বিজ্ঞাপন
default-image

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাঙালি নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু প্রবাসে ভারতীয় জাতীয় মুক্তিফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন করেছিলেন। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগেই ১৯৪২ সালে তিনি এক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। সুভাষ বসুর উদ্যোগ মাঝপথে থেমে যায়। ভারতের স্বাধীনতা আসে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে।

সুভাষ বসুর মৃত্যুর ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, তা সফল হয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল একটি নতুন রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসে আলোচনা নয়, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার নেতা। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করলে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর সহযোগীদের ওপর।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে স্বাধীনতাকামী বাঙালি প্রথমে দেশের ভেতরেই প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা যখন প্রতিটি শহরে ও গ্রামে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে, তখন দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মার্চের শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সহযোগী আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত পার হন এবং ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারত সরকারের সহযোগিতা চান। প্রশ্ন হলো, কাকে এবং কীভাবে সহযোগিতা দেবে তারা? এ জন্য একটি আইনানুগ কাঠামো দরকার।

আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে পরামর্শ করে তাজউদ্দীন আহমদ ঠিক করলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকার গঠন করবেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দলের ছয় সদস্যের হাইকমান্ড—আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও তিন সহসভাপতি, তাদের নিয়ে সরকার গঠিত হবে। বঙ্গবন্ধু হবেন সরকারের প্রধান বা রাষ্ট্রপতি। তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তাজউদ্দীন আহমদ হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং হাইকমান্ডের অপর তিন সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী ও এইচ এম কামারুজ্জামান মন্ত্রিসভার সদস্য থাকবেন।

এরপর তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ফিরে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের খুঁজে বের করলেন; তাঁদের রাজি করাতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। দলের যুবনেতারা সরকারের পরিবর্তে বিপ্লবী কাউন্সিল বা যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তাজউদ্দীন আহমদ যুক্তি দেখালেন, সরকার গঠন না হলে ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশই বিপ্লবী পরিষদকে সুনজরে দেখবে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দলের যুবনেতারা তাঁর যুক্তি মেনে নিলেন। এ ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন সৈয়দ নজরুলের সমর্থন পেয়েছিলেন।

১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।’

পৃথিবীতে মাত্র দুটি দেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র আছে—বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে ১১ এপ্রিল একাধিকবার প্রচারিত হয়। এই প্রথম দেশ ও বিদেশের মানুষ জানল, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এই ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদমসন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।...সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না।’

ওদিকে পাকিস্তান প্রচার চালাতে থাকে বাংলাদেশ বলে কিছু নেই। সব ভারতের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র। এর জবাবে বাংলাদেশের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, ১৭ এপ্রিল দেশের মাটিতেই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে। স্থান নির্ধারণ করা হয় কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) আতাউল গনি ওসমানীসহ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তারা। প্রথমে কোরআন তিলাওয়াত হলো। তারপর বাংলাদেশের মানচিত্রশোভিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো। স্থানীয় চার তরুণ গাইলেন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...।’

শপথ গ্রহণের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে নবগঠিত রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিশ্ববাসীর সহায়তা চাইলেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সাংবাদিকেরা জানতে চান, বাংলাদেশের রাজধানী কোথায়? জবাবে তিনি বলেন, ‘মুজিবনগর।’

মুজিবনগরই ছিল যুদ্ধকালে সরকারের রাজধানী, প্রতীকী অর্থে। প্রকৃতপক্ষে কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডই হয় বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়। ১৮ এপ্রিল কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের সব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে সেই ভবনটি পররাষ্ট্র দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নিজের অফিসের পাশেই একটি কক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন। সরকারের অন্য সদস্যরা থাকতেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যত দিন দেশ শত্রুমুক্ত না হবে, তত দিন পরিবারের সঙ্গে থাকবেন না। কেননা লাখ লাখ মানুষ তখন পরিবার পরিজন ছাড়া রণাঙ্গনে কিংবা আশ্রয়ের সন্ধানে।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তৃতায় বেশি দিন যুদ্ধ চলবে না বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেও দীর্ঘ মেয়াদে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। একটি স্বাধীন দেশের সরকার পরিচালনায় যে কাঠামো দরকার, তার সবটাই তিনি করেছিলেন। বিশেষ করে পরিকল্পনা কমিশন গঠন ছিল তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফল।

default-image

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ বারবার বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। একপর্যায়ে দলের বেশ কিছু সাংসদ তাঁর প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। কিন্তু ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সেসব বাধা অতিক্রম করেন তিনি। আগস্ট মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আমেরিকান মিশনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেন, যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রধানমন্ত্রী এই অভিসন্ধি জানতে পেরে মোশতাককে বাদ দিয়ে লন্ডনে অবস্থানরত আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল পাঠান জাতিসংঘে।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন যথাক্রমে জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত, আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত), এম এ মঞ্জুর, এম এ জলিল, এ এন এম নুরুজ্জামান, কাজী নুরুজ্জামান, এম এ বাশার। নয় মাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত