বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৪১ সালের ৮ ডিসেম্বর জাপান ফিলিপিন্স আক্রমণ করে এবং নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব রণাঙ্গনে তখন জাপানের জয়জয়কার। ভারতবর্ষ ছাড়া এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই জাপানের দখলে-ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের দখল থেকে মুক্ত। ফিলিপিন্স দখল করার আগের দিন, ৭ ডিসেম্বর জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে ওই বন্দরে অবস্থানরত ১৯টি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয় এবং প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন নৌসেনা নিহত হয়। পশ্চিম রণাঙ্গনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সমঙ্াদিত অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার যে ভুল করেছিলেন, পার্ল হারবার আক্রমণ করে পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানও সেরকম ভুল করে। দুই রণাঙ্গনের এই দুটি ‘ভুল’ পরিহার করা গেলে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতো; আমার বিশ্বাস, মঙ্গলজনক হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের ব্যাপারে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ আছে, কিন্তু আজকে আমি আমাদের বিজয় দিবস সমের্ক লিখতে বসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ভিন্ন কারণে-কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়। পার্ল হারবার ধ্বংস করার পর দিন ৮ ডিসেম্বর জাপান ফিলিপিন্স দখল করে নেয় এবং একই তারিখে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়ার ঘোষণা দিয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পশ্চিম রণাঙ্গনে অবশ্য আমেরিকা, জার্মানি এবং ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১১ ডিসেম্বর। এই বিলম্বের হেতু সন্ধান করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের গবেষকরা নিরাশ হবেন বলে মনে হয় না।

ক্রিমিয়া সম্মেলনে (ফেব্রুয়ারি ৪-১১) রুজভেল্ট, চার্চিল এবং স্তালিন স্থির করেছিলেন যে, জাপানকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব পাবেন স্তালিন অর্থাত্ সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ধান কাটার সময় যখন এল, তখন জাপানের নাগাসাকি এবং হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফেলে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করল আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট এবং ৯ আগস্ট। কোল্ড-ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের সূচনালগ্ন বলতে আমি তাই ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টকেই বুঝি। পরমাণু বোমা আমেরিকা জাপানের নাগাসাকিতে ফেললেও, ওটা ছিল জাপানের দিকে আগুয়ান সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিবৃত্ত করার প্রত্যক্ষ প্রয়াস এবং স্টিলম্যান স্তালিনের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি।

আমেরিকান সৈন্য ফিলিপিন্সের মাটিতে অবতরণ করে ১৯৪৪ সালের ২০ অক্টোবর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে জাপান আত্মসমর্পণ করে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫। মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার জাপানের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার পরের বছর, ১৯৪৬ সালের ৪ জুলাই ফিলিপিন্স স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাপানের বিরুদ্ধে আমেরিকার বিজয় আর ফিলিপিন্সের বিজয় এখানে পরসঙ্র সমর্ঙ্কযুক্ত। কিন্তু ফিলিপিন্সের বিজয় দিবসে আমেরিকাও তাদের বিজয় দিবস পালন করে, এমন তথ্য আমার জানা নেই। আমরা যেহেতু পূর্ব রণাঙ্গনের অধিবাসী সেজন্য পূর্ব রণাঙ্গনের একটি দেশের কথাই উল্লেখ করলাম। পশ্চিম রণাঙ্গনে এরকম দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি আছে।

গত কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, ভারতের পূর্ব রণাঙ্গনের হেডকোয়ার্টার, কলকাতায় অবস্থিত রবার্ট ক্লাইভ প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম আমাদের বিজয় দিবসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, ডিসেম্বরের ৩ তারিখ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিজয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিবেশী ভারত আমাদের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, আমাদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল এবং অন্তিম পর্যায়ে পাকিস্তান কর্তৃক পশ্চিম রণাঙ্গনে আক্রান্ত হওয়ার পটভূমিতে পূর্ব রণাঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ জড়িয়ে পড়েছিল। ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যেমন দ্রুত সমাপ্তির দিকে ধাবিত হয়, তেমনি পাক-ভারত যুদ্ধও ভারতের অনুকূলে দ্রুত শেষ হয়। পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানের পরাজয়, বলাবাহুল্য, পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানের পরাজয়েরই ফল।

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বেশ কিছু ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছেন। আমরা তাঁদের উদ্দেশ্যে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করি। ভারতের তত্কালীন সরকার এবং ভারতের জনগণের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ছিল, আছে এবং থাকবে। এটা ইতিহাস। এই সত্যকে অস্বীকার করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে কণ্টকযুক্ত করে দেশপ্রেমিক সাজার কোনো প্রয়োজনও নেই, সম্ভবও নয়। আমাদের দিক থেকে এই ত্রুটি আমরা কখনো কখনো লক্ষ করেছি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী বর্ষের অনুষ্ঠানটির কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। অকৃতজ্ঞতার স্থূল নিদর্শন ছিল তাতে।

ভারতের বিরুদ্ধে বা পক্ষে কিংবা বাংলাদেশের পক্ষে বা বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমি কলম ধরিনি। আমি আমার ন্যায়বোধ দ্বারা তাড়িত হয়েই এ লেখা লিখতে বসেছি। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের প্রধান, ভারতীয় জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার সামনে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর প্রদানের যে ঐতিহাসিক ছবিটি আমাদের বিজয় দিবসে ছাপা হয়-সে ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে এ. কে. খন্দকার উপস্থিত থাকলেও, তার জন্য যে কোনো চেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয়নি-তাকে যে অনেকের মতো দর্শক সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল-সেজন্য দায়ী কে? খন্দকার সাহেব নিশ্চয়ই নিয়াজির সামনে চেয়ারে বসতে আপত্তি করেননি। তাহলে? আপত্তিটা কার? ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের মূল্য বুঝেই যারা সেদিন খন্দকার সাহেবকে মর্যাদা প্রদানে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তারাই বাংলাদেশের রক্তরঞ্জিত অভ্যুদয়কে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফসল’ হিসেবে দেখাতে চাইছে বলে সন্দেহ হয় বৈকি।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড কলকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়ামে যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজয় দিবস পালনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, ভারতের টিভি চ্যানেলে সেসব সংবাদ শুনে এবং সংবাদচিত্র দেখে আমি অস্বস্তি বোধ করছি। ভারতের প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই তার আচরণের মধ্যে হীনম্মন্যতার প্রকাশ দেখে লজ্জিত বোধ করি।

১৯৯১ সালে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। আমার যাওয়ার দু-তিন দিন পরেই দেখি নিউইয়র্কের পথে পথে বিরাট বিরাট মিছিল। কীসের মিছিল? বন্ধু বলল, বিজয় মিছিল। কীসের বিজয়? পার্সিয়ান গালফে সাদ্দামের বিরুদ্ধে কুয়েত যুদ্ধে আমেরিকার বিজয়। শুনে হাসি পেল। মনে হলো, ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে এরা। এত ছোট জয়ের এত বড় বিজয় মিছিল সেজন্যই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় মিছিল তো এরা করে না। ১৯৭১ সালে পূর্বাঞ্চলে অর্জিত বিজয়কে বাংলাদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পালন করার ভারতীয় প্রয়াস দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমেরিকার মতোই সেও হয়তো চীনের সঙ্গে পরাজিত হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসেবেই ১৬ ডিসেম্বরকে বেছে নিয়ে থাকবে। যা ভারতের আকৃতি, প্রকৃতি এবং আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে ১৬ ডিসেম্বরের জন্ম দিতে গিয়ে ভারতের ৩ হাজার সৈন্য প্রাণ দিয়েছে, সেই ১৬ ডিসেম্বরের জন্ম দিতে গিয়ে বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। সুতরাং হাতছাড়া হওয়ার মতো তুচ্ছ বিজয় আমাদের নয়।

ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ককে বলি-আপনাদের রাষ্ট্রভাষা তো বাংলা নয়, হিন্দি। সর্বত্রই যদি হিন্দি, তাহলে ১৬ ডিসেম্বরের বেলায় বাংলা কেন? বাংলাদেশ যখন ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস বলছে, তখন আপনারা দয়া করে অন্য একটা হিন্দি নাম বেছে নিন না।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে লেখা আমার কবিতা ‘প্রথম অতিথি’ বঙ্গভবনের একটি অনুষ্ঠানে আমি নিজ হাতে তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম। আমি তখন নিতান্ত তরুণ। আমার কবিতাটি পেয়ে, তাঁকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছি জেনে, তিনি খুবই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সমের্কর দিনগুলো স্মরণ করেন। আমি সবচেয়ে মুগ্ধ হই তাঁর যে কথা শুনে তা হচ্ছে, ‘আপনারা মহান এক জাতি। আপনাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আপনারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। আমি কেবল চেষ্টা করেছি আপনাদের সহায়তা দিতে। আমার এই সামান্য অবদানের কথা আপনি আপনার কবিতায় উল্লেখ করেছেন, সে জন্যে আমি অত্যন্ত গর্বিত।’ আমার কবিতা হাতে পাওয়ার পর তিনি এভাবেই তাঁর বিনয়ী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। হুবহু হয়তো এ রকম নয়, তবে তার বক্তব্যের ভাবার্থটা এ রকমই ছিল। সেদিন বঙ্গভবনে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ ‘বুদ্ধিজীবী’। অন্য যারা ছিলেন, যারা এখনো বেঁচেবর্তে রয়েছেন-স্মৃতিভ্রষ্ট না হলে তারা হয়তো আরো ভালো বলতে পারবেন।

মিসেস গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে লো প্রোফাইলে মূল্যায়ন করে আমাদের মনে ভারতের যে উদার ও নিরহঙ্কার মূর্তিটি এঁকে দিয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে ভারত কি সেই সৌজন্যের খোলস ভেঙে ফেলতে চায়? ‘তোমার জয় তো আমারই জয়’, এই রবীন্দ্র-ভাবনায় সে কি আস্থা রাখতে পারছে না?

ভারত যেভাবেই ১৬ ডিসেম্বর মূল্যায়ন করুক, আমার কর্তব্য হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন এবং ভারতীয় সৈনিকদের মধ্যে যারা প্রাণ দিয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, যারা আমাদের মুক্তিবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদের অবদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা। হীনম্মন্যতার পরিচয় যেন আমাদের আচরণে, আমাদের মূল্যায়নে প্রকাশ না পায়। সেটাই আমরা করতে পারি এবং প্রত্যাশা করি, ওই পক্ষ থেকেও শুভবোধ বজায় রাখা হবে।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত