বিজ্ঞাপন
default-image

আমাদের গ্রামের নাম টগারচর। জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের একটি পল্লিগ্রাম। ১৯৭১ সালের মে মাস হবে। গ্রামে খবর আসতাছে কাতারে কাতারে বাঙালিরা যুদ্ধ করবের যাইতাছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে গ্রামের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দিগ্বিদিক ছুটছে। একই গ্রামের আমার চাচাতো ভাই মফিকুল ইসলাম বাবলু, ইসলামপুরের ভেঙ্গুরার সুলতানসহ ৮-১০ জন একত্র হইয়া বাড়ি থেকে বাইর হই। ইসলামপুরের এমপি রাশেদ মোশাররফের কাছে যাই।

পরে সেখান থেকে চিঠি নিয়া সবাই রওনা করি ভারতের দিকে। অনেক ভয়ভীতির মধ্যে আমরা দেওয়ানগঞ্জের জহির চেয়ারম্যানের বাড়িতে পৌঁছাই। এক রাত থাকি। পরের দিন বকশীগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সারমারা ক্যাম্পের পাশ দিয়া সীমান্ত পার হই। ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ থানায় যাই। সন্ধ্যায় থানার পাশে এক বাড়িতে থাকি। মেলান্দহের আবদুল হাই বাচ্চু মিয়া আমাদের ইয়ুথ ক্যাম্পে নিয়ে যান ট্রেনিং করার জন্য। সেখানেই অন্যান্য বাঙালির সঙ্গে জঙ্গল কাটি। ক্যাম্প তৈরি করি। সেখান থেকে কয়েক দিন পর আমাদের পাঠানো হয় চিচিঙ্গাপাড়ায়। ওখানেও ক্যাম্প বানানো হয়। থাকলাম ১০-১৫ দিন। এরপর প্রকাশিয়ায় যাই। সেখান থেকেই আমাদের হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য তুরা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তুরা ক্যাম্পে ২৯ দিন ট্রেনিং করি। রাইফেল চালনা এবং গ্রেনেড মারা শেখানো হয়।

প্রশিক্ষণে আমাদের সাহস দেখানো হতো। তাঁরা বলতেন, একটা করে পাকিস্তানি ফোর্সের পেছনে ১০-১৫ জন করে মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হবে। ভয় নাই। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির স্টক শেষ করতে হবে। তুরার প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নাছির উদ্দিন কোম্পানির অধীনে যুদ্ধে পাঠানো হয়। তখন সেপ্টেম্বর মাস হবে। দিন-তারিখ মনে নেই। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে অস্ত্র নিয়া একদিন সন্ধ্যার পর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা রওনা দিলাম কামালপুর ক্যাম্পের দিকে। ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনীর কামালপুর ক্যাম্পের চারদিকে আমরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিই। আমরা একটা গুলি ফুটাই। অরা বৃষ্টির মতো হাজার হাজার গুলি করত। আমরা তো একটা ফুটাইয়াই কাইটা পড়ছি। কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কয়েক দিন গোলাগুলি চলে। একদিন আমরা সবাই পজিশন নিছি। পাকিস্তানি সেনারা সমানে গুলি করতাছে আমাদের দিকে। সমানে শেল মারতাছে। অই সময় আমার সাথিদের বেশ কয়েকজন শেলের টুকরার আঘাতে আহত হন। শেলের টুকরার আঘাতে আমার বাঁ হাতের কবজির মাংস উড়ে যায়। রক্ত ঝরতে থাকে। সাথিরা আহত সবাইকে মহেন্দ্রগঞ্জের হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে আমরা ২০ দিন চিকিত্সা নিই। সুস্থ হওয়ার পর আবার কামালপুর ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিই। পরে সেখান থেকে আমাদের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুরের নকশী, বারোয়ামারী হয়ে আবার ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ হয়ে মেলান্দহের নিজ বাড়ি ফিরে যাই।

যুদ্ধের পর আমার মা ছবুরন মারা গেছেন। আজকে আমার মাকে বেশি মনে পড়ে। মা প্রথম যাইতে দিতে চান নাই। নিষেধ করেছেন। ফিরি কি না ফিরি, এ জন্য হয়তো। মাকে না জানাইয়াই বাড়ি থেকে বাইর হই। বললে যাবার দিতেন না। যুদ্ধ শেষে প্রায় নয় মাস পর বাড়িত যাই। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মায়রে ডাক দিলাম। বলি, আমি খলিল। দেখে মনে হলো কানতে কানতে হয়তো মায়ের চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষজনের কাছে শুনেছি, রাজাকার-বদর বাহিনীর লোকজন অনেক অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। অনেকের বাড়িঘর লুটপাট করে পুড়িয়ে দিয়েছে।

দেশ স্বাধীনের ৪০ বছরেও আমার কষ্ট গেল না। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয়হীন হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের ফাঁসি চাই। তাদের বিচার যেন আমরা দেখবার পাই।

অনুলিখন: মোস্তফা মনজু, জামালপুর

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত