বিজ্ঞাপন
default-image

নয়টা মাস মা-বাবাসহ আমরা কেউ ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। রাত ফুরালেই সকাল থেকে আসা শুরু হতো খানসেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের নিহত হওয়ার খবর। প্রতিদিন সকাল হতেই আতঙ্কে থাকতাম আমি। এই বুঝি খবর পাব, যুদ্ধে নিহত হয়েছে আমার ভাই আজাহার। কিন্তু না। পুরো নয় মাস যুদ্ধকালীন সময়ে ও যেসব যুদ্ধে অংশ নিত, প্রতিটিতে তার বীরত্বপূর্ণ লড়াই করার খবর আসছিল। আমাদের পরিবারের সদস্যদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল, খানসেনারা আজাহারকে মারতে পারবে না।

দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মহতুল্লাপুর গাজাড়মারী গ্রামে বাড়ি ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাহারের। বাবা আজিমুদ্দিন ও মা সমিরন নেছার একমাত্র ছেলে ছিলেন আজাহার আলী।

দেশমাতৃকার জন্য জীবন উত্সর্গকারী একমাত্র ভাইয়ের স্মৃতি হাতড়ে ফিরতে বারবার আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন মরিয়ম। বললেন, বাড়ি, ভিটে আর বাবার যে ধানের জমি ছিল, তা দিয়ে সংসার চলে যেত। একমাত্র ভাইটা আমার তাগড়া জোয়ান ছিল। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বাবা ওর বিয়ে দেন। পার্শ্ববর্তী ৭ নম্বর ইউনিয়নের উথরাইল পাঁচবাড়ী গ্রামে; মনোয়ারা নামের এক মেয়ের সঙ্গে। এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিল তার।

একমাত্র শিশুপুত্র মনসুরের বয়স দুই বছর আর শিশুকন্যা রাজিয়ার বয়স যখন মাত্র চার মাস, যুদ্ধ বেধে গেল। আজাহার ছিল অদম্য সাহসী। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকে সে স্থানীয় কেবিএম কলেজ, চেরাডাঙ্গী স্কুলসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে আনসার-মুজাহিদ ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাড়িতে কম আসত।

এপ্রিল মাসে ঘোরতর যুদ্ধ বেধে গেলে পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে সে। এলাকার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কাছে আমরা আজাহারের খবর নিতাম।

বুড়ো মা-বাবা গ্রামেই ছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল রাজাকাররা। ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে রাজাকাররা বাবাকে খানসেনাদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে গ্রাম ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তাঁরা।

আমি ও মনসুরা—দুই বোন দেশ ছেড়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উঠেছিলাম ভারতের গঙ্গারামপুর থানার রতিনাথপুর ইউনিয়নের ওজুনাহার গ্রামে। সেখানে ‘সপরন দীঘি’ নামের একটি বিশালকায় পুকুরের চারধারে শরণার্থী শিবিরে ছিলাম আমরা। সেখানে আমাদের মতো প্রায় ৫০০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। ওই সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধরত ছিল আজাহার।

শরণার্থী শিবিরে থাকতে তিন-চার দিন এসেছিল আজাহার। পরনে ছিল খাকি পোশাক, পায়ে জুতা, কাঁধে এলএমজি, পকেটে গ্রেনেড। একমাত্র ভাইকে কাছে পেয়ে দুই বোন আমরা বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে আকুল হয়ে প্রথম দিন বলেছিলাম, ‘ভাই, অনেক যুদ্ধ করলি। আর দরকার নেই।’ কিন্তু তার দৃঢ় কণ্ঠের উচ্চারণ ছিল, ‘তোরা বোনেরা এমন করে কাঁদলে তো দেশ স্বাধীন হবে না। প্রতিদিন কত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হচ্ছে। আমি তো বেঁচে আছি। তোরা সাহস দিবি। কান্নাকাটি করলে আর আসব না। তবে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না।’

বিজয়ের পর ১৭ অথবা ১৮ ডিসেম্বর হবে দিনটি। ওই দিন বিকেলে আচমকা দূর থেকে বুবু বুবু বলে চিত্কার করে ডাক কানে এল। মনসুরা ও আমি ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতেই বাড়ির আঙিনায় অবোধ শিশুর মতো ভাইকে বুকে জড়িয়ে আনন্দের বন্যা আর তৃপ্তির কান্নার আতিশয্যে আমরা বিভোর হয়ে পড়ি। সংবিত্ ফিরে পাই, যখন দেখি, পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই ভিড় করছে আঙিনায়।

আজাহার বলেছিল, ‘বুবু, বলেছিলাম না। দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরব না। আমি আমার কথা রেখেছি বলেই কাঁধ থেকে এলএমজি নামিয়ে সবার সামনে শূন্যে বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে।

আজাহারকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কোটরে বসে গিয়েছিল ওর চোখ দুটো। সে জানায়, মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীরা রাস্তায় তার অপেক্ষায় আছেন। তাকে ফিরতে হবে। আমি দৌড়ে ঘরে গিয়ে একটা থালায় ভাত আর মাংস নিয়ে ফিরে এলাম আঙিনায়। নিজের হাতে ওর মুখে তুলে দিলাম ভাত। ভাত খেতে খেতে ও বলেছিল, ‘বুবু, কত দিন যে ভাত খাইনি।’ সে চলে যায়। আমাদের দুই বোনের সঙ্গে সেটাই ছিল তার শেষ দেখা।

বিজয়ের মাত্র ২০ দিন পরের কথা। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই দিন আজাহার মহতুল্লাপুর গাজাড়মারী নিজ গ্রামে সারা দিন বাবার কাজে সহায়তা করে। আমন ধান মাড়াই করে নিজ হাতে। বিকেলে মহারাজা স্কুলে ট্রানজিট ক্যাম্পে মিটিং আছে। মা-বাবা ও স্ত্রী মনোয়ারাকে বলে যায়। সেটাই ছিল তার শেষ যাওয়া।

সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান শেষ হওয়ার পরপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে যায় ট্রানজিট ক্যাম্প। ওই স্থানটি পরিণত হয় বিশাল পুকুরে। ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের মাংস, হাড়, স্কুল ভবনের ইট-পাথর উড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে পুরো শহরে। ওই এলাকা ছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘর, দরজা-জানালা ভেঙে পড়ে। ধারণা করা হয়, অপসারিত মাইন ট্রাক থেকে নামাতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে গিয়ে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ধারণা করা হয়, প্রায় সাড়ে নয় শ মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন ওই ঘটনায়।

অনুলিখন: আসাদুল্লাহ্ সরকার, দিনাজপুর

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত