বিজ্ঞাপন
default-image

উনসত্তরে এ দেশে একটি গণ-আন্দোলন হয়েছিল। ওই আন্দোলনে তরুণ একটি প্রজন্মের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিল র‍্যাডিক্যাল ধারণা। জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ওই সময় আমি সুকান্ত পড়ি—‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ’। কাকতালীয়ভাবে আমি তখন আঠারো। আমার এক হাতে সুভাষ বসু, আরেক হাতে চে গুয়েভারা। দেশের ডাকে আমরা অনেকেই ঝাঁপ দিয়েছিলাম। মায়ের চোখের জল, পরিবারের পিছুটান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার—কোনোটিই আটকে রাখতে পারেনি।

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। একাত্তরে আমি গ্রাম দেখেছি, চিনেছি। তখন শহরগুলো ছিল অবরুদ্ধ। গ্রাম ছিল স্বাধীন। মুক্তিযোদ্ধারাই গ্রামের প্রশাসন চালাত প্রবীণদের সঙ্গে পরামর্শ করে। তারপরও হানাদাররা হানা দিত মাঝেমধ্যে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিত। নির্বিচার খুন করত মানুষ। নারীদের লাঞ্ছিত করত। সবাই মনেপ্রাণে এ অবস্থার অবসান চাচ্ছিল। কেউ যুদ্ধ চায় না। যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলার সরকার শপথ নিয়েছিল। একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল। আমি ওই দিন সন্ধ্যায় আগরতলা শহরের বটতলী এলাকায় একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশবাণীর ওই খবরটি শুনেছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যত দ্রুত পারি, যুদ্ধে শামিল হব। আগরতলা-কলকাতার রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে দিন কাটাব না। প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকতে জুলাই পেরিয়ে গেল।

দেশটা সাড়ে আট মাসের যুদ্ধে স্বাধীন হয়ে গেল। ছোটবেলায় স্কুলে পড়েছিলাম এককথায় প্রকাশ। আট মাসে জন্ম নেওয়া শিশুকে কী বলে—আটাশে। মায়ের পেটে শিশু যথেষ্ট পরিমাণ সময় না পেয়ে জন্ম নিলে ওজন কম হয়, রোগা-পাতলা থাকে, ঘন ঘন অসুখে ভোগে। সে জন্য ওই শিশুর যত্ন নিতে হয় বেশি। আমরা ২৬০ দিনে স্বাধীন হয়ে গেছি। কেউ কেউ বলেন, খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ে গেলে আমরা নাকি আরও ভালোভাবে স্বাধীন হতাম। কেউ কেউ এখনো হাঁক দেন—আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ চাই। যখন সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই গ্যালারিতে বসে তা দেখেছেন। মাঠে নামেননি। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থাকে সবার মনে। তাঁদের হয়ে যুদ্ধ করেন কম মানুষই।

যুদ্ধ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। আমাদের বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবাই একে একে শরণার্থী হলাম। দেশ যখন মুক্ত হলো, পুরো পরিবারটি আর একত্র হতে পারল না। এমন গল্প ঘরে ঘরে আছে।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। ঢাকায় সেদিন নাকি আনন্দের বান ডেকেছিল। আমি ওই দিন ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। ওই শহরটি এক সপ্তাহ আগেই মুক্ত হয়েছিল। চারদিকে আমি শুধু কান্না দেখেছি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামটিতে ‘হিন্দু’ গন্ধ আছে। তো ওই শহরের মুসলিম লীগ নেতা আবদুর রহমান খাঁ শহরের নাম পাল্টে দিয়েছিলেন। নাম হয়েছিল রহমান বাড়ি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শব্দটিতে এখনো অনেকের অ্যালার্জি। তাঁরা বলেন বি.বাড়িয়া।

default-image

ডিসেম্বরে স্বাধীনতাবিরোধীরা অনেকেই ধরা পড়ল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। অনেকে পালিয়ে বাঁচল। আমরা আবদুর রহমান খাঁর বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পেলাম। ওটা হলো মহকুমা মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর।

আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অনেক সুন্দর শব্দ আছে। একাত্তরে তা আমরা জানতাম না। এগুলো ছাপার অক্ষরে দেখেছি যুদ্ধ শেষে। ঘোষণাপত্র শুনে বা পড়ে আমরা যুদ্ধ করিনি। আমাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণগুলো মোটাদাগে বলা যায়: জাতিগত বৈষম্যের অবসান, গণতন্ত্র আর ভালোভাবে খেতে-পরতে পারা। ওই সময় আমজনতার এর চেয়ে আর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না।

বাহাত্তরেই স্বপ্নভঙ্গ হলো। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির মুখোমুখি অবস্থান এখনকার মতো ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারাই পথঘাট দাপিয়ে বেড়াতেন। রাজাকাররা পালিয়ে গিয়েছিল। সুবিধাবাদী অমুক্তিযোদ্ধারা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিল। চরম বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটল তখন, যখন মুক্তিযোদ্ধারা ভাগ ভাগ হয়ে গেলেন। এই সুযোগে দেশে সুবিধাবাদী আর লুটপাটকারীদের একটা আঁতাত তৈরি হয়ে গেল। তারা ধীরে ধীরে দেশটা গিলে ফেলল। এমনটি তো আমরা চাইনি।

বাহাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর অনেক উৎসাহ নিয়ে প্রথমবারের মতো উদ্‌যাপন করা হলো বিজয় দিবস। স্বজন হারানোর কান্নার আওয়াজ তখনো রয়ে গেছে। একটি দৈনিকে আমি কলাম লিখলাম—এ বিজয় কার? আক্ষেপ, হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েই এটি লেখা। খুব দ্রুত ‘স্বাধীন’ হয়ে যাওয়া একটি দেশ যে রকম নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে লালন-পালন করার কথা, সেটি হয়নি। জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সেই বিভক্তি ক্রমাগত বেড়েছে। দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয়নি।

পাকিস্তানে একধরনের কতৃর্ত্ববাদী শাসন আর মোল্লাতন্ত্র কায়েম হয়েছিল। রাষ্ট্র নিজেই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির জিগির তুলে সমাজকে ঠেলে পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। আমরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। অথচ ২৫ বছর না পেরোতেই আমরা দেখলাম, শান্তি গেল নির্বাসনে। অসহায় মেয়েরা ফতোয়ার শিকার হয়ে দোররা খেয়ে গলায় দড়ি দিচ্ছে। তখন আমি লিখেছিলাম:

স্বাধীনতা মানে দ্বারে নেই খিল

নিরাপদে বসবাস

স্বাধীনতা মানে চাপাতি ও বোমা

চারদিকে সন্ত্রাস।

স্বাধীনতা মানে মোল্লাতন্ত্র

শেষ হবে এই বঙ্গে

স্বাধীনতা মানে এক শ দোররা

নূরজাহানের অঙ্গে।

এরপর পেরিয়ে গেছে আরও দুই যুগ। মনে হয়, আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সে তিমিরেই আছি। আমাদের চারপাশে তৈরি হচ্ছে পরিসংখ্যানগত মিথ, কতগুলো সংখ্যা। সাক্ষরতা, আয়, বিনিয়োগ আর প্রবৃদ্ধির নানান সূচক। আমাদের উল্লম্ফন হচ্ছে। যেমন অ্যাথলেটিকসের রেকর্ড ফি বছর কিছু না কিছু ভাঙে, হাইজাম্প-লংজাম্পে কয়েক মিলিমিটার অগ্রগতি হয়। আমরা এগুলো নিয়ে অর্জনের ঢোল বাজাই। কিন্তু ষাটের দশকে যে স্লোগানগুলো আমরা দিতাম, এখনো সে স্লোগানগুলো আবার দিতে হচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, ভোটের অধিকার চাই, পুলিশি নির্যাতন বন্ধ কর, জেল-জুলুম-হুলিয়া, নিতে হবে তুলিয়া, এসব—স্লোগান কত দিয়েছি ষাটের দশকে! এখনো দিই। তাহলে এগোলাম কতটুকু?

দেশ নানান সূচকে অনেক এগিয়েছে। অপচয়ের অর্থনীতির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আরও এগোতে পারত। তারপরও আমরা উন্নতি করছি। কিন্তু তুলনা করছি কার সঙ্গে? ভারত কিংবা পাকিস্তান। ভারতের মধ্যে কেরালা নামে একটি রাজ্য আছে। আছে কাছের দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। তাদের থেকে এখনো আমরা বেশ পিছিয়ে। অগ্রগতির মানদণ্ডটি হওয়া উচিত—যারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে, কত দ্রুত আমরা তাদের ছুঁতে পারি, অতিক্রম করতে পারি।

বাংলাদেশের জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র—তাও আবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এমন উদাহরণ এ মহাদেশে আর নেই। এটি আমাদের আশপাশের দেশগুলোর মতো নয়। এখানে মধ্যরাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়নি। স্বাধীনতা কোনো দয়ার দান ছিল না। এটি অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। আমরা যদি দ্রুত এগিয়ে না যেতে পারি, তাহলে এই ত্যাগ বৃথা যাবে। একটি মুহূর্তেও যেন আমরা ভুলে না যাই যে আমরা রক্তের ঋণে আবদ্ধ।

একটি রাষ্ট্রের জীবনে পাঁচ দশক খুব কম সময় নয়। এখন চাইলেই চটজলদি হাতের নাগালে আধুনিকতম প্রযুক্তি পাওয়া যায়। দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রযুক্তি একটি বড় নিয়ামক। আমরা দেখেছি, যে উন্নয়ন ইউরোপে হয়েছে ২০০ বছরে, দক্ষিণ কোরিয়া তা করতে পেরেছে ৩০ বছরে। আমরা দেখেছি, যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান কত দ্রুত উঠে দাঁড়াতে পেরেছিল। কত দ্রুত ভিয়েতনাম উঠে দাঁড়াচ্ছে। চাইলে আমরাও পারি।

যে পরিবারটি বছরের পর বছর রেললাইনের ধারে বস্তিতে আছে, যে ফেরিওয়ালা নজরানা দিয়ে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন আর সব সময় আতঙ্কে থাকেন কখন তাঁকে গলাধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হবে, যে ভিখিরি রাজপথের ক্রসিংয়ে লালবাতির কাছে থেমে যাওয়া গাড়ির কাচে টোকা দিয়ে হাত পাতেন, তাঁর কাছে প্রবৃদ্ধির কোনো মূল্য নেই। তিনি ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ বোঝেননি। তিনি এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলও বোঝেন না। সাম্য আর সামাজিক সুরক্ষার কথা সংবিধানে আছে। ওটা তিনি পড়েননি।

নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলো টনকে টন কাগজ কিনে ইশতেহার ছাপায়। দুধ আর মধুর নহর বইয়ে দেওয়ার ওয়াদা করে। তারপর চুইয়ে পড়া অর্থনীতির নিয়মে ওই ভিখিরি ছিটেফোঁটা কিছু পান। কিন্তু তাঁর চোখের সামনেই দ্রুত বেড়ে ওঠে অসাম্যের আকাশছোঁয়া অট্টালিকা—স্কাইস্ক্রেপার। যুদ্ধজয়ী একটি স্বাধীন জাতির এটি কাম্য ছিল না।

ঘুরেফিরে পুরোনো আক্ষেপেই ফিরে আসতে হয়—এ বিজয় কার? আমরা ২২ পরিবারের কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে এসে বোধ হয় ২২ হাজার পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছি। রাজনীতির মাঠে ৩০০ সদস্যের একটি মালিক সমিতির উত্থান হতে দেখছি। যে লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমরা এ দেশ পেয়েছি, তারা কি আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে না?

ষাটের দশকে একটি স্লোগান ছিল—ভাতের থালায় সাম্য চাই। ষাট বছর পরও সেই সাম্য অধরা থেকে গেল। আইন করে প্রকল্পের পর প্রকল্প বানিয়ে, জিডিপি বাড়িয়ে চাকচিক্যময় দেশ হয়তো আমরা গড়তে পারব কিন্তু সেই সমৃদ্ধি সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র কি দিতে পারছি? এ জন্য আর কয়টি বিজয় দিবস আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?

একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতারে রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে একটি গান প্রায়ই শুনতাম। তার একটি লাইন ছিল—‘আমার এ দেশ সব মানুষের’। তা-ই হোক। দেশ এগিয়ে যাক। জয় হোক সবার।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত