বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের সাত বছরের চাকরিজীবনের পুরোটাই কেটেছে পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসেও তিনি সপরিবার সেখানেই কর্মরত ছিলেন। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁর স্ত্রী মিলি রহমান দুটি ছোট ছোট কন্যাসন্তানসহ ঢাকায় বেড়াতে আসেন এবং মণিপুরিপাড়ায় বাবার বাড়িতে ওঠেন। জানুয়ারির ৩১ তারিখে মতিউর রহমানও এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবসের প্রভাতফেরিতে অংশ নিতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তিম দিন ঘনিয়ে আসছে।

ঢাকার মণিপুরিপাড়ার বাড়িতে বসে তাঁর স্ত্রী মিলি রহমান আমাকে এসব কথা বলেন।

মিলি রহমান আরও বলেন, ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার পরও মতিউর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। দেশে বড় ধরনের কোনো ওলট-পালট ঘটতে চলেছে কি না তার অপেক্ষা করতে থাকেন। মার্চের ১ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে ঢাকাসহ সারা দেশে যে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়, তা লক্ষ করে মতিউরের মনে হয়, এই অবস্থায় তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।

৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভায় যোগ দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তাঁর মনে হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে আর অখণ্ডরূপে টিকে থাকা সম্ভব হবে না, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে জনসাধারণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। যতই দিন যায়, ততই তাঁর এই ধারণা প্রবল হতে থাকে যে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে তাঁর মনে এই আশঙ্কাও জাগে যে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম নস্যাৎ করতে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে; যা কিছুই ঘটুক না কেন, তা যে অত্যন্ত গুরুতর কিছু হবে, সেটি তিনি বুঝতে পারছিলেন। মতিউর অপেক্ষা করতে থাকেন। মনে একই সঙ্গে আশা ও আশঙ্কা।

অসহযোগ আন্দোলনের একটা বড় সময় তিনি ঢাকায় অবস্থানরত বাঙালি বিমানবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার ছিলেন বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর নেতৃত্বে বিমানবাহিনীর বাঙালি অফিসাররা সংঘবদ্ধ হন। উইং কমান্ডার এম কে বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার এম সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহসহ বিমানবাহিনীর আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী গোপনে নিয়মিত মিলিত হয়ে বৈঠক করতেন। মতিউর তাঁদের অন্যতম সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বিমানবাহিনীর ১৮ জন বাঙালি অফিসার এবং প্রায় ৫০ জন টেকনিশিয়ান ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন, ভারতে চলে যাবেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন।

default-image

২৫ মার্চ সকালে তিনি নরসিংদীর রায়পুরায় বাবা-দাদার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। তাঁর ধারণা ছিল না যে সেদিনই মধ্যরাতে ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক নামবে, শুরু করা হবে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞ। সেটা শুরু হলে তিনি দাদার গ্রামে আটকা পড়ে যান, ঢাকায় ফেরা আর সম্ভব হয় না। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন না। কারণ, নিষ্ক্রিয়তা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি দাদার গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন।

মিলি রহমান বলেন, মতিউর গ্রামের তরুণ-যুবকদের প্রতিদিন নিয়মিত শরীরচর্চা করাতেন, অস্ত্র চালনা, পরিখা খনন ইত্যাদি শেখাতেন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তিনি করেন, তা হলো যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, সাহস জোগানো।

মতিউর রহমানের স্বাধীনতার ভাবনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর সহধর্মিণী বলেন, পুরান ঢাকার আগা সাদেক লেনের ছেলে মতিউরকে তাঁর বাবা ভালো পড়াশোনার জন্য শৈশবেই পাঠিয়ে দেন পশ্চিম পাকিস্তানে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি সেখানেই পড়াশোনা করেন, তারপর ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ারফোর্স একাডেমিতে। বিদ্যালয়ে পড়াশোনার এই পুরোটা সময় তিনি নানা রকমের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় মতিউরের চাকরির বয়স হয়েছে মাত্র দুই বছর, তখন পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের সুরক্ষা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন বলে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

মতিউর রহমান জন্ম: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫, মৃত্যু: ২০ আগস্ট ১৯৭১, জন্মস্থান: ১০৯ আগা সাদেক রোড, ঢাকা, যুদ্ধ: টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনিয়ে নিয়ে ভারতীয় সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা, পদবি: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, সমাধি: প্রথমে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর গোরস্থানে। পরে তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মতিউর রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দশ-এগারো বছর বয়স থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও ওই অঞ্চলের প্রতি মতির কোনো রকম আকর্ষণ বা মমতা জন্মায়নি। দুই দেশের জলবায়ু, ভাষা, জীবনযাপন প্রণালি, মানসিকতা ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই আকাশ-পাতাল তফাত, সেটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। কিংবা বলা যায়, তাঁর মতো এমন করে অন্য অনেকে হয়তো উপলব্ধি করতেন না। সুযোগ ও প্ররোচনা থাকা সত্ত্বেও তিনি অবাঙালি মেয়ে বিয়ে করেননি, তাঁর বন্ধুরাও যাতে না করেন, সেদিকে মতির খেয়াল ছিল। তাঁর সন্তানেরা যাতে বাংলায় সহজে কথা বলতে শেখে, তার জন্য তিনি বাসায় উর্দুভাষী লোক পর্যন্ত রাখতেন না। অনেক খরচ ও হাঙ্গামা করে দেশ থেকে বাঙালি কাজের লোক নিয়ে যেতেন।’

মিলি রহমান বলেন, নবম-দশম শ্রেণিতে উঠে মতিউর রহমানের মনে হয়, পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে এত যে বৈষম্য, এটা অনন্তকাল চলতে পারে না। একদিন না একদিন এর অবসান ঘটবেই।

মতিউর রহমান ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। কর্মজীবনেও তিনি একই রকমের বৈষম্য লক্ষ করেন। মিলি রহমান বলেন, মতিউরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৯৬৮ সালে; ‘বিয়ের পর থেকেই উনি আমাকে বলতেন, এই বৈষম্য চলতে পারে না। আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে। তুমি আমার পাশে থেকো।’

নরসিংদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া চলছিল; এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তান বিমানবাহিনী আশুগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, রায়পুরা এলাকায় বিমান থেকে বোমা হামলা করে। তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘জানো, যে পাকিস্তানি পাইলটরা আমাদের লোকজনের ওপর বোমা ফেলছে, আমি ওদের ট্রেনিং দিয়েছি!’

সেই সময় মতিউর রহমানের উপলব্ধি জাগে, শুধু রাইফেল চালিয়ে আর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না, আমাদের প্রয়োজন হবে জঙ্গি বিমান। মিলি রহমান বলেন, মতিউর রহমান যখন দেখলেন পাকিস্তানি আকাশ থেকে আমাদের ওপর বোমা ফেলছে আর আমরা অসহায়ের মতো মারা যাচ্ছি, ঠিক ওই সময়টাতেই তাঁর মনে বিমান ছিনতাই করার ভাবনাটি আসে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চার সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। এই পুরোটা সময় মতিউর তাঁর দুই বছর ও ছয় মাস বয়সী দুটি কন্যাসন্তানকে একবারও দেখার সুযোগ পাননি। ২৩ এপ্রিল তিনি অবশেষে ঢাকায় তাদের কাছে ফিরে আসেন। ভাবতে থাকেন কী করা যায়।

এর মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতে চলে গেছেন। অনেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মতিউর পড়ে যান এক জটিল সন্ধিক্ষণের মুখে: কী করবেন তিনি? অভিভাবকদের প্রচণ্ড চাপ, পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হবে, ঢাকায় কোনো নিরাপত্তা নেই। কিন্তু তিনি ভাবছেন, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পালিয়ে চলে যাবেন ভারতে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই বাধ্য হন। সঙ্গে স্ত্রী ও কন্যাদেরও নিয়ে যান, কারণ ঢাকায় তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই।

৭ মে তিনি সপরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে কর্মস্থলে যোগ দেন। কিন্তু তার পরও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার ভাবনাটা তাঁকে ছেড়ে যায় না। তিনি ভাবেন, কীভাবে সেটা করা যায়। ভাবেন, একটা বিমান ছিনতাই করে ভারতে চলে যাবেন। সেখানে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করবেন। কিন্তু তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত সব বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈনিকদের ওপর কড়া নজরদারি করা হচ্ছিল। এর মধ্যেই তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইনসের একটা বিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে সেই পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয় না। অবশ্য কারা এমন পরিকল্পনা করছে, তা সামরিক কর্তৃপক্ষ জানতে পারেনি। তা সত্ত্বেও তারা সব বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিককে গ্রাউন্ডেড করে। বিমানবাহিনীর সব বাঙালি অফিসারের জন্য বিমান চালানো নিষিদ্ধ করা হয়।

মতিউর রহমান ছিলেন বিমানবাহিনীর বৈমানিকদের প্রশিক্ষক। ২০ আগস্ট শুক্রবার রাশেদ মিনহাজ নামে তাঁর এক অধস্তন অফিসার একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একটি টি-৩৩ বিমান সে জন্য প্রস্তুত ছিল। মতিউর সেটা ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় কন্ট্রোল টাওয়ারে দায়িত্বরত ছিলেন ফরিদউজ্জামান নামের একজন বাঙালি অফিসার এবং একজন পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর বিমানটি নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে ঢোকার জন্য ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে যান। মতিউর তখন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে দ্রুত সেখানে চলে যান এবং রাশেদ মিনহাজকে থামার সংকেত দেন। মতিউর ছিলেন ফ্লাইট সেফটি অফিসার; কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও ফ্লাইট সেফটি অফিসার বিমান থামানোর সংকেত দিলে সেই নির্দেশ পালন করাই নিয়ম। রাশেদ মিনহাজ ট্যাক্সি ট্র্যাকের মাঝখানে বিমানটি দাঁড় করিয়ে বিমানের ক্যানোপি তুলে মতিউরকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হয়েছে? তখন মতিউর লাফ দিয়ে বিমানটির ককপিটে উঠে পড়েন।

তার পরের ঘটনার বিবরণ সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, মতিউর রাশেদ মিনহাজকে চেতনানাশক দিয়ে সংজ্ঞাহীন করে বিমানটি চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে থাকেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর রাশেদ মিনহাজ সংজ্ঞা ফিরে পান এবং দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ফলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে দুজনই মারা যান। অন্য একটি ভাষ্যে বলা হয়, দুজনের মধ্যে শুরু থেকেই ধস্তাধস্তি চলে এবং বিমানটি একাত-ওকাত হয়ে আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানটির পাখা দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে রাশেদ মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। কিন্তু রাশেদ মিনহাজের কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না। বিমানটি খুব নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, সম্ভবত রাডারে ধরা পড়েনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি কন্ট্রোল টাওয়ারের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ার তখন বেস কমান্ডারকে বিষয়টি জানায়। তারা আশঙ্কা করে, বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান সেই টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমানের খোঁজে আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু সেটির কোনো হদিস তারা পায়নি।

বিকেলের দিকে খবর আসে, ভারত সীমান্তের কাছে তালাহার নামের একটি জায়গায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে উভয় আরোহী মারা গেছেন। রাশেদ মিনহাজের দেহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং মতিউর রহমানের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

মতিউর রহমানকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর গোরস্তানে কবর দেওয়া হয়, তবে অফিসারদের কাতারে নয়, সৈনিকদের কাতারে। তাঁর স্ত্রীকে একটা বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়, দিনের পর দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার মতিউর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৬ সালে তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে এনে কবরস্থ করা হয়। তিনি বীর। তিনি আমাদের ইকারুস? গ্রিক পুরাণের ইকারুস আকাশে উড়তে চেয়েছিল। কিন্তু সূর্যের তাপে পুড়ে গিয়েছিল তার পাখা। মতিউর রহমানও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উড়েছিলেন, কিন্তু তাঁর নিয়তিও ইকারুসের মতো। তাই তিনি যথার্থই বাংলার ইকারুস।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত