ইপিআর বাহিনী এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশেরা যুদ্ধ করে, অনেকে অস্ত্র নিয়েই শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়। কয়েকটি সেনাছাউনিতেও এমন ঘটনা ঘটে।

সেনাবাহিনী ও ইপিআরের সদস্যেরা ছাউনি ছেড়ে রাজপথে বেরিয়ে এসে প্রতিরোধে নামে—বেসামরিক কর্মকর্তা ও জনসাধারণের একাংশ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীরাও সশস্ত্র প্রতিরোধে ছড়িয়ে পড়ে, অনেকেই জীবন বিসর্জন দেয়। এ-সময় থেকেই সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য ও পানীয় দিয়ে, খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করে বিজয় লাভের পূর্ব পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের নটি মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রয়োজনীয় মানচিত্র সরবরাহ করেছেন, অনেক কলকারখানা, তেলের ঘাঁটি, তৈল-শোধনাগার প্রভৃতির নকশা সরবরাহ করেছেন সেখানকার কর্মকর্তারা। অর্থ, ওষুধ ও কাপড়চোপড় সংগ্রহ ও সরবরাহে নিয়োজিত ছিলেন অনেকে।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ভারতে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে সেদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ যেমন কাজ করেছেন, তেমনি যেসব বাঙালি স্থায়ীভাবে বা সাময়িকভাবে ইউরোপ, আমেরিকা এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বাস করতেন, তাঁরাও স্বদেশের জন্যে নানা কিছু করেছেন।

ভারতে গঠিত হয় কয়েকটি সংগঠন। বাংলাদেশের সবধরনের শরণার্থী শিক্ষকদের নিয়ে কলকাতায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক হন এর সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. খান সারওয়ার মুরশিদ কোষাধ্যক্ষ। সাধারণ সম্পাদক প্রথমে আমি, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. অজয় রায়। এই সংগঠন বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের কাছে এবং শিক্ষক-সংগঠনের কাছে বাংলাদেশে পাকিস্তানের অত্যাচার, শিক্ষকদের প্রতি নিগ্রহ এবং ভারতে শরণার্থীদের দুরবস্থা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদানের দাবির প্রতি তাঁদের সমর্থন কামনা করে। তার আগেই কলকাতায় আরেকটি সংগঠনের পত্তন হয়: বাংলাদেশ লিবারেশন কাউনসিল অফ দি ইনটেলিজেনসিয়া। ড. মল্লিক এর সভাপতি, খান সারওয়ার মুরশিদ, সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসান ও রণেশ দাশগুপ্ত সহ-সভাপতি, জহির রায়হান সাধারণ সম্পাদক, ড. বেলায়েত হোসেন যুগ্ম সম্পাদক। এই সংগঠনও একই ধরনের কাজ করে। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর বিচারকার্যের প্রতিবাদে এই দুই সংগঠন আগস্ট মাসে কলকাতায় একটি বড়ো জনসমাবেশ করে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির একটি প্রতিনিধিদল উত্তর ভারতের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (এলাহাবাদ, আলিগড়, দিল্লি, জওহরলাল নেহরু, আগ্রা ও লখনউ) এবং সেসব বিশ্ববিদ্যালয়-শহরে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতি কিংবা শরণার্থীদের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার সুযোগলাভ করে। আরেকটি প্রতিনিধিদল যায় মধ্যপ্রদেশে, অপরটি বোম্বাই অঞ্চলে।

সন্জীদা খাতুনের সভাপতিত্বে এবং ওয়াহিদুল হকের পরিচালনায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা। শতাধিক শিল্পী ছিলেন এই সংগঠনে। মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের শিবিরে সংগীত পরিবেশন করে এঁরা শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করতেন। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরা কলকাতায় একটি চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশ স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের উদেযাগে ফুটবল খেলোয়াড়েরা কলকাতার ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলেছিলেন। এভাবেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচারকাজ সম্পন্ন হয়েছিল। ড. অজয় রায়ের সভাপতিত্বে এবং আহমদ ছফার সম্পাদকতায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবির, তবে এ-প্রতিষ্ঠান খুব সক্রিয় হতে পারেনি বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্টস অ্যান্ড টেকনিশিয়ানস অ্যাসোশিয়েশন নামেও একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাঙালি কূটনীতিকদের পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ ছিল এর বড়ো ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ও শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্যে নানা সংগঠন গড়ে ওঠে। এমনিতেই অনেকগুলি সংগঠন ছিল—ছাত্রদের, নারীদের, চিকিত্সকদের কিংবা নানা অঞ্চলের বাঙালিদের স্থানীয় সংগঠন। ২৫ মার্চের অব্যবহিত পরে আবার তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে নানা সংগ্রাম পরিষদ। শেষ পর্যন্ত সব মিলিয়ে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন দি ইউকে। যুক্তরাজ্যব্যাপী বাঙালিরা নানা উদেযাগে সামিল হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভায় এক মানবাধিকার সম্মেলনে এসেছিলেন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে। জেনেভা থেকে লন্ডনে এসে দেশের খবর পেয়ে তিনি লন্ডনেই রয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে। তাঁর নেতৃত্ব বাঙালিদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত করে। লন্ডনের পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী কূটনীতিকরা সেখানকার আন্দোলনকে গতি দিতে সাহায্য করেন। যুক্তরাজ্যের বাঙালিরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকার এম পিদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন চেয়ে পত্র দেন, পাকিস্তান সরকারকে গণহত্যা বন্ধ করতে ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদান করতে ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানান। হাইড পার্কে ছোটো সভা হয়, বিশাল সমাবেশ হয় ট্রাফালগার স্কোয়ারে। তহবিল সংগ্রহ করে নানা সামগ্রী পাঠানো হয় ভারতে আগত শরণার্থীদের জন্যে। বাংলাদেশ সরকারেকে সহায়তা করা হয় নানাভাবে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও প্রচারপত্র-পুস্তিকা ইত্যাদি মুদ্রিত হয়। জনমত গঠনে এগুলির বিশেষ মূল্য ছিল।

ইউরোপের অন্যত্রও কিছু কিছু কাজ হয়। হল্যান্ডে বাংলাদেশের পক্ষে একটি ওয়ার্ক গ্রুপ গড়ে ওঠে। সুইডেনে বাংলাদেশের পক্ষে একাই একটি মিশন চালান প্রাক্তন কূটনীতিক আবদুর রাজ্জাক। ফ্রান্সের বাঙালিরাও সমবেতভাবে কিছু কাজের উদেযাগ নেয়।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী মিশন থেকে পদত্যাগ করেন এ এইচ মাহমুদ আলী। পরে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে সকল কর্মকর্তা বেরিয়ে আসেন। তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কূটনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে যান। ছাত্রেরা এবং যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী বাঙালিরা নানা ধরনের কাজকর্মে লিপ্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ রাজ্যেই গড়ে ওঠে সংগ্রাম পরিষদ, সর্বোপরি থাকে বাংলাদেশ লিগ অফ আমেরিকা ও বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ। ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা হয় সিনেট ও কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে। সিনেটে সাক্ষ্য দেন কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি। নিউজলেটার প্রকাশও ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে। পাকিস্তানি জাহাজ থেকে বাঙালি নাবিকরা পক্ষত্যাগ করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। পাকিস্তানে অস্ত্রসাহায্য বন্ধ করার জন্যে এবং মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তানপন্থী আচরণ পরিবর্তনের জন্যে দাবি জানানো হয়। আগস্ট মাসে ম্যাডিসন স্কোয়ারে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের উদেযাগে অনুষ্ঠিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ বিরাট সাড়া জাগায়।

কানাডায়ও বাঙালিদের তত্পরতা দেখা যায়।

পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে টোকিও, হংকং ও জাকার্তায়ও পদত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক এবং মুষ্টিমেয় বাঙালি মিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত-সৃষ্টির চেষ্টা করেন।

এমনি করে ১৯৭১ সালে বেসরকারি বাঙালিরা যোগ দিয়েছিলেন জীবনপণ সংগ্রামে। অনেকেই নিয়েছিলেন অনেকরকম ঝুঁকি। সেদিন সকলেরই লক্ষ্য ছিল এক—চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা যে ফলপ্রসূ হয়েছিল, তা বলা বাহুল্য।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত