বিজ্ঞাপন
default-image

বিজয়ী সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা শুক্রবার কলকাতায় বলেন, ঢাকায় কোনো যুদ্ধই হয়নি। গতকাল ঢাকায় যে যুদ্ধ আমি দেখে এসেছি তা হলো রমনা রেসকোর্সে নতিস্বীকারের শর্তাবলিসহ টাইপ করা একখানি কাগজের নিচে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির সইয়ের সময় স্বাধীন বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের উল্লাস। এই উল্লাস দেখলাম কলকাতাতেও। অরোরা যখন সাংবাদিক বৈঠক থেকে বের হন, জনতা চিৎকার দেয়, ‘অরোরা, জিন্দাবাদ।’

বেলা তখন ১১টা। ডালহৌসিতে পূর্বাঞ্চলের সামরিক বাহিনীর পিআরও অফিসের হলঘরটি দেশি-বিদেশি মিলিয়ে শ দুয়েক সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান ও টেলিভিশনের লোকজনে ঠাসা। জেনারেল অরোরা তাঁর ছোট্ট ছড়িখানা ঘোরাতে ঘোরাতে ঘরে ঢুকলেন। রিপোর্টার, ফটোগ্রাফাররা ঘন ঘন করতালি দিলেন। স্বাগত জানালেন বিজয়ী বীরকে। পাকিস্তানি বাহিনীর নতিস্বীকারের পর জেনারেল অরোরার এটাই ছিল প্রথম সাংবাদিক বৈঠক।

এদিন ঘরে ঢুকে দেখি, দুজন ক্যাপ্টেন দেয়ালের বড় মানচিত্রটির তিরচিহ্নগুলো তুলতে ব্যস্ত। একজন কর্নেল বললেন: আর ওগুলোর দরকার হবে না। গোটা বাংলাদেশ এখন হয়েছে মুক্ত।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন: জেনারেল, আপনি তো ঢাকা থেকে ঘুরে এলেন। ঢাকা পতনের কাহিনি কি সংক্ষেপে আমাদের কাছে বর্ণনা করবেন?

জেনারেল বললেন, যুদ্ধ না করেই ঢাকা আমাদের দখলে এসে গিয়েছে। আমরা পাকিস্তানি ফৌজকে পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিলাম। তাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। ঢাকা কীভাবে দখল করা হলো এবং সমগ্র পূর্বখণ্ডে কী রণকৌশল অনুসৃত হয়েছিল তিনি তা ব্যাখ্যা করছিলেন।

রিপোর্টাররা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন। জেনারেল খুব আস্তে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেন। একজন রিপোর্টার বলেন: জেনারেল আপনাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, ‘আই অ্যাম অলওয়েজ ইন এ রিল্যাক্সিং মুড।’

জেনারেল বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধবন্দীদের ভারতে নিয়ে আসা হবে। শুধু যুদ্ধবন্দী নয়, বাংলাদেশে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানি আছে তারা দেশে ফিরে যেতে চাইলে তাদেরও যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। রাস্তাঘাট ঠিক হলেই যুদ্ধবন্দীদের এখানে নিয়ে আসার কাজ শুরু হবে।

জেনারেল বলেন, তেজগাঁও বিমানঘাঁটি থেকে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে গাড়িতে করে যাওয়ার সময় লে. জে. নিয়াজি তাঁকে বলেছেন যে বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার লোক আছে। তিনি বলেন, এটা নিয়াজির দাবি। তবে আমার ধারণা, ওই সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি হবে না। তবে বর্তমানে ঠিক কত আছে, তা আমি বলতে পারব না।

তিনি বলেন, নিয়াজি ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নতিস্বীকারের ঠিক পরেই নিরস্ত্র করা হয়নি। তার কারণ নিরস্ত্র করা হলে সেখানকার উত্তেজিত জনতা এর বদলা নিত। জেনারেল বলেন, বাংলাদেশের উত্তেজিত জনতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জেনারেল নিয়াজিকে বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।

একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, নিয়াজি কি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক? জেনারেল হেসে বলেন, ও ইয়েস। আমার সঙ্গে নিয়াজির ঢাকায় যেটুকু সময় কথা হয়েছে, তার মধ্যে অন্ততপক্ষে চার-পাঁচবার নিয়াজি বলেছেন: আমি আমার লাহোরে ফিরে যেতে চাই। লাহোর খুবই ভালো শহর। আমার স্ত্রী আর এখানে থাকতে চাইছে না।

ঢাকায় কেন যুদ্ধ করতে হয়নি? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে জেনারেল বলেন: আমরা যখন তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছি, তখন নিয়াজি ঠিকই করে ফেলেছিলেন যে যুদ্ধ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়। তা ছাড়া পাকিস্তানি ফৌজের মনোবলও ভেঙে পড়েছিল।

প্রশ্ন: আত্মসমর্পণের ব্যাপারে নিয়াজি কি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পরামর্শ বা নির্দেশ চেয়েছিলেন।

জেনারেল: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কী পরামর্শ বা নির্দেশ দিয়েছিলেন জানি না। তবে নিয়াজির এ ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না।

জেনারেল বলেন: আমি আগেই আপনাদের কাছে বলেছিলাম যে বাংলাদেশের এই যুদ্ধ এক পক্ষকাল খুব বেশি হলে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু ১২ দিনের মধ্যেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল।

প্রশ্ন: পাকিস্তানি ফৌজের তো যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা লড়তে পারল না কেন?

জেনারেল: শুধু অস্ত্রশস্ত্র থাকলেই যুদ্ধ করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা পাকিস্তানি ফৌজের কোনো মনোবল ছিল না। বড় বড় শহরকে বাদ দিয়ে আমরা যে ওদের চারদিক থেকে এভাবে ঘেরাও করে ফেলব, এটা নিয়াজি কখনো ভাবতে পারেননি। তার কারণ, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ নাগরিক ও শহর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাতে কোনোরূপ ক্ষতি না হয়। এ জন্য আমরা কতকগুলো গ্রামের পথ কেটে ওদের আক্রমণ করি। পাকিস্তানি ফৌজকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আক্রমণ চালাই। আমরা জানি, পাকিস্তানি ফৌজ একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তারা আর কখনো আমাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে উঠবে না। এবং তখন আত্মসমর্পণই হবে তাদের একমাত্র বাঁচার পথ। আমাদের জয়ের মূলে হলো এই সুপার স্ট্র্যাটেজি। ওরা ভেবেছিল, ভারতীয় জওয়ানরা বাংলাদেশের একের পর এক বড় বড় শহর ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু তাদের সেই স্ট্র্যাটেজি সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং পাকিস্তানি ফৌজের পরাজয়ের মূলে হলো তাদের এই ভুল স্ট্র্যাটেজি। তা ছাড়া ওদের ‘ওভার অল প্ল্যানিংও’ ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

জেনারেল বলেন, ৮ ব্যাটালিয়ন মুক্তিবাহিনীও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে লড়াই করেছে। বিদেশের কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে ঢাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ ব্যাটালিয়ন ছত্রীসেনা নেমেছে। এটা ঠিক নয়। এ পর্যন্ত একটি ব্যাটালিয়ন থেকে ৬০০ থেকে ৭০০ ছত্রীবাহিনী ঢাকায় ও ঢাকার আশপাশে নামানো হয়েছে।

জেনারেল বলেন, পাকিস্তানি ফৌজ নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে পালিয়ে যাওয়ার সময় নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, স্ত্রীলোকের ওপর নিয়াজির বাহিনী অকথ্য অত্যাচার করেছে। জেনারেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, একাধিক বাংকারের মধ্যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। বীভৎস দৃশ্য। তিনি বলেন, সভ্যজগতে কোনো সেনাবাহিনী যে স্ত্রীলোকের ওপর এরূপ পাশবিক অত্যাচার করতে পারে, এটা আমি ভাবতেও পারি না।

জেনারেল বলেন, খুলনা, শ্রীহট্ট, চট্টগ্রাম এবং আরও কয়েকটি জায়গায় এখনো পাকিস্তানি ফৌজ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেনি। তার কারণ, তারা এখনো নিয়াজির বার্তা হয়তো পায়নি। তাঁর আশা, শনিবারের মধ্যেই বাংলাদেশে দখলদার ফৌজের আত্মসমর্পণ পর্বের সমাপ্তি ঘটবে।

প্রশ্ন: ভারত থেকে বাংলাদেশের শরণার্থীরা কবে নাগাদ আবার দেশে ফিরে যেতে পারবে?

জেনারেল বলেন, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তারা যেতে পারবে। এরই মধ্যে অনেকে যেতে শুরু করেছে।

একজন বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন: ভারতীয় সেনাবাহিনী কত দিন স্বাধীন বাংলায় থাকবে?

জেনারেল: আইনশৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ওখান থেকে চলে আসবে। তার আগে সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে রাস্তাঘাট ও অন্যান্য ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সেখানকার সরকার বদ্ধপরিকর। প্রশাসনিক কাঠামোকে জোরদার করে তোলার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং তাঁর সহকর্মীরাও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সাবেক গভর্নর ডা. মালিকের সঙ্গে আপনার ঢাকায় দেখা হয়েছিল?

জেনারেল: না, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে শুনেছি তিনি এখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন।

এই যুদ্ধে ভারতীয় নৌ এবং বিমানবাহিনী প্রশংসা করে জেনারেল বলেন যে, নৌ ও বিমানবাহিনীও আমাদের এই যুদ্ধে জয়ের বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। তিনি বলেন, বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করার দরুন আমাদের সেনাবাহিনীর সাফল্যের দ্বার খুব তাড়াতাড়ি খুলে গিয়েছে। চট্টগ্রাম, চালনা এবং আরও কয়েকটি বন্দরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সক্রিয় তৎপরতার দরুন পাকিস্তানি ফৌজ বিশেষ কিছু করতে পারেনি।

জেনারেল বলেন, প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এগুলোর বেশির ভাগই হলো আমেরিকা, চীন ও ইরানের। কিছু ইতালিরও আছে।

এক ঘণ্টার বেশি জেনারেল রিপোর্টারদের নানান প্রশ্নের জবাব দেন। একজন বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমেরিকার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেছে বলে তিনি সংবাদপত্রে দেখেছেন। এ সম্পর্কে তিনি আর কিছুই বলতে পারেন না।

জেনারেল বলেন: পরশু আমি আবার ঢাকায় যাচ্ছি। সবকিছু ভালোভাবে দেখতে। গতকাল জনসমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখা হয়নি। বৈঠক থেকে জেনারেল অরোরা যখন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে তাঁর গাড়িতে উঠতে যাবেন তখন দেখি হাজার হাজার লোক ‘জেনারেল অরোরা—জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিচ্ছেন। ভিড়ে ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ যখন ভিড় ঠেলছে, লাঠি দিয়ে, জেনারেল তখন বললেন, ‘ডোন্ট পুশ দেম।’

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১