বিজ্ঞাপন
default-image

বিভিন্ন ভাষণ-বক্তৃতাতে তো বটেই, এমনকি সরকারি তথ্য দপ্তরের দলিলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিশ্ববাসীর ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ সহায়তার কথা প্রায়ই বলা হয়েছে। অথচ এর পশ্চাতে থেকে কারা এবং কীভাবে এই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ মনোভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের কথা হয়তো কোনোদিনই সঠিকভাবে তোলা হবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন যদি উপযুক্তভাবে সংগঠিত হতো তাহলে ইতিহাস অন্য রকম হতো। অনেকটা আচম্বিতে ফেটে-পড়া আন্দোলনের যথোপযুক্ত নেতৃত্বহীনতা প্রকারান্তরে এই আন্দোলনেরই সমূহ ক্ষতি করেছে। পাকিস্তানের পর বাংলাদেশে নেতৃত্বের দুর্বলতা বাংলাদেশের দুর্দশাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে, একাত্তরের আরেক নেতৃত্ব দৌর্বল্য অশেষ দুঃখ-শোক এবং জ্বালা-যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। ওই বিষয় উপযুক্ত এবং নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে ইতিহাস রচনার কাল হয়তো এখনো আসেনি মনে করার মধ্যে কোনো অত্যুক্তি নেই।

২.

তবে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের জীবনে একটা গভীর দুর্যোগের আভাস বহুকাল আগেই পাওয়া গিয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের বাংলাদেশের সব মুসলমানই জিন্নাহ সাহেবের মেনে নেওয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সপক্ষে ছিল না। একদিকে শেরেবাংলার ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ভিন্নতর, অন্যদিকে আরো দুয়েকটি ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থার কথা শোনা গিয়েছিল। এ ছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি মুসলমান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রগতিশীল কংগ্রেস নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখে একটা সমঝোতামূলক সমাধানের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। বড় বড় নেতাদের কথা বাদ দিয়েও এই সময় মুর্শিবাদের মৌলবী আবদুস সামাদের একটি বিবৃতি এখন আরো বিশেষভাবে স্মরণ করার মতো। তিনি বলেছিলেন যে, এভাবে পাকিস্তান সৃষ্টি করে এমন একদিন আসবে যখন প্রতিবেশী সমাজের চেয়ে পশ্চিমের ভিন্নতর মানুষ অধিকতর আপনজন হবে না। সৈয়দ নৌশের আলী, হুমায়ুন কবির, জালালুদ্দীন হাশেমী প্রমুখেরই মতামত শোনার মতো ধৈর্য তখন কারুরই ছিল না।

৩.

বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ যেভাবে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে এবং যে প্রকারে তার চারিত্রের নানা রকম পরিপূর্ণতা লাভ ও বিকাশ সম্ভবপর হয়েছে বাঙালি মুসলমানের ভাগ্যে তা সম্ভব হয়নি। শেরেবাংলার শতকরা ৪০ ভাগ সংরক্ষণের মাধ্যমে যে শ্রেণীটা ধীরে ধীরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে দেশের নানা জীবনব্যবস্থায় অংশগ্রহণে অগ্রসর হয়ে এসেছিল, তাদের সমস্যা ছিল কৃষক-প্রজার সমস্যা তথা অর্থনৈতিক শোষণ-শাসনের সমস্যা। একদিকে কায়েমি স্বার্থবাদী মহল নিজেদের স্বার্থের তাগিদেই একে আদৌ সুনজরে দেখতে সক্ষম হলেন না; অন্যদিকে এই বিপুল কৃষক-প্রজার অধিকাংশ মুসলমানের অন্তর্নির্হিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অন্যতর উদ্দেশ্য সাধনে আরো একদল কায়েমি স্বার্থবাদী উঠেপড়ে লেগে গেলেন। এর পরিণামে মাড়োয়ারিদের হটিয়ে একদল নতুন ব্যবসায়ী দল ঠাঁই করে নিলেন বটে কিন্তু সেই কৃষক-প্রজার হাল-হকিকতে তেমন কোনো রদবদল হলো না।

একবার দাস অবস্থা থেকে ধর্মান্তরিত হয়েও যেমন অনেকেরই অর্থনৈতিক তকদির বদলায়নি, ঠিক অনুরূপভাবে এই নেতৃত্ব পরিবর্তনেও তাদের জীবনে তেমন কোনো বিপ্লবাত্মক উন্নয়ন সম্ভবপর হলো না। বরং বাঙালি মুসলমান সমগ্রভাবে নয়া জাতীয়তার কল্যাণে স্বভূমে থেকেই বহিরাগত শ্রমিকদের হাতে নৃশংসভাবে অত্যাচারিত হলেন। সেই অনুপাতে তার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গড়ন-গঠনও শুধু বিলাসিতাই নয়, গুণগত দিক থেকেও কোনো উত্কর্ষের পথ পেল না। সরকারি চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা-সুযোগ, পরিত্যক্ত সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা প্রভৃতিতে বাঙালি মুসলমান তার যোগ্য অংশ এবং হক থেকে বিচ্যুত হতে হতে ক্রমাগত পাকিস্তানের অন্য অংশের প্রায় অনুগ্রহভোজী দাসে পরিণত হওয়ার উপক্রম হলো। এর পশ্চাতে যেমন শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের সুচতুর কলা-কৌশলই প্রধান, তেমনি অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এবং দুর্বল মুসলমান বাঙালির মধ্যবিত্তকুলজাত নেতৃত্বের অক্ষমতা এবং অদূরদর্শিতাও সমান সহযোগী। সমধর্মিতার মহান আদর্শ অর্থনৈতিক স্বার্থের বৈষম্যকে দূর করতে আদৌ সক্ষম হয় না বলেই ধর্মনিরপেক্ষ এবং অর্থনীতি-নির্ভর জীবনান্দোলনের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে মনোভাব দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে।

১৯৫২ সালে ছাত্রনেতা শামসুল হকের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই তাকে নির্মূল করার চেষ্টা হয়। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদাদানের আন্দোলন ক্রমশ বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক তথা স্বকীয় জীবনান্দোলনের প্রতীক হিসেবে পরিণত হতে দেখা যায়। নতুন উদ্যমে জাগ্রত বাঙালি মুসলমানের শিক্ষিতকুল এ সময় একটা বিরাট আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়। ভাষা রক্ষার প্রশ্নে এই ভাষাসংশ্লিষ্ট ভাব-সংস্কৃতির ঐতিহ্যও তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেসব ভাব-ভাবনা ও সংস্কৃতি আচারের সঙ্গে দেশজ এবং ভূমিজ তথা আঞ্চলিক জীবনানুগ চিত্ত, বৃত্তি- প্রবৃত্তি এবং আশা-কামনা-অনুভবকেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে কোনো ‘শুদ্ধি’ আন্দোলনে আর তাদের মন ভরে উঠল না।

বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ ইসলামকে ঠেকিয়েছেন, খ্রিষ্টধর্মকে ঠেকিয়েছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজ আত্মসমীক্ষার কল্যাণে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজ ধর্ম ও সমাজকে নব রূপারোপে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের অপেক্ষাকৃত অপরিণত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ হলেন আরো গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি। বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত কলকাতা-দিল্লি-শিমলার দরবারে উন্নীত হয়েও, এমনকি ঈঙ্গ-বঙ্গ সমাজ কী তারো ঊর্ধ্বে খাস ব্রিটিশ এলাকার লর্ড-লেডিতে পরিণত হয়েও দেশজ সংস্কৃতি-সত্তা থেকে বিচ্যুত হননি, বরং তাকে নতুন ব্যাখ্যায়-মহিমায় উপস্থাপনে সচেতন ছিলেন। হিল্লি-দিল্লিতে বড় বড় সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত থেকেও যে দেশ, যে মাটিতে তারা জন্মগ্রহণ করেছেন, বছরে অন্তত একবার শরত্ ঋতুর মধুর মুহূর্তে ঢাকা ফিরে এসে একাত্ম হতে চেয়েছেন। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের পক্ষে এ আচরণ আরো সহজ ও স্বাভাবিক ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু তার দৃষ্টি তখন মৃত্তিকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ঊর্ধ্বমুখী তথা পশ্চিমমুখী। একে তো পাকিস্তানোত্তর সময়ে নানা পুনর্গঠনের তাগিদে মূল্যবোধে নানা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তারো ওপর আগ্রহ সত্ত্বেও কোনো আদর্শ তাদের সম্মুখে ছিল না। অধঃস্তন থেকে অনেকেই ঊর্ধ্বে উঠলেন বটে, কিন্তু তার সহজাত শিক্ষা-সামর্থ্য নিয়ে, আরো অধস্তনদের কাছে ‘ঊর্ধ্ব’ প্রকৃতপক্ষে অধঃস্তনই হয়ে রইল।

ওই অবস্থা থেকে তড়িত্গতি উদ্ধারণের একমাত্র উপায় হলো দ্রুতগতি শিক্ষা সম্প্রসারণে। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই শিক্ষা ও শিক্ষায়তন-আবহেই বাঙালি মুসলমানের ভাষা আন্দোলন এবং নিজ সংস্কৃতি ও জীবনান্দোলনের সূত্রপাত হয়। বলা বাহুল্য, সঙ্গে সঙ্গে এর প্রচণ্ড অন্তর্নিহিত শক্তিকে আয়ত্ত এবং ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-উপদল উঠেপড়ে লাগে এবং এই আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে নির্লজ্জ কলহ-কোন্দলেরও উপদ্রব দেখা দেয়। ‘আমি’ ‘আমি’ করে অনেকেই এগিয়ে আসেন বটে, কিন্তু ভুলেও কেউ বাইশে ফেব্রুয়ারির নিঃশব্দ নগ্নপদ শোক-বিক্ষোভকে স্বতঃস্ফূর্ত বাঙালি চিত্তের অভিব্যক্তি বলে উপযুক্ত পর্যালোচনা করেন না। এর কারণও এই যে, এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ও তাত্পর্য সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজেও কোনো সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় তখনো দানা বেঁধে উঠেনি। ফলে ভাষা আন্দোলন বহুকাল ধরে দৈনন্দিন রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা সাধারণ খণ্ডিত অংশ হিসেবেই বিবেচ্য হয়ে থাকে। কেবল তাই নয়, মাতৃভাষা হলেও অধিকাংশ বাঙালিই বাংলা ভাষায় উপযুক্ত ব্যুত্পত্তির অধিকারী ছিলেন না। অথচ একে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে ভাষা সংস্কার, বানান সংস্কার প্রভৃতি আন্দোলনের ফলে প্রায় এক রকম বিশৃঙ্খলার উপক্রম হলো। কিন্তু এসব ধারা-উপধারা নিঃসন্দেহে নানা আত্মবিকাশের পথ সুগমও করে।

৪.

কিন্তু ইতিমধ্যে, এবং এই ঘটনাপ্রভাবে বাঙালি মুসলমানের একটা আত্মজিজ্ঞাসার সূত্রপাত হলো: আমি কী এবং কে—এই প্রশ্নের উত্তরানুসন্ধানে তরুণ সমাজের আগ্রহই দেখা গেল বেশি। প্রবীণ গোষ্ঠীর বহুজনও এই জীবনজিজ্ঞাসাকে সস্নেহ ও ঔদার্যের সঙ্গে দেখতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় শাসন-বাঁধনের বাইরে একান্ত প্রত্যক্ষ বাস্তব অবস্থাসঞ্ঝাত সামাজিক পুনর্গঠন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। যেহেতু তখনো পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের জীবনচিন্তায় পশ্চিমানুকরণ ব্যতিরেকে কোনো সুস্পষ্ট জীবনাচার ও আদর্শ উপস্থিত ছিল না, অতএব একপ্রকার গভীর বিদ্রোহবশতই সমাজ ও দেশের অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস সম্ভবকারী এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। তবে এ ক্ষেত্রেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে কোনো বিশেষ ধ্যান-ধারণা অথবা আন্দোলন সুস্পষ্ট চেহারা নিয়ে গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তার ফলে সমস্ত ভারতবর্ষীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন দেখা দেয়।

১৯৩৬ সালের কলকাতা কংগ্রেস সম্মেলনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুও ভবিষ্যত্ স্বাধীন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রাদর্শ সমাজতান্ত্রিক হবে বলে ঘোষণা করে জনগণমনচিত্ত জয়ে সক্ষম হন। প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে মুসলিম লীগের জিন্নাহ সাহেবও কলকাতার এক বিরাট সম্মেলনে ভবিষ্যতের পাকিস্তান সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বলে ঘোষণা করে প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর চিত্তজয়ের চেষ্টা করেছিলেন। একশ্রেণীর শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী অংশ এ উক্তিতে গভীর এবং আন্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পাকিস্তান বাস্তবে পরিণত হওয়ার পর সেসব আদর্শ সম্পর্কে খুব আর একটা উচ্চবাচ্য শ্রুত হয় না। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে এবং পাকিস্তানের আপাত প্রয়োজনীয় আত্মগঠনের ব্যস্ততায় বহু উদাত্ত এবং মহান আদর্শ প্রশ্ন নানা বিশৃঙ্খলার মধ্যে বজায় রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও নিহত হন, নিহত হন নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান। সেই সঙ্গে এসব বৃহত্ কর্মকাণ্ডের অন্তরালে সমষ্টিগত এবং সার্বজনীন স্বার্থের বহু আদর্শকেই কায়েমি স্বার্থবাদী মহল কূটকৌশলে শ্বাসরুদ্ধ করে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় রত হন।

৫.

পাকিস্তানে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এবং অপরিণত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আত্মগঠন-প্রচেষ্টার কালে ধর্মীয় ব্যাপকতার বাইরে অন্য কোনো ব্যাপক জীবনচিন্তা গড়ে ওঠার লক্ষণ কিছু কিছু দৃষ্ট হলেও তা সুসংগঠিত আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠার অবকাশ পায় না। ধর্মানুসৃত জীবনচিন্তাও পশ্চিমাংশ-কীর্তিত ইকবালী ধ্যান-ধারণা অনুসরণে আকৃষ্ট হয়। একান্ত নিজস্ব জীবনব্যাখ্যার অভাববশত বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা, সাহিত্যও যথোপযুক্ত এবং আশানুরূপভাবে বিকশিত হতে পারে না। তার রাজনৈতিক দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অক্ষমতাও প্রকট হয়ে ওঠে। তবে এ বিষয়ে চেতনা সফলতারই অগ্রসরের প্রথম ধাপ। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর ধীরে ধীরে নানা আত্মজিজ্ঞাসা ও সমীক্ষাসংবলিত জীবনান্দোলন রূপ পেতে শুরু করে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সরকারি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যায়ে চীন এবং তার সমাজবিপ্লব সম্পর্কে বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত সমাজে নানা আগ্রহ দেখা দেয়। জীবনাদর্শ-সন্ধান-তত্পর বাঙালি মুসলমানের কাছে রুশ সমাজের তুলনায় চীনা-আদর্শ অনেক নিকটতর বলে প্রতিভাত হয়। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর এই সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠতর হওয়ার অবকাশ পায়।

অথচ এ সময় পর্যন্তও শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের আত্মসমীক্ষা এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি, যার ফলে সমস্ত দেশ-সমাজকে এ বিষয়ে একটা সঙ্গত ও সুস্থ নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয়। সমাজতান্ত্রিক জীবনাদর্শ কখনো ধর্মাশ্রয়ী, কখনো অস্পষ্ট ধ্যান-ধারণমিতি নানা ধরনের বাস্তববিমুখ স্বপ্ন-সুখকর সংলাপ-আলাপন মাত্রেই সীমাবদ্ধ রূপে দৃষ্ট হয়। বেশির ভাগ নগরাশ্রয়ী শিক্ষিত সমাজ তখনো ধীরে ধীরে চাকরিতে, কী ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবেশের মওকা পেয়ে আত্মোন্নয়নের সম্পূর্ণ রুদ্ধ পথে এসে উপস্থিত হয়নি। কাজে কাজেই অবক্ষয়কালের বৃহত্ জীবনবোধ ও সমগ্র সমাজের দুস্থ, অত্যাচারিত ও পিষ্ট সমাবেশে নিজেকে সংগ্রামী হিসেবে নতুন করে আবিষ্কারের চৈতন্যে এসে তখনো পৌঁছায়নি। কিন্তু তাদের পরবর্তী বংশে নতুন তরুণ সমাজে এ বিষয়ে নানা বোধ এবং চেতনা স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। প্রবীণ মধ্যবিত্তকুল স্বাভাবিক কারণেও সেসব গৌণ চেতনাকে খুব একটা স্বস্তির সঙ্গে দেখতে সক্ষম হন না।

৬.

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন গড়ে উঠছিল। এর সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের ইতিহাস মিলিয়ে পাঠ করার মতো। প্রায় অনুরূপ অবস্থাতেই এ আন্দোলন ব্যাপকতর রূপ লাভ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে অথবা সংগ্রামে পরিণত হয়। একমাত্র প্রধান পার্থক্য এই যে, এই সংগ্রাম কার্যত নেতৃত্বহীন অবস্থায় সারা দেশ ও সমাজ কর্তৃক পরিচালিত হয়। ফলে বোধ-উপলব্ধিতে বিশৃঙ্খলা ছিল, ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, ছিল স্বার্থ ও প্রয়োজন-অনুরূপ কার্যকলাপ, কিন্তু সেই সঙ্গে দেশকে শোষণশূন্য করে সুস্থ ও সুখী করে গড়ে তোলার ঐকান্তিক আগ্রহও। এই শেষোক্ত আগ্রহে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য ভূমিকার দাবিদার। সেই সঙ্গে দেশের মুষ্টিমেয় যথার্থ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ভূমিকা। কোনো ক্ষুদ্র আত্মস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে এরা এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। তাদের আদর্শ এবং চিন্তা বহুলাংশ মধ্যবিত্ত-প্রধানদের কাছেই আতঙ্কজনক বলে স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাদের আর প্রায় কোথাও দৃষ্ট হয়নি। ইতিমধ্যে দেশের রাজনৈতিক জীবনে নানা ধারা-উপধারা এমনই অধীর-অস্থির আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে যে, নির্দিষ্ট পক্ষাশ্রয় ছাড়া কোনো বুদ্ধিগ্রাহ্য ধ্যান-ধারণা প্রকাশ ও বিকাশের পথে উদ্ভব হয়েছে অজস্র বাধার।

এ ক্ষেত্রেও দুটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। প্রথমত, বাঙালি মুসলমানের জীবনচিন্তা স্বর্কীয়রূপ অনুধাবনে সক্ষম হয়নি তখনো। এক হিসাবে সমগ্রভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে এ দেশের প্রায় সব জীবনভাবনাই (মধ্যবিত্ত সমাজ কীর্তিত) অন্যত্রনির্ভর। দ্বিতীয়ত পৃথিবীতে ধনতান্ত্রিক-সভ্যতা তথা বেনে-সভ্যতা ছলেবলে-কৌশলে এমনই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তাদের কূটকৌশলমতি বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযান আজ অতি সহজে সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট হতে সক্ষম হচ্ছে। এমনকি সাম্য ও ন্যায়ের ধ্বজাধারী শক্তিও আজ নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে মহা মহা উচ্চ আদর্শকে পদদলিত করতে অথবা হূদয়হীনভাবে উপেক্ষা করতেও দ্বিধা করছে না। এমতাবস্থায় সরলপ্রাণ অনগ্রসর বাঙালি মুসলমানের পক্ষে কোনো কোনো সুচতুর স্বার্থবাদীর হাতে সহজ শিকার অথবা ক্রীড়নক হয়ে পড়ার আশঙ্কাও স্বাভাবিক ছিল। দুর্বলতাই আত্মরক্ষার তাগিদে হিংস্র হয়ে ওঠে এবং আত্মসচেতনতার অভাববশতই ব্যবস্থার পিতৃসন্ধানের উন্মাদনার সৃষ্টি করে—ইতিহাসে এমন নজিরের অভাব নেই। অবশ্য আত্মসচেতনতার অর্থ আত্মম্ভরিতা নয়। এ যুগের আত্মসচেতনতার সূত্র যেমন নিজ স্বরূপ সন্ধানের সাধনা হতে পারে, হতে পারে ‘ইয়া আয়ুহাল ইনসান, ইন্নাকা কাদেহান ইল্লা রাব্বেকা কাদেহুন ফামুলফিহ্’ অনুসৃত, হতে পারে বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের অংশস্বরূপ নিজেকে উপলব্ধির শাখাও। বাংলাদেশের বাঙালি চারিত্রে এই শেষোক্ত তিন ধারারই বৈশিষ্ট্য ছিল এবং অন্তর্নিহিতভাবে এখনো বর্তমান আছে বলে বিশ্বাস করার মধ্যে কোনো অত্যুক্তি নেই।

৭.

অথচ ইতিমধ্যে বাঙালি মুসলমানের স্বরূপ-সাধনার স্বকীয় প্রচেষ্টা নানাভাবে বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছে। হিন্দু বাংলার উপেক্ষা-অবহেলা তাকে নিজ জীবনাশ্লিষ্ট বহু আচার-সংস্কৃতির প্রতিই বিরূপ করেছে, পরে পাকিস্তানোত্তর স্বরূপ-সাধনায় তার অনুকরণআচরণ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানমুখী হয়েই ক্ষান্ত রইল না। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতিও বহুবিধ কারণে তার মাটির সহজাত সংস্কৃতি-আচার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুটা মধ্যপ্রাচ্যের কিন্তু প্রধানত পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুসরণেই সর্বাধিক আকৃষ্ট ছিল। এই সূত্রানুসরণে বাঙালি মুসলমানের পরিচালক শ্রেণীর মধ্যবিত্ত মহলে বেনেসভ্যতার চাকচিক্য সহজেই মনোহরণে প্রভাব বিস্তার করে। সবেমাত্র জাগরণ-উন্মুখ বৃহত্ ও ব্যাপক জীবন-চেতনা এবং নিজ সমাজ-সচেতনতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে তত্পর হয়ে উঠেছে। একদিকে এরাই প্রগতিশীল চিন্তাচর্যার প্রধান হত্যাকারী, অন্যদিকে স্বাধীনতা-উত্তরকালে এবং তার পূর্ব থেকেই ‘যা পারো এই বেলা গুছিয়ে নাও’ নীতি আশ্রয় করে দিক-দিশাহীন উন্মাদের মতো আনন্দ করে লাখ লাখ মানুষের চরম দুঃখ-দুর্দশা-মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

৮.

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রসঙ্গে এই সমস্ত ধারা-উপধারার বিষয় এড়িয়ে গেলে শ্রেণী এবং ব্যক্তির ভূমিকা আলোচনাও সুসঙ্গত হবে না। দেশের অভ্যন্তরে এই শ্রেণী ও ব্যক্তিদের ভূমিকায় নানাবিধ বিশৃঙ্খলার কারণের সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের আচরণের স্বরূপ ব্যাখ্যাও সহজ হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে বিচার্য প্রবাসী বাঙালি কারা। একমাত্র ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ব্যতীত পৃথিবীর অন্যত্র প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। কিন্তু গুণগত বিচারে এরা নানা বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। কখনো অধিকতর উন্নত, কখনো ভিন্নতর সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করে এরা যেমন একটা স্বচ্ছন্দ জীবিকার পথ খুঁজে নিয়েছেন, তেমনি দীর্ঘকাল প্রবাসজীবনে কষ্টকর নিঃসঙ্গতার মধ্যে স্বদেশবাসী ও স্বদেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা সব খাদ পুড়িয়ে সোনায় পরিণত হয়েছে। জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার জন্য এরা সম্মুখে যে আদর্শ দেখেছেন তারই অনুসরণ করেছেন। দেশ-প্রত্যাবর্তনের সময় এরা যেভাবে পশ্চিমীসভ্যতার সব সাজ-সরঞ্জাম টেনে নিয়ে আসেন, তেমনি তাদের পুত্র-কন্যারাও এমন কিছু সংস্কার সঙ্গে নিয়ে আসে, যার সংস্পর্শে বাঙালি মুসলমানের স্বরূপ-সন্ধানের প্রয়োজনীয়তা আরো গভীরভাবে অনুভূত হয়েছে। ইঙ্গ-বঙ্গ হিন্দু মধ্যবিত্ত প্রধান সমাজের বিশৃঙ্খল যুগের অবস্থা থেকে এই অবস্থা আরো নিদারুণ।

হিন্দু সমাজের ওই যুগে তবু একশ্রেণীর, প্রধান একশ্রেণীর হিন্দুসমাজ দেশ-মাতৃকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করতে ব্রতী হননি; কিন্তু এ যুগের বাঙালি মুসলমান প্রায় সমগ্রভাবেই এই অনুকরণের আদর্শে আধুনিকীকরণে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মাকে আম্মা থেকে ‘মাম্মি’করণে এবং বাংলাদেশের আবহে এদের পাশ্চাত্য অনুকরণের হাস্যকর আগ্রহে নিজ স্বরূপ-সন্ধানের প্রশ্নটি আবারও নতুন করে অনুভূত হওয়ার সুযোগ পেলো। এই বাঙালিদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। কেননা, বিকল্প স্বরূপ-সংগঠনের কোনো ভাবমূর্তি তাদের সম্মুখে ছিল না। তবে যেমন দেশের অভ্যন্তরে, তেমনি দেশের বাইরেও মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালি, যারা প্রায় দিশেহারা এবং মুমূর্ষু পাশ্চাত্য-সভ্যতার গতিপ্রকৃতিকে সম্যকরূপে নিরীক্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন, তারা স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়ের মধ্যে নিজ স্বরূপ প্রতিষ্ঠার আগ্রহে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিলেন। একে কেবল কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আন্দোলন বলে নয়, অথবা কোনো নতুন হজরতের নায়কের-অবতারের আবির্ভাবক্ষণ বলেও নয়, এই দুঃখদহনের মধ্য দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিত্তসত্তা কাম্য জীবনের আলোকোজ্জ্বল পথ খুঁজে পাবে এই সম্ভাবনা স্বরূপেই তারা দেখেছিলেন।

নগরবাসী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, যারা দেশাচার-রীতিনীতি এবং জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত হয়ে পড়েছিলেন, খান সেনাদের তাড়ায় তারা যখন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, সেই সময় যেমন একটা প্রচণ্ড আশা দেখা গিয়েছিল ব্যাপক সমাজবোধ জন্মের, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থাপনে এই সার্বিক সমাজবোধসম্পন্ন জীবনই স্বীয় ন্যায্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পাবে বলে তারা মনে করেছিলেন। মধ্যবিত্ত স্বাভাবসম্মত অতীত সম্পর্কচ্যুতির আগ্রহে অধীর, সুযোগসন্ধানী মনোবৃত্তি এইবার প্রকৃত চৈতন্যে জাগ্রত হবে এমন আশা করা অন্যায় ছিল না।

এই সঙ্গে আরো একটি প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে, মানচিত্রে এবং মন-মানসেও ইতিমধ্যে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে নানা গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। মানুষ তার বৃদ্ধি ও প্রগতির যাত্রায়, নিজ জীবন নির্বিঘ্ন ও স্বচ্ছন্দ করার ক্রমাগত অধ্যবসায়ে সভ্যতা ও সঙ্গত বলে কীর্তিত এমন একটা অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে, যেখান থেকে অকস্মাত্ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সমস্ত অস্পষ্ট ইতিহাস নতুন করে পর্যালোচনার। শিল্প-সভ্যতা-উত্তর বেনে-সভ্যতা আকাশ-বাতাস-মাটি-জল তো বিষময় করে তুলেছেই, মানুষও তার হাতে অসহায় পণ্যসামগ্রী হয়ে সমস্ত মনুষ্যজাতি, এমনকি পৃথিবীর অস্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করে নিতে উদ্যত। আত্মস্বার্থপর পাশ্চাত্য জগতেই জীবনভাবনা নতুন দিশা খুঁজছে। জাতিসংঘের নানা সভা-সম্মেলনে, পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে, গুণী-জ্ঞানী ব্যক্তিদের রচনায়-বিবৃতিতে নতুন জীবনবিধান, নতুন জীবনমূল্যের কথা প্রায় প্রতিটি মানুষকেই ভাবিয়ে তুলছে। তথাকথিত বেনে-সভ্যতা কিংবা শিল্পসভ্যতা মানুষকে সত্যিকারের মুক্তি দিতে সক্ষম হয়নি। টেকনোলজি দিয়েই সব জগত্ সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি বা এবারও নয়।

এই অবস্থার একমাত্র সুস্পষ্ট প্রতি-উত্তর সমাজতান্ত্রিক সভ্যতাও কতটা সার্থক এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন এখনো অবিশ্রাম। এই অবস্থায় সাড়ে সাত কোটি কৃষিনির্ভর সাধারণ মানুষের নিরস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন যেন পৃথিবীর একটি শেষ কলুষহীন মনুষ্যগোষ্ঠী এবং দেশের সংগ্রাম বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। যেহেতু সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষার প্রশ্নটিই তার স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা ঘটায়, সুতরাং তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মনে বিপুল আগ্রহ ও ঔত্সুক্যের সঞ্চার করেছিল। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের তুলনায় তার সাংস্কৃতিক মূল্যমানকেই বিশেষভাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা ছিল সর্বাধিক, অতএব সাম্প্রতিক পৃথিবীর মুহ্যমান এবং সংশয়পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পীড়িত বিশ্ববাসীর লড়াই বলেও প্রতিবিম্বিত হয়। নতুনতর জগত্ ও জীবনবিধানের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধির প্রাক-মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন এই বিশ্ব-প্রেক্ষিতে স্বীয় নতুন চারিত্র্য নিয়ে জগত্সভায় মর্যাদার আসন লাভে সক্ষম হবে এমন একটা আশা ও আকাঙ্ক্ষা প্রবাসী বাঙালিদের অনেকেরই মনোহরণ স্বপ্ন এবং তাদের সাধ্যমতো সংগ্রামেরও লক্ষ্য ছিল।

৯.

অথচ বাংলাদেশের এহেন রূপকল্পনা প্রবাসের আবহে পুষ্ট, হূদয়গত স্বদেশপ্রেমের ক্রমবর্ধমান একান্ত আরাধ্য ভাবমূর্তিসঞ্জাত। জগত্-জীবনের গতি-পরিণতি, মানুষের সর্বদুঃখহর সুখী-স্বচ্ছন্দ জীবনের জন্য নিরলস সংগ্রামের ধারা-উপধারা, বিভিন্ন প্রকার সমাজ ও রাষ্ট্রাদর্শের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্যকভাবে অনুধাবন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজরূপ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণা-পারঙ্গম বাঙালির সংখ্যা বিদেশে খুব একটা সহজলভ্য ছিল না। তবে মুষ্টিমেয় যারা ইতস্তত ছড়িয়ে ছিলেন, তাদের ভাবনা এবং কার্যকলাপের মধ্যে কোনো আত্মগত স্বার্থ-প্রাধান্য অথবা তিলমাত্র অকৃত্রিমতা ছিল এমন সন্দেহের কোনোই কারণ নেই। নেতৃত্বহীন প্রাথমিক বিভ্রান্তির পর, যে যার বিবেক ও বুদ্ধি অনুযায়ী, বসবাসকারী দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও সুযোগ অনুযায়ী নিজ ভাবনা ও কার্যক্রমকে পরিচালিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে এ কথাও স্মরণ রাখা দরকার যে, ইংল্যান্ড, সুইডেন অথবা ভারতে থেকে যা সম্ভব ছিল, ইতালি অথবা আমেরিকা, যুক্তরাজ্যে অথবা অন্যত্র থেকে তা সম্ভব ছিল না।

তারও ওপর বহু বাঙালিই এই সময় কলকাতাস্থ মিশনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের প্রতিনিধি অথবা এজেন্ট হিসেবে কাজ করার উত্সাহ এবং সুবিধা-সুযোগ পাননি। ২৬ মার্চ-পর্রবর্তী যুগে একটি [...] এবং তার আহ্বানই বিদেশের বাঙালিদের কাছে এসে পৌঁছেছিল: তা মুক্তিযুদ্ধের নায়ক জিয়াউর রহমানের। বহু অরাজনৈতিক বাঙালি এই অরাজনীতিক সেনানির আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন; তেমনি রাজনীতিপ্রবণ বাঙালিরাও নিখোঁজ নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা ও জীবনরক্ষার জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। এই সময়ে তাদের কার্যকলাপের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস অথবা বিবরণ ভবিষ্যতেও পূর্ণাঙ্গরূপে লিখিত হতে পারবে কি না এ বিষয়ে ঘোর সন্দেহের কারণ আছে।

পরিশেষে আরো একটিবার খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে প্রবাসী বাঙালিদের অধিকাংশই কর্মব্যপদেশে বিদেশে অবস্থান করছেন অথবা স্বচ্ছন্দতর অন্য জীবনাদর্শে আকৃষ্ট হয়েই বিদেশে প্রবাসী জীবন বেছে নিয়েছেন। দেশ-কালভেদে তাদের রাজনৈতিককর্মী হওয়ার অবকাশ ছিল না বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাঙালি মুসলমানের স্বরূপসাধনে তাদের ভূমিকা, বর্তমানের জগত্-প্রেক্ষিতে ও পরিস্থিতিতে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। লক্ষ লক্ষ স্বদেশবাসীর আকুল আর্তনাদ, তাদের অতিপ্রয়োজনীয় নেতৃত্বের আহ্বান হিসেবে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং এখনো করছে।

ভূমিকা

default-image

সৌমিত্র দেব

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বাঙালি মুসলমানরা উপলব্ধি করল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি একটি অসার রাষ্ট্র। তাদের ভাষার জন্য লড়াই করতে হলো। স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করতে হলো। এমনকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও রাজপথ রক্তাক্ত হলো। কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালাম বাঙালি মুসলমানের সংগ্রাম ও বিকাশের ঐতিহাসিক দিকগুলো খতিয়ে দেখেছেন, তাদের প্রবণতার ধারা-উপধারাসমূহ বিশ্লেষণ করেছেন এ প্রবন্ধে। শেষে ব্যাখ্যা করেছেন প্রবাসী বাঙালির ভূমিকা।

প্রথম পৃষ্ঠায় প্রবন্ধের শিরোনামের নিচে লেখক তার নাম লেখেননি। তার বদলে লিখেছেন ‘জনৈক বাঙালি’। প্রবন্ধটি নিজের নামে প্রকাশের ব্যাপারে সম্ভবত তার কিছুটা দ্বিধা ছিল। এখন তিনি সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে পাঠক পরিচিত হবেন বাঙালি জাতি, তার মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে শামসুদ্দীন আবুল কালামের চিন্তার সঙ্গে। লেখকের মৃত্যুর প্রায় আট বছর পর এটি তার কন্যা ক্যামেলিয়ার সৌজন্যে প্রকাশিত হলো। এতে রচনাকাল নির্দেশিত ছিল না।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত