বিজ্ঞাপন
default-image

আটক অবস্থায় যে শিশুরা জন্মেছিল, তাদের বাঁচানোই ছিল আমার প্রথম কাজ। পাশাপাশি যারা গর্ভস্থ শিশুদের রাখতে নারাজ, তাদের গর্ভপাতে রাজি করানোতেও আমি সচেষ্ট ছিলাম। যদিবা জন্মাত, মায়েদের অপুষ্টিসহ নানাবিধ কারণে সেসব শিশু হতো রুগ্ণ ও অপুষ্ট। এটা না করে উপায়ও ছিল না। তাই আমরা সফল হয়েছিলাম। বাংলাদেশে যা-ই হয়, ব্যাপক সংখ্যায় হয়। তার পরও আমরা পাল্লা দিতে পেরেছি। কিন্তু শিশুদের পারিবারিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠা করা ছিল সত্যিই কঠিন।

স্বেচ্ছায় কাজটি বেছে নেওয়ার পেছনে দায়িত্ববোধ তো ছিলই, তা ছাড়া আমি ৩০ সপ্তাহ বয়সী ভ্রূণের গর্ভপাতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এখানে এসে কাজ শুরু করি ধানমন্ডির একটি ক্লিনিকে। এ ছাড়া হাসপাতাল নেই এমন সব শহরেও কাজ করেছি। কিন্তু মেয়েদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে একা সব পারতাম না। তাই নতুন কর্মী তৈরির জন্য এক শহর থেকে আরেক শহরে প্রশিক্ষণ দিয়ে বেড়িয়েছি। এক জায়গায় কাজ শেষ হলে চলে যেতাম আরেক শহরে। ঢাকায় আমরা প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের গর্ভপাত করাতাম। ঢাকার বাইরের সংখ্যাটিও কাছাকাছিই ছিল। মেয়েদের একরকম অনুমতি নেওয়া হতো স্থানীয় পুনর্বাসন সংস্থার তরফে। যত দূর মনে পড়ে, একটি কাগজে তাদের সই নিয়ে রাখা হতো। এসবের পরোক্ষ সংগঠক ছিল সরকার।

যারা খানিকটা সামর্থ্যবান, তারা গোপনে কলকাতায় চলে যেত। আমাদের কাছে যারা আসত, তারা নিজেদের আগ্রহ থেকেই আসত। তাদের মধ্যে সব শ্রেণীর, সব ধর্মের নারীই ছিল। কাউকেই আমি কাঁদতে বা ভেঙে পড়তে দেখিনি। তারা খুবই শান্ত হয়ে থাকত। ফলে কাজটি আমাদের জন্য সহজ হতো।

যাদের বাচ্চা হয়ে গিয়েছিল, তারা নবজাতককে তুলে দিত পুনর্বাসন সংস্থার হাতে। তারা আবার তাদের তুলে দিত শিশু দত্তকসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিসসহ (আইএসএস) অন্যান্য সংস্থার হাতে। গর্ভপাতকারী নারী ও নবজাতক—উভয়ের সংখ্যাই ছিল বিপুল। তখন বাংলাদেশের সহায়-সম্পদ কিছুই ছিল না। সামান্য যা ছিল, তা বরাদ্দ ছিল যুদ্ধাহত পুরুষদের জন্য। ওষুধ, যন্ত্রপাতি—সব আমাকেই ইংল্যান্ড থেকে আনিয়ে নিতে হতো। ছয় মাস কাজের সময় আমার সম্বল ছিল মাত্র দুই সেট যন্ত্রপাতি।

আমি আসার আগেই ঢাকায় যুদ্ধনারীদের জন্য একটি পুনর্বাসন সংস্থা গঠন করা হয়েছিল। এর দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান। ফন শুক (Von Schuck) নামের এক ব্যক্তির ভূমিকাও খুব মুখ্য ছিল। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল মেরি (দুজনেরই পুরো নাম মনে নেই)। তাঁরা অর্থসাহায্য জুগিয়েছিলেন। আমরা কাজ করতাম মূলত হাসপাতাল বা পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলোতে...সঠিক মনে নেই, সেগুলোকে তখন কী বলা হতো। সংস্থাটির নাম সম্ভবত বাংলাদেশ জাতীয় নারী পুনর্বাসন সংস্থা বা এ রকম কিছু।...হাসপাতালের কর্মচারীরা প্রথমে রাজি হতো না; ভাবত এটা বেআইনি কাজ। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রসচিব রব চৌধুরী এ ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতার জন্য আদেশসংবলিত ক্ষমতায়নপত্র দিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়, যা কিছু আমি করছি, তা সম্পূর্ণ বৈধ এবং এ ব্যাপারে আমি যাতে সব রকম সহযোগিতা পাই। বাংলাদেশের ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ কাগজ আমার কাছে পড়ে আছে। সম্ভবত চিঠিটিও সেখানেই আছে। তখনই জানতাম, এ রকম অভিজ্ঞতা বাকি জীবনে আর হবে না। তাই আমি সেগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছি। সে সময় এ কাজ ছিল খুবই কঠিন ও মর্মপীড়াদায়ক। হায়, এসব ইতিহাস আজকাল তো কেউ শুনতে চায় না!

