পাকিস্তান কূটনৈতিক সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে। দুই বছরের মাথায় ১৯৬৮ সালের আগস্টে ভাইস কনসাল হিসেবে যোগ দিই নিউইয়র্কে তৎকালীন পাকিস্তান কনস্যুলেটে। সেখানে শুরু থেকেই টেগোর সমিতিতে যোগদান এবং ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণির বাঙালিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে আমার ওপর ছিল সরকারের নজরদারি। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনে সরাসরি যুক্ত হয়ে খুব স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, আমি আর পাকিস্তানের সঙ্গে নেই। এর অনিবার্য পরিণতিতে ২৫ এপ্রিল ইসলামাবাদ ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় আমাকে।
ওই সিদ্ধান্তের পরদিন, অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি। এরপর মুজিবনগর সরকার আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়। নিউইয়র্কের ১০ পূর্ব ৩১ সড়কে চালু করি অস্থায়ী বাংলাদেশ মিশন। তবে আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ মিশন খোলার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ লীগের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। এর আগে মে মাস থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন মহল ও গণমাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছিলাম।
এফ আর খানের অবদান
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের শুরু থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত স্থপতি এফ আর খান। তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান লিগ অব আমেরিকার সঙ্গে জড়িত। পরে বাঙালিদের নিয়ে শিকাগোতে বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ নামে আলাদা একটি সংগঠন করেন। মে মাসে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী নিউইয়র্ক গেলে তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে অন্যান্য প্রস্তুতির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাস প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি বেশ উৎসাহী ছিলেন। আবু সাইদ চৌধুরী ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানকে তিনি এ ব্যাপারে রাজি করাতে চেষ্টা করেন।
২৬ এপ্রিল আমি প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেও ওয়াশিংটনে কর্মরত অনেক বাঙালি কূটনীতিক তখনো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছিল। শিকাগোতে ৬ জুন, ওয়াশিংটনে ১৮ জুন আর নিউইয়র্কে ২৬ জুনের কনভেনশনে এ নিয়ে বাঙালিরা তাঁদের ক্ষোভের কথা জানান।
নিউইয়র্কের কনভেনশনের পর এক আলোচনায় ওয়াশিংটনে পশ্চিম পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ইকোনমিক কাউন্সেলর আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে এফ আর খান কথা বললেন। তিনি জানতে চাইলেন, ওই মিশনে কর্মরত বাঙালিরা প্রবাসী সরকারের প্রতি কেন এখনো আনুগত্য প্রকাশ করছে? মিশন চালাতে কত টাকা দরকার? ওয়াশিংটন মিশনে একজন উপরাষ্ট্রদূতসহ কূটনৈতিক ও প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া অন্তত ছয়জন বাঙালি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কাজ করছিলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত জানালেন, মিশন চালাতে সব মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার ডলার প্রয়োজন। এফ আর খান মুহূর্তের মধ্যে চেকবই বের ২০ হাজার ডলারের একটি চেক লিখে দিলেন। দিয়ে বললেন, ‘টাকাটা নিয়ে যান। সবাইকে জানিয়ে দিন, বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মিশনের খরচ চালানোর দায়িত্ব আমার।’
সেই স্ট্যাম্প সংখ্যা
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের ফোন পেলাম। লন্ডন ও মুজিবনগর থেকে একই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হবে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট হাউসে সাবেক পোস্টমাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউস ও বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ডাকটিকিটগুলো উন্মোচন করবেন। আমার কাছে নির্দেশ এল, ডাকটিকিটগুলো যুক্তরাষ্ট্রে উন্মোচন করতে হবে।
দায়িত্বটি কীভাবে পালন করা যায়, তা নিয়ে ভাবলাম। আজ ভাবতে ভালো লাগে, কাজটি যেভাবে সম্পন্ন করা হয়, তাতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ‘রেবেল স্ট্যাম্প’-এর মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ জেনেছিল বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের কথা। এ প্রসঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় নিউইয়র্ক টাইমস ও তার জাতিসংঘ প্রতিনিধি ক্যাথলিন টেল্টশকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় শিডনি শনবার্গ ও ডেভিড লিডম্যানকেও।
আগস্ট ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন কনস্যুলেটে ভাইস কনসাল হিসেবে কাজ শুরু করার পর নিউইয়র্ক টাইমস-এর এই জাতিসংঘ প্রতিনিধি ক্যাথলিন বা কিটির সঙ্গে আমার পরিচয়। এক সেট স্ট্যাম্প হাতে পাওয়ার পর সেগুলো নিয়ে আমি গেলাম কিটির কাছে। তাঁকে জানালাম, বাংলাদেশের প্রথম স্মারক ডাকটিকিট তাঁর ১০ বছরের ছেলের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছি। লন্ডনপ্রবাসী বিমান মল্লিকের নকশা করা ডাকটিকিটগুলো পেয়ে কিটি ভীষণ আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আমার ছেলের এগুলো খুব পছন্দ হবে। বলো, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?’ এবার আমি পুরো বিষয়টি তাঁকে খুলে বললাম।
কিটি আমাকে নিয়ে গেলেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর রবিবাসরীয় সংখ্যার স্ট্যাম্প বিভাগের সম্পাদকের কাছে। ঠিক হলো, পত্রিকাটির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি মুজিবনগর
গিয়ে মুক্তাঙ্গন থেকে ডাকটিকিট উন্মোচন অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করতে যাবেন।
লন্ডন প্রতিনিধি সংগ্রহ করবেন সেখানকার অনুষ্ঠানের খবর। সব শেষে স্ট্যাম্প বিভাগের সম্পাদক স্ট্যাম্প এবং সংক্রান্ত পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন।
বাংলাদেশের প্রথম স্মারক ডাকটিকিট নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এর ৮ আগস্ট সংস্করণের স্ট্যাম্প বিভাগের পুরো পাতাজুড়ে ছাপা হয়েছিল ‘স্ট্যাম্পস: বাংলাদেশ: ট্রিড উইথ কশন’ শিরোনামে ডেভিড লিডম্যানের বিশেষ প্রতিবেদন। এভাবে মার্কিন জনগণের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের কাছে পৌঁছে যায় বাংলাদেশের খবর।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর পাশাপাশি ২৭ জুলাই ওয়াশিংটনের দৈনিক ইভিনিং স্টার পত্রিকাটিও সবগুলো ডাকটিকিটের ছবি নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপায়। মার্কিন সাময়িকী নিউজউইক-এর ৯ আগস্ট সংস্করণে ‘রেবেল স্ট্যাম্প’ শিরোনামে ছাপা হয় আরেকটি ফিচার।
বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ
নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তের বাঙালিদের সঙ্গে যোগসূত্রটা হয়ে গিয়েছিল বেশ আগেই। নানা স্তরের মার্কিন জনগণের সমর্থনের পারদটা বেশ মাপা যাচ্ছিল। নিক্সন-কিসিঞ্জারের দুরভিসন্ধি বুঝে নেওয়ার পরও মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব বুঝতে উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোটা জরুরি ছিল। সে চেষ্টা চলছিল বেশ কয়েক মাস ধরে। কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি তখন সাহায্য চাইলাম বন্ধু হোমার জ্যাকের। জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রিপাবলিকান পার্টির নেতা জর্জ ডব্লিই বুশ সিনিয়রের সঙ্গে দেখা করার কথা তুললাম তাঁর কাছে। বুশের সঙ্গে দেখা করব প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিষয়ে কথা বলাটা জরুরি।
হোমার জ্যাক উত্তর দিলেন, ‘এ তো রীতিমতো অসম্ভব!’
অসম্ভব বলেই তো তোমাকে বলা। আমি বললাম।
‘এ কী করে সম্ভব। তোমার বয়স কম তো। তাই এভাবে বলছ।’
৩০ পেরোনো আমাকে তাচ্ছিল্যভরা উত্তর দিলেন দ্বিগুণ বয়সী হোমার জ্যাক। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই নিউইয়র্কের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের বিশেষ বন্ধু হিসেবে কাজ করেছেন। কাউন্সিল ফর পিস থ্রু রিলিজিয়নসের মহাসচিব হোমার জ্যাক ছিলেন তাঁদের একজন। আরও ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব জুরিস্টসের সদস্য জন সলজবার্গ, ইউএন করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. জয়ন্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ।
হোমার জ্যাক আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জয়ন্ত ভট্টাচার্যর অফিস দুটো হয়ে উঠেছিল জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
যাহোক, হোমার জ্যাকের সঙ্গে সেই কথাবার্তার পর কয়েক মাস চলল। হঠাৎ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে নাটকীয়ভাবে তিনি জানালেন, আবু সাইদ চৌধুরীর সঙ্গে বুশের সাক্ষাৎটা হলেও হতে পারে। তবে খুব সংক্ষিপ্ত, হতে পারে মাত্র এক ঘণ্টার নোটিশে সাক্ষাৎটা হবে।
শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল ফর পিস থ্রু রিলিজিয়নসের মহাসচিব হোমার জ্যাকের উদ্যোগে ২৩ নভেম্বর বেলা ১১টায় জাতিসংঘে সিনিয়র বুশের দপ্তরে বৈঠকটি হয়েছিল।
চার দশক পর আজও জর্জ বুশের সঙ্গে সে দিনের ওই আলোচনার কথা মনে হলে অদ্ভুত বিস্ময় জাগে। সেদিন আলোচনা চলল মিনিট চল্লিশেক। পুরো আলোচনায় বুশ যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। তিনি বললেন, মার্কিন জনগণ তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। মেডিসন স্কয়ারের কনসার্ট, গিনসবার্গের লেখা কবিতা ইত্যাদি প্রসঙ্গও তিনি নিজেই তুললেন। ততটা আমি নিজে আশা করিনি। আবু সাইদ চৌধুরীও নন।
মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ তুলতেই বুশ বললেন, ‘না, না, প্রশ্নই ওঠে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ তো বটেই, রিপাবলিকান পার্টির বহু সিনেটরও বাংলাদেশের পক্ষে। সেই এপ্রিল থেকে এ নিয়ে মার্কিন সিনেটে আলোচনা চলছে। ওসব আলোচনা পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে তাঁদের সাধারণ সমর্থন বাংলাদেশেরই পক্ষেই। এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। দিনক্ষণ তো বলা সম্ভব নয়, তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সেটি ঘটতে চলেছে।’
বুশের সঙ্গে আমাদের আলোচনা সেদিন শেষ হয়েছিল এভাবেই। সে সময়ের তরুণ কূটনীতিক আমি এ আলোচনার পর আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম এই যে মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ তাহলে বিজয়ের দিকেই এগোচ্ছে।
এ এইচ মাহমুদ আলী: মুক্তিযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ; বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত