বিজ্ঞাপন
default-image

৫ আগস্ট ১৯৭১-এ পাকিস্তানের তথ্য ও জাতীয়বিষয়ক মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক মহলকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত ঘটনা’ জানানোর জন্য পূর্ব পাকিস্তান সংকট শিরোনামে একটি শ্বেতপত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ করে। এ সময় আন্তর্জাতিক প্রেস বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের যে বিবরণ প্রকাশ করে, শ্বেতপত্রে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনোরূপ ঘোষণা ছাড়াই ঢাকার জনগণ, ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহ হঠাত্ আক্রমণ করে যে যুদ্ধের সূচনা করেছিল তার দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ সকালে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করতে যাচ্ছিল, এই খবরের ভিত্তিতেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

শ্বেতপত্রে বর্ণিত ঘটনার কারণ ও ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা এবং আবেদন আন্তর্জাতিক প্রেস বা সংবাদ মিডিয়া ও বিশ্বজনমত গ্রহণ করেনি। ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ প্রাণে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে-শ্বেতপত্রে এসবের কোনো উল্লেখই নেই। মিডিয়ার মাধ্যমে এসব খবর দেশে দেশে পৌঁছে গেছে। ফলে পাকিস্তানি শ্বেতপত্র বিশ্বজনমতের ওপর কোনোরূপ প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়।

তবে শ্বেতপত্রে ১৬ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি ইয়াহিয়া খান ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবং তার দলের নেতাদের দফায় দফায় বৈঠক, আলোচিত বিষয়ের বর্ণনা ও সিদ্ধান্তসমূহ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। এর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কারণ আলোচিত বিষয় সমের্ক কোনো পক্ষ কোনো সময়ই আলোকপাত করেনি, জনগণকেও এ সমের্ক অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। শ্বেতপত্রে এ সময়ের প্রতিদিনের আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহের যে বিবরণ ছিল তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ :

ক. ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিব দেখা করেন, বৈঠকে তিনি তার চার দফা দাবি জানালেন। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের দাবিসমূহ অবহিত হলেন।

খ. ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের আবার বৈঠক হলো। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে জানালেন, তিনি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নীতিতে অটল। যত শিগগিরই সম্ভব তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

সে দিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সদস্য ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সহায়তাকারীদের আরো এক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, এ নিয়ে তাদের মধ্যে খুঁটিনাটি আলাপ-আলোচনা হলো। এ সমির্কত আইনের একটি খসড়াও প্রণীত হলো। এতে প্রাদেশিক পর্যায়ে গভর্নরকে সহায়তা করার জন্য প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রিসভা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই খসড়া আইনে ক্রমান্বয়ে সামরিক আইন তুলে নেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়। ১ মার্চ থেকে কী অবস্থায় জোন-বি অঞ্চলে অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী নামানো হলো, সে সমের্ক তদন্তের জন্য প্রেসিডেন্ট একটি কমিশন গঠনের আদেশ প্রদান করেন।

default-image

গ. ১৮ মার্চ শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে তদন্ত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক আইনের আদেশে গঠিত কমিশন ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল করার বিধান উভয়ই তার কাছে আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে বলে তিনি জানান।

ঘ. ১৯ মার্চ আবার প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য একটি খসড়া সামরিক আইন রেগুলেশন জারির ওপর গুরুত্বারোপ করলেন। তিনি কেন্দ্রে ও প্রদেশের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদকে আইন প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানালেন।

সে দিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের সহকর্মী ও প্রেসিডেন্টের সহায়তাকারীদের মধ্যে আরো একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি প্রতিনিধিদল বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চের মার্শাল ল প্রত্যাহার করা হলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠনের জন্য বর্তমান সরকারের বৈধতা থাকবে না। এলএফও সামরিক আইনের আওতায় প্রণীত। সামরিক আইন এখনই প্রত্যাহার করা হলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে।

তাজউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেন, এগুলো রাজনৈতিক বিষয়, রাজনৈতিকভাবেই এগুলোর সমাধান করতে হবে। ড. কামাল হোসেন পরামর্শ দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন প্রশাসকের পদবি ও ক্ষমতা ত্যাগ করে শুধু প্রেসিডেন্টের পদবি ও ক্ষমতা গ্রহণ করলে কোনো সমস্যা থাকে না। প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা আওয়ামী লীগের দাবির আলোকে আরো একটি সামরিক আইন রেগুলেশনের খসড়া প্রণয়ন করলেন। খসড়া আইনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত সুযোগ সৃষ্টি হলো :

১. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ গঠন।

২. ১৯৬২ সালের সংবিধানের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান।

৩. সামরিক আইন প্রশাসকদের অফিস ও সামরিক আদালতসমূহ বিলুপ্ত করা হয়। তবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অফিস বহাল রাখা হয়।

ঙ. ২০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ও তার সহযোগীদের সঙ্গে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক হয়। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানান যে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের যেকোনো প্রক্রিয়ায় সব দলের অনুমতি প্রয়োজন। সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায়নের আইনগত বৈধতা প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা আওয়ামী লীগের সামনে তুলে ধরেন। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ প্রধান ও তার সহকর্মীদের জানালেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবটি সাংবিধানিক আইনের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। আওয়ামী লীগ তাদের পক্ষে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ কে ব্রোহীর নাম উল্লেখ করল। আওয়ামী লীগ ও সরকারপক্ষের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিম্নবর্ণিত লক্ষ্যে সবাই সম্মত হন :

১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে।

২. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

৩. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিতে হবে।

৪. ভৌগোলিক কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে অধিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।

আওয়ামী লীগকে বলা হলো ২৫ মার্চ যে জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করা হয়েছে তাতে উল্লিখিত লক্ষ্য সমের্ক আইনগত বিধান সৃষ্টি করা না হলে মার্শাল ল অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্টের এ প্রস্তাবে শেখ মুজিব সম্মত হলেন না।

একই দিনে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ঘোষণার একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়। খসড়ায় নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর উল্লেখ ছিল :

১. যে দিন প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা শপথ নেবেন, সে দিনই সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে।

২. অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ১৯৬৯ সালের ৪ এপ্রিল জারি করা প্রভিশনাল সাংবিধানিক আদেশ সংবিধান হিসেবে গণ্য হবে।

৩. এই ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনিই অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন।

৪. প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রদত্ত সমুদয় ক্ষমতা ও প্রভিশনাল সংবিধান আদেশে প্রদত্ত সমুদয় ক্ষমতা তিনি প্রয়োগ করবেন।

৫. পাকিস্তানের উভয় অংশের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হবে।

৬. ১৯৬২ সালের সংবিধানে বর্ণিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের কার্যক্রম এলএফও মোতাবেক পালিত হবে।

৭. ১৯৬২ সালের সংবিধান বর্ণিত তৃতীয় তফসিলের বিষয়াসমূহ সমির্কত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

৮. ১৯৬২ সালের সংবিধান বর্ণিত প্রাদেশিক পরিষদের কার্যক্রম এলএফও বর্ণিত প্রাদেশিক পরিষদ সমঙ্ন্ন করবে। যেসব ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে জাতীয় পরিষদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে প্রাদেশিক পরিষদ আইন প্রণয়ন করবে।

৯. প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্টের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে গভর্নর দায়িত্বরত থাকবেন।

১০. প্রদেশে একজন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। মন্ত্রিসভা দায়িত্ব পালনে গভর্নরকে সহায়তা করবে। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য ছাড়া কেউ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হবেন না।

১১. এই ঘোষণার সাত দিনের মধ্যেই ঢাকা ও ইসলামাবাদে দুটি কমিটি গঠিত হবে। কমিটি জাতীয় পরিষদ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সংবিধানে যেসব প্রাদেশিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে তার তালিকা প্রণয়ন করবে।

১২. কমিটিদ্বয়ের দাখিলকৃত সুপারিশপ্রাপ্তির পর প্রেসিডেন্ট তার ইচ্ছানুযায়ী তারিখ, সময় ও স্থান নির্ধারণ করে সংবিধান রচনার জন্য কেন্দ্রীয় সংসদের অধিবেশন ডাকবেন।

১৩. প্রয়োজন মোতাবেক প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ঘোষণাবলে প্রদেশের আংশিক বা সমুদয় ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারবেন।

চ. ২১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে বসলেন এবং প্রেসিডেন্টকে জানালেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আওয়ামী লীগ সেদিন সংবিধান বিশেষজ্ঞ হাজির করতে পারেনি।

ছ. ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিয়ে এক বৈঠক করলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ২৫ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের বৈঠক মুলতবি করা হলো। মুলতবিকৃত বৈঠক ২ এপ্রিল ডাকার কথা হলে তিনি এ প্রস্তাবও মানলেন না। এ দিন প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ও আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীনকে দেওয়া হলো।

এ দিন সন্ধ্যায় ভুট্টো তার সহযোগীবৃন্দসহ প্রেসিডেন্টের সহযোগীদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে প্রেসিডেন্টের ঘোষণা সমির্কত কিছু জরুরি বিষয় উত্থাপন করলেন :

১. সামরিক শাসন তুলে নিলে তা জাতীয় পরিষদ কর্তৃক দৃঢ়কৃত করা না হলে প্রস্তাবিত ঘোষণার কোনো বৈধতা থাকে না। তাদের প্রস্তাবিত ঘোষণাটি জাতীয় পরিষদের অনুমোদনের পরই কেবল তা কার্যকর হবে। বিকল্প হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা একযোগে ধরে রাখলে কোনো অসুবিধা হবে না।

২. পিপিপি মনে করে, প্রয়োজনীয় আইনগত বৈধতা না থাকায় ঘোষণাটি অর্থবহ হবে না। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি স্বাধীনতা ঘোষণাও করে, আইনগতভাবে তাদের বাধা প্রদান করা যাবে না।

৩. আওয়ামী লীগ যাতে জাতীয় পরিষদে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োগ করতে না পারে, তার জন্য পাকিস্তানের উভয় অংশে পৃথক পৃথকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন না পেলে কোনো আইন বা সংবিধান জাতীয় পরিষদে পেশ করা যাবে না।

৪. ১৯৬২ সালের সংবিধানের তৃতীয় তফসিলের কোনোরূপ পরিবর্তন সাধন করা যাবে না।

৫. প্রাদেশিক গভর্নরের নিয়োগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সুপারিশে হতে হবে। প্রাদেশিক গভর্নরদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে সংশোধনীর প্রয়োজন।

৬. প্রস্তাবিত ঘোষণা জারি হওয়ার পর এলএফওর কী হবে কিছুই বলা হয়নি। এক্ষেত্রে এলএফও-কে কীভাবে রক্ষা করা হবে?

৭. পিপিপি মনে করে, জাতীয় পরিষদ একক সত্তা হিসেবে প্রথম অধিবেশনে বসবে। তারপর দুটো কমিটি গঠন করতে হবে।

জ. ২৩ মার্চ সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে প্রেসিডেন্টের সহযোগীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি বৈঠক হলো। আওয়ামী লীগের পক্ষে নিজের তৈরি একটি খসড়া ঘোষণা দাখিল করলেন ড. কামাল হোসেন। দেশে বিরাজমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের আগের খসড়া ঘোষণাটি বিবেচনায় আনতে রাজি হলো না। এমনকি তারা তাদের আগের ঘোষণার কোনো সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধনেও আগ্রহী ছিল না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নতুন ঘোষণার ওপর আলোচনা আরম্ভ হলো। বিভিন্নভাবে ঘোষণাটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হলো। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আলোচনাটি স্থগিত করা হলো।

সে দিনের সান্ধ্যকালীন অধিবেশনে সরকার পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত বিষয় আওয়ামী লীগকে জানানো হয় :

১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করার আগে যেকোনো ঘোষণা জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত/দৃঢ়ীকৃত হতে হবে।

২. আওয়ামী লীগের খসড়া ঘোষণায় প্রদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর যে দিন শপথ নেবেন সে দিনই মার্শাল ল প্রত্যাহার করা হলে প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেবে। মার্শাল ল প্রত্যাহার করা হবে সকল প্রদেশের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের পর। আর সেটাই হবে সমীচীন।

৩. আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত ঘোষণা জাতীয় পরিষদকে কার্যত ভেঙে দু টুকরো করবে, যা হবে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ। এটি হবে বিচ্ছিন্নতার উদ্দেশ্যে একটি সাংবিধানিক ফর্মুলা। এর পরিণতি শুভ হবে না।

৪. লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারে যে শপথনামার উল্লেখ আছে, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত ঘোষণার শপথনামা তা থেকে পৃথক।

৫. আওয়ামী লীগ তাদের প্রস্তাবিত ঘোষণায় চাচ্ছে ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’। তারা সঙ্ষ্টতই উল্লেখ করেছে, পাকিস্তান কনফেডারেশন মানে হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের ইউনিয়ন। এটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ও আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির পরিপন্থি। দুটোতেই বলা হয়েছে পাকিস্তান হবে ‘ফেডারেল রিপাবলিক’।

৬. আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করা হলে তাতে তিনি সম্মত হয়ে নিশ্চয়ন করতে না পারলে তা নিশ্চয়ন করা হয়েছে, ধরে নেওয়া হবে। এরূপ ঘোষণা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ, যা এর ঘোষিত নীতিমালার সঙ্গে বিরোধ ঘটাবে।

৭. আওয়ামী লীগের ঘোষণায় বলা হয়, নির্ধারিত ১২টি বিষয় ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে কেন্দ্র মাথা ঘামাতে পারবে না। যদিও ১৯৬২ সালের সংবিধানে কেন্দ্রের জন্য ৪৯টি বিধান নির্ধারণ করা হয়েছিল।

৮. বৈদেশিক বিষয়াদি সমের্ক আওয়ামী লীগের খসড়া ঘোষণায় বলা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য ছাড়া শুধু পররাষ্ট্রবিষয়ক বিষয়াদি কেন্দ্রের আওতাভুক্ত থাকবে। আওয়ামী লীগ বৈদেশিক বিষয়ে ১৯৬২-র সংবিধানের সাতটি উপবিভাগকে বাদ দিয়েছে।

৯. আওয়ামী লীগের খসড়া ঘোষণায় বলা হয়, করারোপ ব্যবস্থা প্রদেশে নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। তবে সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদেশসমূহ নির্ধারিত চাঁদা প্রদান করবে। কেন্দ্রের সংবিধানকে দায়িত্ব নির্বাহের জন্য কেন্দ্রের করারোপের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। প্রাদেশিক আইন পরিষদের নিয়ন্ত্রিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি স্টেট ব্যাংক স্থাপনের কথা এই খসড়া ঘোষণায় বলা হয়। ফেডারেল স্টেট ব্যাংকের কাছে যেসব বিষয় রাখা হয় তা হলো : ক. পাকিস্তানি মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার হার নির্ধারণ; খ. পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের অনুরোধে কাগুজে মুদ্রার ছাড়করণ; গ. টাঁকশাল ও নিরাপত্তা প্রেসের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা; ঘ. পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের অনুরোধক্রমে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে নির্দেশিত কার্য সমঙ্াদন এবং ঙ. মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যে অর্থাত্ ৭ এপ্রিলের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে স্টেট ব্যাংক স্থাপন। এসব প্রস্তাবের কোনোরূপ সংশোধনেও আওয়ামী লীগ গররাজি ছিল।

১০. আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত খসড়া ঘোষণায় ১৯৬২ সালের সংবিধানের ৯৯, ১০৩, ১০৫, ১০৭, ১০৮, ১২২, ১১৩, ১১৪, ১১৯, ১২০, ১২১, ১২২ ও ১৩১-এর ২ উপধারা বাতিলের সুপারিশ করা হয় এবং ধারা ৬৭, ৬৮, ৭০, ৮০, ৮১, ৮২, ৮৪, ৮৬ ও ২৯৬-এর সংশোধন এবং ধারা ৯০-এর ও ৯০-এফ সংযোজনের জন্য বলা হয়। এই দুটি ধারা সংযোজন করা হলে সংবিধানের মূল সুর ও উদ্দেশ্য পাল্টে যাবে। ১৩১ ধারার ২ উপধারা ছিল ফেডারেল পাকিস্তানের জন্য অপরিহার্য। এতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ তিনটি ক্ষেত্রে প্রাদেশিক বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারবে, যথা :

ক. যেখানে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন।

খ. পরীক্ষণ ও সমন্বয় সাধনের জন্য।

গ. কোনো বিষয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সমতা আনয়নের জন্য।

আওয়ামী লীগ তার অবস্থান থেকে সরতে নারাজ। এমনকি পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নেও আওয়ামী লীগ ছিল নির্বিকার। প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার উদ্দেশ্য কেবল অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের অভাব পূরণ, অন্য কিছু নয়। তাই এখানে তাদের দাবি-দাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ প্রেসিডেন্টের সহকর্মীদের বলেন, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষণাটি জারি করতে হবে। ৪৮ ঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর খুব দেরি হয়ে যাবে, তখন এ ঘোষণাতেও কোনো কাজ হবে না।

শ্বেতপত্রে বর্ণিত ১৬ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত সময়ে সরকারি দল, আওয়ামী লীগ ও পিপিপির অনুষ্ঠিত বৈঠকসমূহের আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহ সত্য না মিথ্যা তা যথার্থভাবে যাচাই করার সুযোগ আর অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে ৩০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এসব বৈঠকের মূল চরিত্র ইয়াহিয়া, বঙ্গবন্ধু ও জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ লোকান্তরিত। বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীদের মধ্যে ড. কামাল হোসেনই কেবল বেঁচে আছেন। এ সমের্ক তিনি কখনো মুখ খুলেছেন বলে জানা নেই। সরকারি পক্ষের এম এম আহমদ ও জাস্টিস কর্নেলিয়াস যতদূর জানা যায়, লোকান্তরিত। লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান এখনো বেঁচে থাকলেও তারা সত্য প্রকাশ করবেন বলে মনে হয় না। জাস্টিস হামিদুর রহমানের রিপোর্ট ভারতে প্রকাশিত হওয়ার পর তাদের মাথার ওপর কোর্ট মার্শালের খাঁড়া ঝুলছে, তারা আত্মরক্ষামূলক বক্তব্যই প্রদান করবেন, যেমনটা সংশ্লিষ্ট অন্য জেনারেলরা করে এসেছেন। তাহলে ঐতিহাসিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের আসল হিসাব লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাবে? সুখের বিষয় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদান করতে গিয়ে এ সমের্ক কিছুটা আলোকপাত করেছেন, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তার ভাষণের অংশ থেকেই তার বক্তব্যের অংশবিশেষ উত্সুক পাঠকের অবগতির জন্য তুলে ধরা হলো। ওই সময়ের আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহ সমের্ক তিনি বলেন :

“১৬ মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তত্পূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কী? জবাবে ইয়াহিয়া জানান, এ ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন, চার দফার শর্ত পূরণের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।

“আলোচনাকালে যেসব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলো হলো :

মার্শাল ল’ বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।

প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।

ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।

জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।

“আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ভুট্টোর মনোনয়নের জন্য এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সে দিন নিজেই বলেছিলেন, ছয় দফা হলো বাংলাদেশ ও কেন্দ্রের মধ্যকার সমর্ঙ্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযোগ্য নীলনকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এমএনএদের পৃথকভাবে বসে ছয় দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলোকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।

“শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার এ নীতিগত মতপার্থক্যের পর একটিমাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তা হলো অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন। এক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এ মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ছয় দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আলোকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হবে।

“অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসা সমের্ক একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় তিনি সঙ্ষ্টভাবে এ কথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ছয় দফা কার্যকর করার প্রশ্নে দুর্লভ কোনো সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।

“আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে সে নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোনো বাধাই ছিল না।

“এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয়, কোনো পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাসে-ইঙ্গিতে এমন কোনো কথা বলেননি যে, তাদের এমন বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না। গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি ও তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল, তিনিও সেভাবে একটি ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাঁকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তা-ই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরে মুজিবকে এ সমের্ক কিছুই জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার-ইয়াহিয়া যদি আভাস-ইঙ্গিতেও এ কথা বলতেন, তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয় তাতে আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা না করে আলোচনা বানচাল করতে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোনো সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।

“২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে এম এম আহমদ তার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোনো চূড়ান্ত বৈঠক হয়নি। এম এম আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ মার্চ করাচি চলে গেল।”

পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করার কয়েক দিন পরেই তাজউদ্দীন আহমদ উল্লিখিত নয় দিনের ঘটনাক্রমের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সমসাময়িক প্রিন্ট মিডিয়াতে তার কিছু সমর্থন মেলে। ইন্ডিয়া টুডের ২১ আগস্ট ২০০১ সংখ্যায় প্রকাশিত হামিদুর রহমান তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বর্ণিত, “এ সময় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আলোচনা ব্যর্থ না হলেও ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং তিনি করাচি পৌঁছেই পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন।” প্রতিবেদনের এ অংশটুকুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের “কোনো পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি” এ অংশটুকুর মিল তাত্পর্যপূর্ণ। অর্থাত্ তাজউদ্দীন আহমদের ১৬ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়ের বর্ণনা নিঃসন্দেহে সত্য ও তথ্যপূর্ণ এবং পাকিস্তান সরকারের ৫ আগস্ট ’৭১-এ প্রকাশিত শ্বেতপত্র ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্যে কণ্টকিত।

ঘটনার প্রায় পাঁচ মাস পর পৃথিবীর জনমতকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যেই এ শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়। শ্বেতপত্র ছিল মিথ্যা তথ্যে ভরা তার প্রমাণ মেলে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড বইতেও। এ বইয়ের বঙ্গানুবাদ, বাংলাদেশের জন্ম-এর ৭৭ পৃষ্ঠায় আছে, “পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে সাফল্য অর্জনকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের মতামত প্রতিনিধিত্ব করার দাবি জানাচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার নামে খায়বার থেকে করাচি পর্যন্ত আন্দোলনের সম্ভাবনা নিয়ে ভুট্টো এমএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মোকাবিলায় নেমেছিলেন। তিনি যেহেতু একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন এবং তার চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব যেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল সিনিয়র অফিসারকে প্রভাবিত করেছিল, সে কারণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ভুট্টোর সম্মতি ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তথা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেননি।

“...যেহেতু পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত, তাই নিজের অবস্থান রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।” ৭৮ পৃষ্ঠায় ফরমান আলী লিখেছেন, “...পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ছিল না, এর কোনো পক্ষ নেওয়া উচিত হয়নি।... যারা ঢাকা যাবে তাদের পা কেটে ফেলা হবে-এই হুমকি প্রদান করা থেকে যদি ভুট্টোকে বিরত রাখা যেত, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া অন্য রকম হতো। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হতে দেওয়া উচিত ছিল।... তিনি পিপিপির দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ায় পূর্ব পাকিস্তানিদের সংশয় বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল। তারা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বের ওপর নয়, পাকিস্তানের নেতৃত্বের ওপরও আস্থা হারিয়েছিল।”

রাও ফরমান আলী ছিলেন গভর্নরের মিলিটারি সেক্রেটারি। যিনি গভর্নরকে বেসামরিক প্রশাসন সমের্ক উপদেশ প্রদান করতেন। পূর্ব পাকিস্তানে পরপর পাঁচজন গভর্নরের অধীনে তিনি চাকরি করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু তার গোচরেই সংঘটিত হয়েছিল। তাই তার এহেন মন্তব্য সমের্ক একমত না হয়ে উপায় নেই।

ইয়াহিয়া ভুট্টোর প্ররোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে সৈন্যদের লেলিয়ে দিলেন। ২৫ মার্চ রাতের ঘটনার বর্ণনাও তাজউদ্দীন তার ১৭ এপ্রিলের ভাষণে প্রদান করেছেন। তিনি বললেন :

“২৫ মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সমঙ্ন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে ‘পজিশন’ গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকার শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হলো গণহত্যার এক পূর্বনির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে কোনো চরমপত্র দেননি অথবা মেশিনগান আর্টিলারি সজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ মানুষের ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল ও ধ্বংসলীলা শুরু করেছিল, তার আগে জারি করা হয়নি কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জে. টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছে বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুণ্ডে।

“আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ইপিআর বীরের মতো লড়ে গেল। কিন্তু অসহায় নিরীহ মানুষ কোনো প্রতিরোধ করতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজার।”

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত