বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলাম। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করার সময় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম এবং কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। আমরা যখন অনুভব করি প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে গেছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার সকল পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কয়েকটি পরিবার কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। সংখ্যায় তাঁরা প্রায় ৫০ জন। তাঁর মধ্যে আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ে ছিল। তাঁদেরকে কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পরিবার, রেজিস্ট্রার ও আমি আরো দুই রাত ক্যাম্পাসে অবস্থান করি।

১ এপ্রিল আমি কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে আমার পরিবার ও অন্যদের সঙ্গে মিলিত হই। ২ এপ্রিল সেখান থেকে পরিবার নিয়ে হাটহাজারী থানার কাঠিরহাট গ্রামে আশ্রয় নেই। ১০ এপ্রিল সেখান থেকে রামগড়ে যাই। আমার বন্ধুর বড় ভাই রামগড় টি এস্টেটের ম্যানেজার আবদুল আউয়াল সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেই। আমি যখন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে যাই, তখন সেখানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় ও বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতনচন্দ্র সিংহ সপরিবারে বাস করছিলেন, তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্র, তাঁদের পরিবার সেখানে ছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে প্রায় ৫০ জন গিয়েছিল।

আমি ১০ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত রামগড়ে ছিলাম। সম্ভবত ২০-২২ এপ্রিলের দিকে প্রফুল্ল সিংহের সঙ্গে রামগড়ে সাক্ষাত্ হয়। তখন তিনি আমাকে বলেন যে তাঁর বাবা আর নেই। আমি ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে তাঁর বাবার সাথে কথাবার্তা বলে ফিরে যাবার সময় ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ইঙ্গিতে পাকিস্তানি সেনারা নূতনচন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করে। প্রায় তিন দিন তাঁর মৃতদেহ তাঁর বাড়ির সামনেই পড়ে থাকে। পরে স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্যে তাঁর সত্কার করা হয়।

আমি ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল আগরতলায় পৌঁছাই। সেখান থেকে ১৫ মে কলকাতায় চলে যাই। তখন বহু মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে আমার অনেক সহকর্মীর পরিবার ছিল। নূতনচন্দ্র সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র প্রফুল্লরঞ্জন সিংহের পরিবারও ছিলেন।

আমি কলকাতায় যাওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি’র সহযোগিতায় বাংলাদেশের সকল স্তরের শরণার্থী শিক্ষকদের নিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গড়ে তুলি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হই। শরণার্থী শিক্ষক ও অন্য শরণার্থীদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। পরে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা সেল গঠন করলে আমি তাঁর সদস্য নিযুক্ত হই। এই পরিকল্পনা সেল পরে পরিকল্পনা কমিশনে রূপান্তরিত হয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি আমি প্রথমে খুলনায় এবং ৮ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বপদে যোগদান করে বাংলা বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করি। তখন প্রফুল্ল সিংহ আমাকে বলেন, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোপাল দাস—পরে যিনি অধ্যক্ষ হয়েছিলেন—এবং আরও কেউ কেউ প্রফুল্লকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানি হানাদাররা একাত্তরের ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি একজন মেজর বলে পরিচিত ছিলেন। সৈন্যরা নূতনচন্দ্র সিংহকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন ফিরে যাওয়ার উপক্রম করছিল, তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী থাকায় তাঁরা আবার ফিরে এসে নূতনচন্দ্র সিংহকে টেনে বের করে এনে গুলি করে। তাঁর মুমূর্ষু অবস্থায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজের পিস্তল দিয়ে নূতনচন্দ্র সিংহকে গুলি করে। এসব কথা প্রফুল্লচন্দ্র সিংহ অন্যদের কাছ থেকে শুনেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে আমি আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালেহউদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে একাত্তরের কোনো এক সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীর গুডস হিলসের বাড়িতে আটকে রাখে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও অন্যরা তাঁর ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার করে। সালেহউদ্দিন পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় সিনেটের এক অধিবেশনে এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়। তখনো তাঁর শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন ছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারা দেশে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলো, যেমন জামায়াতে ইসলামী, কনভেনশন মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গড়ে তোলে এবং তারা নানা ধরনের অত্যাচার করে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিশেষ করে বহু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী এঁদের দ্বারা অপহূত ও নিহত হন। তাছাড়া শান্তি কমিটি গঠন করে এরা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানি সরকারের সমর্থনে ভূমিকা পালন করে। এদের মধ্যে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, ফজলুল কাদের চৌধুরী নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীরও একই ধরনের ভূমিকা ছিল। তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে চট্টগ্রামে।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত