বিজ্ঞাপন
default-image

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমি তখন সবে ময়নামতিতে একটি ক্লোজ সাপোর্ট মিশন শেষে ফিরে এসেছি। (গুয়াহাটি বিমান ঘাঁটির অধিনায়ক) গ্রুপ ক্যাপ্টেন উলেন দৌড়ে পরিচালনাকক্ষে এসে আমাকে বলেন, ‘ভুপ, বিমান সদর দপ্তর আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। ঢাকার সার্কিট হাউসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক চলছে। সেখানে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে হামলা করতে হবে।’

তাঁকে বললাম, ১০টা ৫৫ মিনিট তো এখনই বাজছে। এখান থেকে ঢাকায় উড়ে যেতে ২১ মিনিট লাগবে। তা ছাড়া, ‘এই সার্কিট হাউসটাই বা কোথায়?’

তিনি বললেন, ‘ঝটপট কাজ করলে হয়তো কাঁটায় কাঁটায় ধরা যাবে। আমার কাছে ঢাকার একটি পর্যটন মানচিত্র আছে। এখানে এই যে এই সড়ক সংযোগ, এর পরই সার্কিট হাউস।’

তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ঢাকার যে জায়গাটায় সার্কিট হাউসের অবস্থান, সেটা খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। আর আকাশ থেকে তো সড়ক সংযোগ দেখা যায় শত শত। ওই সংযোগ সড়কটা কীভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তাঁকে বললাম, ‘ঠিক আছে, স্যার, কাজটা হয়ে যাবে।’ তাঁর কাছ থেকে আমি মানচিত্রটি নিলাম, যাতে ঢাকার আকাশে পৌঁছে সার্কিট হাউসটি

খুঁজে নিতে পারি।

সে অভিযানের জন্য আমি চারটি মিগ-২১ বিমান নিলাম। প্রতিটাতে উচ্চ বিস্ফোরণের ক্ষমতাসম্পন্ন ৩২টি করে রকেট ছিল। ককপিটে বসে ফিতা বেঁধে ইঞ্জিন চালু করার পর দেখলাম, আমাদের একজন ফ্লাইট কমান্ডার একটি কাগজ নেড়ে নেড়ে দৌড়ে আমার দিকে আসছে, ‘স্যার, এটা আপনার জন্য।’ তাতে লেখা ছিল, ‘লক্ষ্যবস্তু গভর্নমেন্ট হাউস। আবার বলছি, গভর্নমেন্ট হাউস, সার্কিট হাউস নয়। বুঝেছেন কি না, সেটা নিশ্চিত করুন। শুভকামনা, আপনার শিকার সফল হোক। মল (গ্রুপ ক্যাপ্টেন উলেনের ডাকনাম)।’

আমি বুড়ো আঙুল তুলে নিশ্চিত করলাম যে পরিবর্তনটা আমলে নিয়েছি। আমি কোলে থাকা মানচিত্রে গভর্নমেন্ট হাউস খুঁজে বের করলাম। তারপর উড়াল দিলাম। আমার দলের অন্য তিন সদস্যকে তখনো এই পরিবর্তন সম্পর্কে বলিনি। ওয়্যারলেসে ঘোষণা দিয়ে সারা দুনিয়াকে আমি খবরটা জানাতে চাইনি। আমার দলের আর তিন সদস্য ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বিনোদ ভাটিয়া, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রাঘবচারি ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মালহি।

আকাশপথে ঢাকার কাছাকাছি আসার পর তাঁদের তিনজনকে নতুন লক্ষ্যবস্তুর কথাটা জানালাম। জায়গাটি সম্পর্কে তাঁদের মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে তাঁদের সেটা খুঁজে বের করতে বললাম। জায়গাটি প্রথমে খুঁজে বের করলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ভাটিয়া। তিনি জানালেন, জায়গাটির অবস্থান ঠিক ৫০০ গজ দূরে, ঘড়ির ১১ নম্বর কাঁটার অভিমুখে। ভবনটি ছিল পুরোনো আমলের প্রাসাদের মতো। দেখতে দারুণ। তার ওপর ছিল বড় একটা গম্বুজ। ভবনটি অবস্থান ছিল ঘন সবুজ একটি মাঠের মাঝখানে। প্রবেশপথের ভেতর দিকে কিছু গাড়িও ছিল।

ভবনটিকে ঘিরে আমি একটা চক্কর কাটলাম। তারপর বিভিন্ন দিক থেকে বড় বৃত্ত তৈরি করে আক্রমণের নির্দেশ দিলাম। আমি গোলা ছুড়লাম গমু¼জের নিচের কক্ষটি নিশানা করে। অন্যরাও নানা জায়গায় গোলা নিক্ষেপ করল। আমরা প্রত্যেকে দুবার উড়ে গিয়ে গভর্নমেন্ট হাউসে ১২৮টি রকেট ছুড়লাম।

দ্বিতীয় আক্রমণের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী ভবন থেকে ধুলোবালু ও ধোঁয়া দেখা গেল। এ ঘটনা নিশ্চিতভাবেই বেসামরিক প্রশাসনের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। এর দুই দিন পরই জেনারেল নিয়াজিকে তাঁর ৯৩ হাজার সেনাসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

আমি শুনতে পেয়েছি, সে দিন বিকেলেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ভারত সরকারের ঘোষিত নিরাপদ আশ্রয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেয়। জেনারেল নিয়াজি কিন্তু আগের দিনও বলেছিলেন, তিনি আরও এক মাস যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন। এর পর বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর হাতে আর কোনো উপায় রইল না।

আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্তটা তাঁকে শেষ পর্যন্ত নিতেই হয়। মানসম্মান পুনরুদ্ধার করার এ ছাড়া আর কোনো উপায় তাঁর হাতে ছিল না। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানান। সে দিন বিকেলেই তা কার্যকর হয়। নামিয়ে দেওয়া হলো পাকিস্তানের পতাকা, যা আর কোনো দিনই সেখানে উঠবে না। ‘সোনার বাংলা’ তখন বাস্তবে রূপ নিল।’

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

গ্রুপ ক্যাপ্টেন বি কে বিষ্ণয়: ভারতের প্রথম সুপারসনিক স্কোয়াড্রনের অধিনায়ক

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত