বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াস চলছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়েছে মিথ্যা, বিকৃত ও ফরমায়েশি গল্প, যার কোনো মৌলিক ভিক্তি নেই। একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনো আকস্মিক ঘটনা হতে পারে না বরং দীর্ঘদিনের সংগ্রাম সাধনার ফল হিসেবেই প্রতিভাত হয় একটি জাতির জীবনে। তাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার ঘোষণাটি সমুজ্জ্বল। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালিই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দেশ ও জাতির প্রতি অকৃত্রিম সেবা দিয়েছিলেন বলেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিল।

মেজর জিয়ার ঘোষণাটি নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল এ যাবত্কাল যত ঢঙ্কা-নিনাদই করুক না কেন ইতিহাসের মানদণ্ডে তা টিকবার নয়। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো জীবদ্দশায় মেজর জিয়া স্বয়ং এ রকম দাবি কখনোই কোনোখানে করেননি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি তার দেওয়া। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ম্যাগাজিনটিতে ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে একবারের জন্যও ভুল করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কৃতিত্বটি দাবি করতে পারেননি।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলা ও বাঙালির স্বার্থবিরোধী একটি মহল ক্ষমতায় থেকে ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত সব বিনষ্ট করার পর এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করে জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় মেতেছে। জাতির ওই সংকটকালীন মুহূর্তে জিয়াউর রহমানের দেওয়া ঘোষণাটি ছিল নিঃসন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ। ২৫ মার্চের পরবর্তী কালের ঘটনা ধারায় হতবিহ্বল জাতি যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পতিত ঠিক তখনই একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা জাতিকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন। তার সেই ঘোষণা সমগ্র জাতিকে নতুন উদ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা দিয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ও রাজনৈতিক সংগ্রামের পটভূমিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মহাপ্রলয়ঙ্করী ফলাফলে জাতির জীবনে যে আদর্শবাদী নেতা ও নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে সেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ নয়। ১৯৭১ সালের ঘটনা ধারার আগেও পল্টনের জনসমাবেশ থেকে যেমন অনেকেই ‘স্বাধীনতা’র ঘোষণা তুলেছিলেন(!) কিন্তু সেগুলো যেমন স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত নয়, তেমনি জিয়াউর রহমান প্রদত্ত একটি বিচ্ছিন্ন ঘোষণাও দেশে-বিদেশেও ইতিহাসের পাতায় স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কোনো বিষয় নয়। সেটি জিয়াউর রহমান স্বয়ং জানতেন বলেই তার জীবদ্দশায় অনাহূত এ জাতীয় হীন বিতর্কে নিজেকে জড়াননি। বরং তার ঘোষণাটি যে ‘অন বিহ্যাফ অব বঙ্গবন্ধু’ (বঙ্গবন্ধুর পক্ষে) দেওয়া হয়েছে সেই সজ্জন স্বীকৃতিই বারবার দিয়ে গেছেন। কিন্তু বিজাতীয় স্বার্থান্বেষী মহল দেশের ক্ষমতায় বসে নিজেদের মনগড়া ইতিহাস জাতিকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে। এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমরা জাতির সামনে তুলে ধরছি ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলো, যা ছিল আলো-আঁধারিতে ভরা।

default-image

তুলে ধরছি সেদিন মার্কিন প্রশাসন ও পত্রপত্রিকাগুলো কী বলেছে সেই তথ্য ও প্রামাণিক দলিল, যা থেকে পরিষ্কার হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে প্রবাসী মোহাম্মদ এম রহমান জালাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রামাণ্য ইতিহাস সংগ্রহ ও প্রচারে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। স্বদেশের লাইব্রেরি ও বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে পরিকল্পিতভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত রেকর্ড, তথ্য-উপাত্তগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। এমন সময়ে আমাদের সময়কার নির্ভীক ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এম রহমান জালাল নিরলস সংগ্রাম সাধনায় মগ্ন আছেন পৃথিবীর সমগ্র তথ্যভাণ্ডার থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঠিক অধ্যায়গুলো তুলে আনা ও সংরক্ষণের কাজে। সাম্প্রতিককালে মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত গোপন প্রামাণ্য তথ্য ও দলিল, তত্কালীন কংগ্রেসে বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনা ও মার্কিন প্রভাবশালী পত্রিকায় বর্ণনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার স্বীকৃতিটি কীভাবে এসেছে সেসব তথ্য নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রহ করেছেন এম রহমান জালাল। তাঁর সংগৃহীত এসব তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনার মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসবে আসলে কে, কখন স্বদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। সেসঙ্গে এই নিয়ে অনাহূত বিতর্কেরও অবসান ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।

২৬ মার্চ ১৯৭১ পূর্বাঞ্চলীয় সময় ২টা ৩০ মিনিটে ‘পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ’ শিরোনামে ডিফেন্স ইন্টিলিজেস এজেন্সি ‘স্পট রিপোর্ট’ পাঠায় হোয়াইট হাউসের ‘সিচুয়েশন রুমে’। প্রতিবেদনটি শুরু হয় এভাবে:

‘‘আজ দুই অংশে বিভক্ত পাকিস্তানের একটি অংশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বাঞ্চলকে ‘স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দিলে দেশটি আচম্বিতে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।”

এরপর প্রতিবেদনটিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আকস্মিক হামলা ও বাঙালির প্রতিরোধের ঘটনার উল্লেখ আছে। শেষে ‘পূর্বাঞ্চলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো পশ্চিমাঞ্চলের হিংস্র আক্রমণের মুখে আরও চরমপন্থী হয়ে উঠে মার্কিন স্বার্থের বিপক্ষে চলে যেতে পারেন’ বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে প্রেরিত দূতাবাসের একটি গোপন টেলিগ্রাম, যেটি পাঠানো হয় ৩১ মার্চ ১৯৭১। এতে বলা হয়েছে—

“নিম্নোক্ত প্রতিবেদনটি পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সারসংক্ষেপ তুলে ধরছে: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে চলমান সমঝোতামূলক আলোচনা ভেঙে দিয়ে ইসলামাবাদে ফিরে যাওয়ায় ২৫-২৬ মার্চ রাত্রিতে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আকস্মিকভাবে চরম অবনতির দিকে মোড় নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কঠিন কঠোর সামরিক অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে সামগ্রিক রাজনৈতিক তত্পরতাকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা এবং ২৪ ঘণ্টার সান্ধ্য আইন। সামরিক বাহিনী নির্দয় নিষ্ঠুরতার সঙ্গে ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢাকা শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য চষে বেড়াচ্ছে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ২৬ মার্চের এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ ছাড়া ইয়াহিয়া দেশের দুই অংশের রাজনৈতিক তত্পরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

এদিকে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা এই হিংস্র আক্রমণের মুখে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তারা গোপন আস্তানায় গিয়ে লুকানো বেতার কেন্দ্র থেকে জাতিকে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। এই সব ঘোষণার প্রাথমিক ঘোষণাটিই ছিল ‘সার্বভৌম এবং স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ র ঘোষণা যেটি করা হয়েছে মুজিবের নামে।

২৭ মার্চ এই গুপ্ত বেতার কেন্দ্র থেকে ‘মেজর জিয়া খানে’র নেতৃত্বে বিপ্লবী সামরিক বাহিনী ও অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।”

১৯৭১ সালের মার্কিন কংগ্রেসের যে আলোচনা লিপিবদ্ধ করা আছে, সেখানে ২৭ জুলাই ১৯৭১, মঙ্গলবারের সংসদীয় আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত আছে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা’ সংক্রান্ত অধ্যায়টি। সেই আলোচনায় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ) নিউইয়র্কস্থ সদস্য স্যেস্যুর হ্যালপার্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটির কথা উপস্থাপন করেন এভাবে:

“জনাব স্পিকার, রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক অ্যালবার্ট ব্ল্যাস্টিন কলকাতাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে গত ১০ এপ্রিল ১৯৭১, স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণার যে প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়, তার একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছেন। সেই স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠটি এ রকম:

‘যেহেতু এই অবস্থায় এ রকম বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণ করা হয় (বাঙালি জাতির সঙ্গে) সেহেতু বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকারের পরিপূর্ণতাদানের জন্য যথাযথরূপে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে দেশের সম্মান ও অখণ্ডতা রক্ষার আহ্বান জানান এবং এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র বলে বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দেন এবং তদনুযায়ী ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাটিকে (এই সভা) অনুমোদন করছে।”

প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ শনিবারের সংখ্যায় প্রথম পাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার তলে ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণদানরত বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংবাদ সম্মেলনের একটি ছবি নিম্নোক্ত শিরোনামে ও সংবাদে ফলাও করে প্রকাশ করে:

‘পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী নেতাকে আটকের খবর—ওই অঞ্চলের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পরপরই শেখ মুজিব গ্রেপ্তার—ঢাকার সান্ধ্য আইন শিথিল—শহরে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর সুবিধাজনক অবস্থানের থাকার দাবি—ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান’

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস(এপি) পরিবেশিত নিউইয়র্ক টাইমসের মূল সংবাদের প্রথম অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে:

‘নয়াদিল্লি, শনিবার, ২৭ মার্চ: পাকিস্তান রেডিও আজ ঘোষণা করেছে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন শহরে প্রকাশ্যে বিদ্রোহের সূচনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছেন।’

এই একই সংবাদে কয়েক অনুচ্ছেদ পরে গুপ্ত বেতার কেন্দ্রের (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) বরাত দিয়ে নিম্নোক্ত সংবাদ পরিবেশন করা হয়:

‘গুপ্ত বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত সংবাদে বলা হয়েছে, যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল (যথা: সিলেট, যশোর, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা) পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘিরে ফেলেছে।

শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র নেতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য সর্বস্তরের জনগণকে তারই (শেখ মুজিবের) প্রতিটি নির্দেশ অবশ্যই পালন করতে বলা হয়েছে।’

প্রভাবশালী আরেক মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ২৯ মার্চ ১৯৭১ সোমবারের সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরেছিল এভাবে:

‘পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলের রাজধানী ঢাকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রেডিও পাকিস্তান দাবি করেছে, বর্তমানে শান্ত অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানজুড়েই বিরাজ করছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারীরা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছেন যে, এই গৃহযুদ্ধে তারা জয়ী হতে যাচ্ছে। বিদ্রোহীরা বলেছে যে, তারা একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেছে এবং তাদের বাহিনী রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়া (ইউএনআই) এক গুপ্ত বেতার কেন্দ্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, রহমান (শেখ মুজিবুর রহমান) বিপ্লবী বাহিনীর সদর দপ্তরে আছেন, কিন্তু সদ্য ঢাকা ত্যাগকারী অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক রিপোর্টার বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে বেশ জোরগলায় দাবি করেছেন যে, রহমান (মুজিব) ও তার অধিকাংশ বিশ্বস্ত অনুসারীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত সপ্তাহান্তের সংঘর্ষে ৫ থেকে ৭ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।’

আরেক প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট এপি পরিবেশিত নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সংবাদটিই ‘পাকিস্তান যুদ্ধে বিদ্রোহী নেতা গ্রেপ্তার’ শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করে একই দিন অর্থাত্ ২৭ মার্চ ১৯৭১, শনিবার।

এদিকে ৫ এপ্রিল ১৯৭১, টাইম ম্যাগাজিন ‘পাকিস্তান: ধ্বংসের প্রান্তসীমায়’ শিরোনামে যে বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ প্রকাশ করে সেখানে বলা হয়:

‘সামরিক বাহিনী ২৪ ঘণ্টা মেয়াদের কঠিন সান্ধ্য আইন ঢাকা শহরে বলবত্ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের (চট্টগ্রামের কোনো জায়গা থেকে) সম্প্রচার শুরু হলে তা মানুষকে নতুন করে নড়েচড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে। এই গুপ্ত বেতার কেন্দ্র থেকেই মুজিব ‘সার্বভৌম স্বাধীন বাঙালি জাতি’ (রাষ্ট্র) গঠনের ঘোষণা দেন এবং স্বীয় দেশবাসীকে যেকোনো মূল্যে স্বদেশের মাটি থেকে শত্রুবাহিনীকে উত্খাতের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।’

ওই একই দিন (৫ এপ্রিল, ১৯৭১) প্রভাবশালী নিউজউইক ম্যাগাজিন ‘পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে আকণ্ঠ নিমজ্জিত’ শিরোনামায় দীর্ঘ বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পূর্বাপর সব ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরে এই প্রতিবেদনে স্বাধীনতার ঘোষণাদানের অংশটিতে বলা হয়:

‘আলোচনা ও সমঝোতার পথ থেকে আকস্মিকভাবে সরে এসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সামরিক অভিযান শুরু করলে মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (বাংলা জাতি) বলে ঘোষণা দেন। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয়।’

‘কিসিং’স কনটেম্পোরারি আর্কাইভস’-এ সংরক্ষিত ‘পাকিস্তান: পূর্ব পাকিস্তান গৃহযুদ্ধ’ শিরোনামে মে ১-৮, ১৯৭১, পর্বের এক প্রতিবেদনে যে বর্ণনা আছে, সেটা এরকম:

‘ ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইয়াহিয়া মুজিব, ও ভুট্টোর মধ্যকার গোলটেবিল বৈঠক আবারও অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তখন শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ ‘বাংলাদেশ’ (বাংলা জাতি) নামে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে স্বাধীনতার ডাক দিলে পূর্ব পাকিস্তানে আকস্মিকভাবে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।’

একই প্রতিবেদনের পরবর্তী অনুচ্ছেদে “গৃহযুদ্ধের সূচনা—আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা—রাজনৈতিক তত্পরতা নিষিদ্ধ—প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে অভিযুক্তকরণ” অংশে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ সংগঠনের পর্যায়কে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে নিম্নোক্ত বর্ণনায়:

‘২৬ মার্চ যখন একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়, তখনই পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ মাত্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। গুপ্ত বেতার কেন্দ্রের এই প্রচারণা, যা ভারত থেকে শোনা গেছে, তাতে বলা হয়েছে যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, বরিশাল এবং খুলনায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং পূর্বাঞ্চলের পুলিশ বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে। তাদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি এই বেতার কেন্দ্র থেকে শেষ শত্রু নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে, (যিনি গোপন আস্তানায় আছেন বলে বলা হচ্ছে)—স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র নেতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসন থেকে দেশকে রক্ষার জন্য তাঁর প্রতিটি নির্দেশ পালন করতে জনগণকে আহ্বান জানানো হয়েছে।’

২৭ মার্চ ১৯৭১ শনিবারের লস এঞ্জেলস টাইমস দৈনিক পত্রিকাটি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধীনতার দাবিতে গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে’ শিরোনামায় নিজস্ব প্রতিবেদক উইলিয়াম জে. কফলিনের নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়: “শেখ মুজিবুর রহমান গত শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে এই মুসলিম দেশটির দুই অংশের মধ্যে এতদিন ধরে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব-কলহ প্রকাশ্য গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এখানে (নয়াদিল্লি) শ্রুত ‘স্বাধীন বাংলার কণ্ঠস্বর’ নামে পরিচিতি দানকারী একটি গুপ্ত বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে ৭ কোটি পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে সার্বভৌম-স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেছেন।”

মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তান সংক্রান্ত আলোচনা লিপিবদ্ধ করা আছে যেসব দলিলে সেখান থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বিষয়টি আবারও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

১৯৭১ সালের ১৮ মে প্রকাশিত ‘কংগ্রেসনাল রেকর্ড-সিনেট’ নথিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে বিগত ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর মূলত মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে অতর্কিত আক্রমণ চালায় সে-সংক্রান্ত বিতর্ক। এই অধ্যায়ে সদস্য মি. চার্চ ‘পাকিস্তানে আমাদের অস্ত্র সরবরাহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’ প্রস্তাবনার পক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে পূর্ব বাংলায় ঘটে চলা পূর্বাপর ঘটনাধারা তুলে ধরতে গিয়ে এক পর্যায়ে ফরাসি প্রভাবশালী পত্রিকা লা-মন্ডের ১ থেকে ৭ মে ১৯৭১ সংখ্যাগুলো থেকে বিস্তৃত উদ্ধৃতি দিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরেন। মি. চার্চের তুলে ধরা লা-মন্ডের উদ্ধৃতিটি নিম্নরূপ: ‘পাকিস্তান-রক্তস্নানের সপ্তাহ’ শিরোনামে জে. ব্যার্ড ভিব্যাটেল্যে’র প্রতিবেদন: ‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যথাসময়ে পাকিস্তান রক্ষা পেয়ে যাওয়ার জন্য।’

এটি ছিল এর আগের সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার সংবাদ শোনার পর পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আজ খুবই নগণ্যসংখ্যক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক পাওয়া যাবে, যারা ভুট্টোর সঙ্গে একমত হয়ে এই ধারণা পোষণ করবে যে পাকিস্তানের ঐক্য বাস্তবিকই রক্ষা পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ মধ্য রাত্রির পর অর্থাত্ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সে সংবাদ ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদপত্র অফিসসমূহে যে বার্তা প্রেরণ করে তারই একটি টেলিপ্রিন্টার অনুলিপির ভাষ্য এখানে উপস্থাপন করছি:

“প্রজাতন্ত্র: ‘আগরতলা মার্চ ২৬: পিটিআই: আজ রাত্রে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন।” এই নিউজ ফ্ল্যাশটি বিবিসির টেলিপ্রিন্টার ধারণ করে সামরিক সময় ২১০৭ ঘণ্টায়। পিটিআই ঠিক এক মিনিট পরেই (২১০৮ ঘণ্টা) পাঠানো আরেকটি সংবাদে আরেকটু বিস্তারিত বিবরণ দেয়, সেটি এরকম:

“পাক-প্রজাতন্ত্র দুই আগরতলা-পিটিআই: আজ রাত্রে এক গুপ্ত বেতার কেন্দ্র, যারা নিজেদের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে, সেখান থেকে এক ঘোষক এই ঘোষণা করেছেন যে, ‘শেখ (মুজিবুর রহমান) পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।”

আরেক সংবাদ সংস্থা ইউএনআই এই একই সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে পাঠায়, যার ভাষ্যরূপ ছিল এ রকম:

ফ্ল্যাশ: মুজিবর রহমান ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন— ইউএনআই। একই সংবাদ সংস্থা ইউএনআইর পরবর্তী সংবাদ ঝলকটি নিম্নরূপ:

‘শিলং, মার্চ ২৬ (ইউএনআই)

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আজ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের কথা ঘোষণা করেছেন।’

সামগ্রিকভাবে এই আলোচনা থেকে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সেই স্বীকৃতি আজও লিপিবদ্ধ করা আছে। আজ যারা অন্য কাহিনী শোনাতে চাইছেন তারা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন।

যে সব মার্কিন প্রামাণ্য দলিল ও সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে: মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ সংক্রান্ত আলোচনা, ব্যুরো অব ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চের গবেষণাকর্ম; নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, ওয়াশিংটন পোস্ট, বাল্টিমোর সান, লস এঞ্জেলেস টাইমস, টাইম ও নিউজউইক সাময়িকী।