হ্যাঁ, কোনো কোনো মা সন্তানকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। আইএসএস যতজনকে সম্ভব দত্তক হিসেবে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে পাঠিয়ে দিয়েছে। যতজনকে পাওয়া যায়, ততজনকেই নিতে রাজি ছিল তারা। গর্ভপাত বা প্রসবের পর মায়েরা কিছুদিনের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থার হেফাজতে থাকত। যত দিন ইচ্ছা সেখানে থাকা যেত। তারপর অনেকেই ঢাকা, দিনাজপুর, রংপুর, নোয়াখালীর মতো জায়গায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিত।

শিশুদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। একটি কারণ এই যে পাকিস্তান ছিল কমনওয়েলথভুক্ত দেশ এবং তাদের বেশির ভাগ কর্মকর্তারই প্রশিক্ষণ হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ফলে বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের জন্যও বিব্রতকর ছিল। কুমিল্লা কারাগারে বন্দী এ রকম অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তার সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম আমি। তাঁরা বলছিলেন, ‘যুদ্ধে তো অনেক কিছুই হয়! আমরা কী এমন করেছি!’

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে তাঁরা নারী-ধর্ষণকে জায়েজ মনে করতেন! টিক্কা খানের (পূর্ব পাকিস্তানের সে সময়কার সামরিক আইন প্রশাসক) কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ পেয়েছিলেন, যেহেতু একজন ভালো মুসলিম তার বাবার বিরুদ্ধে লড়বে না, সেহেতু যত বেশি সম্ভব বাংলাদেশি নারীদের গর্ভবতী করো। এ থেকে একটা গোটা প্রজন্ম জন্মাবে, যাদের শরীরে বইবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্ত। এটাই তারা বলেছিল এবং ধর্ষণের পেছনে এটাই ছিল তাদের তত্ত্ব! ধর্ষিতাদের যে সংখ্যাটি বাংলাদেশে স্বীকৃত, তা মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়; বরং সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে।

পাকিস্তানিরা যেভাবে একেকটি শহর দখল করত, তা অদ্ভুত। গোলন্দাজ বাহিনীকে সামনে রাখা হতো। তারা স্কুল, হাসপাতাল লক্ষ্য করে বোমা মেরে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করত। এরপর পদাতিক বাহিনী এসে সব বাসিন্দাকে এক জায়গায় জড়ো করত। নিতান্তই যারা শিশু, তারা বাদে বাকি সব মেয়েকে আলাদা করে ফেলা হতো। পদাতিকদের আরেকটি অংশ আওয়ামী লীগ বা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে জড়িত সবাইকে গুলি করে মারার কাজ করত। তারপর মেয়েদের কোনো একটি স্থানে আটকে রেখে তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করত। পৃথিবীর আর কোথাও আমি এমনটি ঘটতে শুনিনি। কিন্তু বাংলাদেশে এটাই ঘটেছিল। নির্যাতনের অনেক গল্প শুনেছি আমি। সেগুলো ছিল অবিশ্বাস্য ও ভয়ঙ্কর। মানুষ এ রকম করতে পারে!

ধনী এবং সুশ্রীদের রাখা হতো কর্মকর্তাদের জন্য। বাকিদের তুলে দেওয়া হতো সেপাইদের হাতে। তারা ঠিকমতো খাবার পেত না, অসুস্থ হলে জুটত না চিকিত্সা। অজস্র নারী ক্যাম্পেই মরে যেত। কিন্তু যুদ্ধের পরও এসব বিষয় অবিশ্বাস করার ঝোঁকটাই ছিল জোরালো। এ প্রসঙ্গে কথা বলায় বাধা ছিল, ছিল নাকচ করার মানসিকতা। কিন্তু আমি জানি—কী ঘটেছে, কত ব্যাপক আকারে ঘটেছে।

এমন বিভীষিকার মধ্য দিয়ে মেয়েদের যেতে হয়েছিল যে অনেকে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। নিয়ত তারা দুঃস্বপ্ন ও বিকারের মধ্যে থাকত। আমরা বিদেশি বলে আমাদেরও তারা বিশ্বাস করত না।

যুদ্ধের পর রেপ ক্যাম্পগুলো তুলে দেওয়া হয়েছিল। মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো যার যার গ্রাম বা শহরে। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, হয়তো স্ত্রীকে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হলো এবং লোকটি তাকে মেরে ফেলল! কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা জানতেও চাইত না, কী ঘটেছে তাদের স্ত্রীদের জীবনে। যমুনা নদীতে তখন অনেক লাশ ভেসে যেতে দেখা যেত; অনেক লাশ পড়ে ছিল দেশের আনাচকানাচে।

কাউকে জিগ্যেস করলে বলত, মনে নেই। বাংলাদেশে মেয়েদের মর্যাদা এমনিতেই কম। পুরুষেরা তো একেবারেই মুখ খুলতে চাইত না। তাদের চোখে ওই সব নারী ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে, তাদের মরে যাওয়াই ভালো। এবং অনেককে হত্যাও করা হয়েছিল। আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। পশ্চিমা কোনো সমাজে বিষয়টি এতই অচেনা, এতই অজানা!

জিওফ্রে ডেভিসের সঙ্গে ড. বীণা ডি’কস্টার আলাপচারিতা দীর্ঘক্ষণ চলে। ড. ডেভিস আবার বাংলাদেশে আসার জন্য ভীষণ উদ্বেল, বলেছেন ড. বীণা। যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সম্ভাব্যতার ব্যাপারে তাঁরা কথা বলেন।

ড. বীণা লিখেছেন: ‘বিদায়ের আগে জিওফ বললেন, সুবিচার পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে তাঁর ক্ষমতার মধ্যে যা সম্ভব যথাসাধ্য করবেন। জিওফ আমার হাত আঁকড়ে ধরে নিজের বুকের ওপর রাখলেন। তাঁর চোখ দিয়ে তখন অঝোরে অশ্রু ঝরছিল।’

দৃষ্টিপাত ডট অর্গ থেকে নেওয়া

অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত