আপাতদৃষ্টে দুর্ভাগ্য মনে হলেও আদতে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারা যেকোনো জাতির জন্য এক পরম সৌভাগ্যের ঘটনা। জনযুদ্ধ সংঘটনের সময়ে আপামর জনগণকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে এবং অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। একাত্তরে যে জনযুদ্ধ বাঙালি জাতি করেছে, তা অপেক্ষাকৃত স্বল্পমেয়াদি হলেও এটাই ছিল প্রকৃত জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। আমাদের সর্বস্তরের মানুষ একই সমতটে এসে জড়ো হয়েছিল একই ঈপ্সিত লক্ষ্যে।
জনযুদ্ধের যোদ্ধাদের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়—নাগরিক যোদ্ধা, অনিয়মিত সৈনিক, গেরিলা যোদ্ধা। এরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আসা সাধারণ মানুষ, নিয়মিত বা প্রচলিত সৈনিক নয়। আমরা তাদেরকে বলি গণযোদ্ধা। এরা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, নৌকার মাঝি, গেরস্ত ঘরের কামলা, ট্রাক ড্রাইভার, মোটরসাইকেল মেকানিক, কদাচিত্ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের বেশির ভাগই জানত, দেশ স্বাধীন হলে এরা কেউ সেনাবাহিনীতে জেনারেল, সরকারের সচিব বা কোটিপতি ব্যবসায়ী হতে পারবে না। এদের তখন যেমন বছরের খোরাক জুটতো না দেশ স্বাধীন হলেও জুটবে না। এরা যুদ্ধে শহীদ হলেও এদের সন্তানদের গৃহস্থের দয়া আর দাক্ষিণেই থাকতে হবে। এই অতি সাধারণরাই অসাধারণ গুণাবলি প্রদর্শন করেছে। কলমের কাজ অস্ত্র দিয়ে হয় না, তেমনি তার উল্টোটাও সত্য।
সামগ্রিক অর্থে এই গণযোদ্ধারই আমাদের জনযুদ্ধের নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১, ২, ৩, ৪ এবং ৮ এই পাঁচটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন ছিল। ১০ অক্টোবর ১৯৭১ নাগাদ ৯, ১০, ১১ আরও তিনটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান গঠন করা হয় কিছু পুরনো সৈনিক এবং গণযোদ্ধাদের ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে। মোদ্দাকথা এই সৈনিকদের সংগঠন ছিল, প্রশিক্ষণ ছিল এবং অভিজ্ঞতা ছিল। সে অর্থে গণযোদ্ধাদের তেমন কিছুই ছিল না। প্রথাগত এ ব্যাটালিয়ানগুলোর আবাস ছিল ভারতীয় সীমান্তের ভিতর। কাজেই তাদের আবাস ছিল নিরাপদ। চিকিত্সা ও খাবার ছিল নিশ্চিত। গণযোদ্ধারা থাকতো দেশের ভিতর অরক্ষিত হাইডআইটে অর্থাত্ অন্যের বাড়িতে। তাদের খাবার বিশেষ করে চিকিত্সা ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ব্যাটালিয়ানগুলো যুদ্ধ করতে সীমান্ত এলাকায় (কামালপুর, নকশী, সলদানদী, বিলোনিয়া ইত্যাদি)।
২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘরে ক্যাপ্টেন হায়দার কথাচ্ছলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ফতেহ আলী চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসো কাকে?
—নিজকে।
—তাহলে মুক্তিযুদ্ধে এসেছ কেন?
—দেশের জন্য নিজের প্রাণটা দেওয়ার জন্য।
অপ্রচলিত যুদ্ধ (রেইড, অ্যাম্বুশ) হলেও গণযোদ্ধারা যুদ্ধ করতো বাংলাদেশের ভিতরে, সবসময় আতঙ্কে। তাদের প্রচলিত সৈনিকদের মতো বাড়তি সৈন্যের সাহায্যের (রিইনফোর্সমেন্ট), গুলি সরবরাহের ইত্যাদির সুযোগ ছিল না। তাদের না ছিল বেতার যোগাযোগ, না ছিল কোনো আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট। তাদের অস্ত্র ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের। এদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের আগে একনলা বন্দুকও দেখেনি। দেশপ্রেমের অপার প্রণোদনায় তারা কানাকড়ির দামে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে।
২.
মোশারফ হোসেন হারুন। তদানীন্তন ফেনী মহকুমার মুন্সিরহাট থানার ধলিয়া গ্রামে বাড়ি। বাবা এরশাদউল্লা কেরানি। একাত্তরে ফেনী কলেজে বিএ শেষ বর্ষের ছাত্র। মাঝারি উচ্চতার, কিঞ্চিত্ ভারী গড়নের এবং গায়ের রং গাঢ় শ্যামলা। গণযোদ্ধা হলেও সে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক। আরও অনেক গণযোদ্ধা আছে ব্যাটালিয়নের পাইওনিয়ার প্লাটুনে। মাইন লাগানো, মাইন অপসারণ করা, ব্রিজ ধ্বংস করা, প্রতিরক্ষা প্রতিবন্ধক স্থাপন করা পাইওনিয়ার প্লাটুনের কাজ। এ কাজের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। মাইন এবং বিস্ফোরক শত্রু-মিত্র চেনে না। এ বিপজ্জনক কাজটি গণযোদ্ধারা করে অতি আনন্দ আর উত্সাহের সঙ্গে। কিন্তু তাদের কোনো সামগ্রী নেই। নেই মাইন ডিটেক্টর, প্রডার কিছুই।
৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে ফেনীর মাঝামাঝি স্থানে উত্তরে চিতলিয়া ও দক্ষিণে চন্দনার ভেতর দিয়ে মেজর জাফর ইমাম দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তাঁর সৈনিকদের নিয়ে অনুপ্রবেশ করেন। শীতের সে রাতে গভীর বর্ষণ ও বজ্রপাত হচ্ছিল। তাঁরা চিতলিয়া, গুতুমা, সলিয়া, ধনিকুণ্ডা, চন্দনা এলাকায় একটি অভূতপূর্ব এবং বিস্ময়কর প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। একটি প্রতিরক্ষা উত্তর দিকে মুখ করে (যেদিকে পাকিস্তানি ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট), অপরটি দক্ষিণ দিকে অর্থাত্ ফেনীর দিকে মুখ করে (যেদিকে ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট)। পাকিস্তানিরা সকল অর্থেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরাজয় ছাড়া তাদের আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ১০ নভেম্বর ১৫ বালুচের একজন ক্যাপ্টেন ৭২ জন সৈন্যসহ আত্মসর্পণ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল তখন শিখরে। এখন দক্ষিণে ফুলগাজী, মুন্সিরহাট, বন্দুয়া হয়ে ফেনী দখল করা। আমাদের হারুন সব সময়, সবকিছুতেই সিরিয়াস। লেখাপড়ায়, নামাজে-কালামে তার বিশেষ মনোযোগ। কাজকর্মে তো বটেই, কথাবার্তায়ও সে সাবধানী। সবই করে সে ভেবেচিন্তে। মন্দ কিছুর জন্য তার জন্মই হয়নি। অযথা বেশি ঝুঁকি নিতে মানা করে বন্ধুদের। বলে, মরেই যদি যাস, তবে আরেকটা যুদ্ধ করবি কীভাবে?
ফেনীমুখী অগ্রাভিযানের আগে প্রথম কাজ পাকিস্তানিদের পুঁতে যাওয়া পথের মাইন অপসারণ করা। হারুন তার কমান্ডার গোলাম মুস্তাফাকে বলে, মুন্সিরহাট হয়ে যখন যাব, তখন একটা মিনিট আমাকে দিয়ো। একটু মাকে দেখে আসব। মুস্তাফা হাসিমুখে সায় দেয়। গ্রামের কাঁচি, খুন্তি দিয়ে মাইন তোলা। প্রায় সবই পি-ii নন-ডিটেক্টেবল অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন। সেদিনই (১০ নভেম্বর) চিতলিয়া রেলস্টেশনের লাইনের ওপর বিকট শব্দে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। রেললাইনের পাথরগুলো গুলির বেগে ছুটে গিয়ে আহত করে সহযোদ্ধা মুস্তাফা, শহীদসহ আরও অনেককে। তারা রক্তাক্ত হয়। গিয়ে দেখি হারুন ‘মা-রে, অ-মা’ চিত্কার দিয়ে চিতিয়ে পড়ে আছে। ডান পায়ের গোড়ালির ওপর থেকে উড়ে গেছে। পায়ের ওপরের অংশের মাংস চিরে ঝুলে আছে। সেদিনই তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ১২ নভেম্বর তাকে স্থানান্তরিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মিত হাসপাতাল বিশ্রামগঞ্জের বাংলাদেশ হাসপাতালে। হারুনের পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়।
হারুনের নিয়তিতে মায়ের শেষ দর্শন ছিল না। হারুন মারা যায় বহু কষ্টভোগের পর। কবে, আমরা জানি না।
৩.
আখাউড়া-কুমিল্লা রেলপথের প্রায় মাঝামাঝি মন্দবাগ রেলস্টেশন। রেললাইনের পূর্ব দিকে প্রায় সমান্তরাল ভরতীয় সীমান্ত। মন্দবাগ রেলস্টেশনটি রেললাইনের পশ্চিম পাশে। দক্ষিণ-পূর্বে সালদা নদীর পশ্চিম পারে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। রেলস্টেশনে শত্রুর দুর্বল উপস্থিতি মনে হলেও তারা এটিকে প্রায় দুর্গ বানিয়ে রেখেছে। শত্রুর এ অবস্থান আমরা দখল করব। আমাদের আক্রমণ হবে পূর্ব দিক থেকে সামনাসামনি। অক্টোবরের মাঝামাঝি কোনো এক দিন। ভোররাতের আক্রমণ। আক্রমণের একপর্যায়ে আড়াআড়িভাবে রেললাইন অতিক্রম করতে হবে আমাদের। আক্রমণ পরিকল্পনা করেছেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আবদুল গফফার হালদার। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈনিকও আছে আমাদের সঙ্গে। তবে বেশির ভাগই গণযোদ্ধা। আমরা অনেকেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিতও নই।
চলমান আক্রমণের একপর্যায়ে রেললাইনে উঠতেই কে যেন আমার কোমর ধরে পেছনে টেনে ধরল। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সামনে থেকে শত্রু বৃষ্টির মতো গুলি করছে। আমি বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে গেলাম। চেয়ে দেখি, ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে গেছে। দুই হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, স্যার, একজন ডাক্তার ডাকেন, আমি বাঁচব। আমি নিশ্চিত, বাঁচার মতো অবস্থায় নেই ছেলেটি। এ সময় এ স্থানে ডাক্তার পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সামনে থেকে গুলি আসছে অবিশ্রান্ত ধারায়। রেললাইনের ওপর আমার ক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকা মানে নির্ঘাত গুলিতে মৃত্যু। ছেলেটির হাত দুটি খুলে ফেলতে পারছিলাম না। ১৫-২০ সেকেন্ড এই ভাবাভাবির মধ্যে দেখলাম, ছেলেটির হাত দুটি নিথর হয়ে পড়ে গেল।
আক্রমণ সফল হলো আমাদের। মন্দবাগ রেলস্টেশনে শত্রুর অবস্থান দখল করলাম আমরা। আহত-নিহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে দেখলাম, ছেলেটি রাইফেল বুকের নিচে ফেলে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে মুখটা ডান দিকে রেখে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। চোখ দুটি বন্ধ। চেহারায় কয়েক মিনিট আগের যন্ত্রণা, কাতরতা নেই। আমি তার গ্রাম্য কচি মুখটার সামনে বসে পড়লাম। অভিমানী মুখটি ভুলতে পারি না আজও। যেন বলছে, আপনি ডাক্তার ডাকলেন না। ডাক্তার এলেই কিন্তু আমি বাঁচতাম।
৪.
৩ ডিসেম্বর। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মৌলভীবাজার মহকুমার ভানুগাছ রেলস্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ করেছে। গোটা বাংলাদেশেই তখন পাকিস্তানিদের অবস্থান নড়বড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নগুলোর চারটি কোম্পানির সঙ্গে গণযোদ্ধাদের সমন্বয়ে আরেকটি কোম্পানি গঠন করা হয়। এ, বি, সি ও ডি কোম্পানির পর এটির নাম দেওয়া হয় ‘ই’ কোম্পানি। পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে বিশৃঙ্খলভাবে পালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করছে। এমন সময় ই বা ইকো কোম্পানির এক কিশোর যোদ্ধা লক্ষ করল, ভানুগাছ থানায় তখনো পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। কোথা থেকে সে একটি বাংলাদেশের পতাকা জোগাড় করল কে জানে। কাউকে কিছু না বলে সে লোহার পোল বেয়ে ওপরে উঠল। পাকিস্তানি পতাকাটি নামিয়ে সে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশের পতাকা। ঠিক তখনই পলায়নপর শত্রুর নিরাপত্তায় নিয়োজিত কভারিং ফায়ারের একঝাঁক গুলি এসে লাগল ছেলেটির ওপর। ধপ করে ওপর থেকে পড়ল ছেলেটি। পোল বেয়ে রক্ত পড়ছে, রক্তে মাটি লাল হয়ে যাচ্ছে। সহযোদ্ধারা কয়েক মিনিট যুদ্ধ বন্ধ রেখে ছেলেটিকে চোখের পানিতে অভিবাদন জানাল।
এভাবে কত শিশু, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, নারী রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। উড্ডীন লাল-সবুজের পতাকার দিকে তাকিয়ে কত শোক ভুলেছে। পাকিস্তানি ক্রিকেট দল ঢাকা এসেছিল যখন, তখন আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেকের গালে পাকিস্তানি পতাকা অঙ্কিত দেখেছি। বুকটা ব্যথা করছিল। সত্যি বুকটা ব্যথা করছিল। আমাদের কষ্ট আমাদের সন্তানেরা বোঝে না কেন?
৫.
একাত্তরের মুন্সিগঞ্জ মহকুমার গজারিয়া থানা এলাকার ওপর দিয়ে ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ বিভিন্ন স্থানে ব্রিজ উড়িয়ে, মাইন পুঁতে, রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং উপর্যুপরি অ্যাম্বুশ করার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর করে দেয়। ঢাকায় পিআইএ-র (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস) ছোট্ট বিমানবহরের পক্ষে সৈন্য, রসদ ও মালামাল পরিবহন করা অসম্ভব ছিল। কাজেই ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়কই ছিল পাকিস্তানিদের চলাচলের একমাত্র পথ। সামরিক ভাষায় যাকে বলে মেইন সাপ্লাই রুট বা প্রধান সরবরাহ সড়ক। কাজেই এ সড়ক নিরাপদ রাখা ছাড়া পাকিস্তানিদের গত্যন্তর ছিল না। কয়েক মাইল দূরে দূরেই ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প—বাউসিয়া মেঘনা-গোমতীর পাড়ে, বাউসিয়া ব্রিজে, মেঘনা ফেরিঘাটে, ভবেরচরে এবং ভাটেরচরে। ঢাকার দিকে কাঁচপুর এবং কুমিল্লার দিকে দাউদকান্দিতে ছিল শত্রুর শক্ত উপস্থিতি। তারা গাড়িতে এবং পায়ে হেঁটে গোটা রাস্তায় সার্বক্ষণিক টহল দিত। মেঘনা নদীর পাশের এক গ্রাম ঘেঁষে গেছে জোয়ার-ভাটার খাল। এই গ্রামের তিন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু নিজ গ্রাম থেকে ক্যাম্পে অবস্থানরত সহযোদ্ধাদের জন্য চাল সংগ্রহ করতে এসেছে। হঠাত্ দুপুরের পর গ্রামে হইচই পড়ে গেল। মানুষজন দৌড়ে পালাচ্ছে। গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে। তিন যোদ্ধার তিন রাইফেল থ্রিনট থ্রি। দেখা গেল, বড় একটি ছই ছাড়া নৌকায় পাঁচজন পাকিস্তানি সৈন্য, চারজন রাজাকার এসে নেমেছে। যুদ্ধংদেহি ভাব নেই তাদের মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চোখে চোখে রাখল। তারা অস্ত্রে কম, লোকসংখ্যায়ও কম। তার পরও এক হাত দেখে নেবে তারা। তা ছাড়া আত্মসম্মানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি দেখে মুক্তিযোদ্ধারা পালালে গ্রামের লোক ঝাঁটা দিয়ে পেটাবে। ছেলেরা গুলি করতে পারছে না, কারণ তারা হাঁটছে এবং গুলি করলে গ্রামের মানুষও মারা যাবে। তবে তারা প্রস্তুত রইল। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিরা দুটি মেয়ে, একটা খাসি, কিছু মুরগি নিয়ে নৌকায় ওঠে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মাথার ওপর দিয়ে গুলি করল। তারা জানে, সে ক্ষেত্রে দুই মেয়ে এবং রাজকাররা পানিতে ঝাঁপ দেবে। কেননা, তারা নদীতীরের মানুষ, ভালো সাঁতার জানে। নৌকায় থেকে যাবে পাঁচ পাকিস্তানি সৈন্য। এরা গুলি করতে পারবে না, কেননা তখন ওরা প্রাণে বাঁচায় ব্যস্ত থাকবে এবং নৌকা তখন দুলতে থাকবে। হলোও ঠিক তাই। গুলিতে সব পাকিস্তানি মারা গেল কি না, বোঝা গেল না। কেননা নৌকা ভেঙে ডুবে গেল। ডুবে গেল পাকিস্তানিরা। মেয়ে দুজন সাঁতরিয়ে উঠে এল। রাজাকারদের চারজনকে ধরল গ্রামবাসী।
সেই তিনবন্ধু হাসেম, মুক্তা এবং হোসেন এমন নিচু স্বরে আমাকে এ কাহিনি বলছিল, যেন তাদের লজ্জায় না পড়তে হয়। আমি তো যুদ্ধ সংগ্রহ করি। তাদের এটা তো কোনো যুদ্ধ নয়।
যুদ্ধেরও ব্যাকরণ থাকে। একাত্তরে গণযোদ্ধারা প্রমাণ করেছে, সেই ব্যাকরণেরও ব্যত্যয় আছে।
৬.
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার হাইস্কুলে জড়ো হয়েছে পাকিস্তানিরা। বৃহত্তর বরিশাল এলাকা থেকে পাকিস্তানিরা পালিয়ে জড়ো হচ্ছে বরিশাল শহরে। পালাতে পারেনি এরা। এখন ওদের আনুষ্ঠানিক পরাজয় কেবল সময়ের ব্যাপার। স্কুলের ভেতর সুরক্ষিত অবস্থান নিলেও সহায়হীন ও সমর্থনহীন এরা। মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকাবাসী কঠিন অবরোধ তৈরি করে রেখেছে। আহার বা রসদের ব্যবস্থা নেই ওদের। পাশবিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে থেকে থেকে জানালা দিয়ে গুলি করছে। লোহার খাড়া শিকের জানালা। এতে মুক্তিযোদ্ধারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু দূর থেকে তারা জানালার ভেতরে শত্রুর ওপর কার্যকরী গুলি করতে পারছে না। এমন সময় এক কিশোর প্রস্তাব করল যে সে ক্রলিং করে নিচ দিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে দুটি গ্রেনেড পর পর ফেলে আসবে সেই ঘরটিতে, হতাহত করবে শত্রুদের। ছেলেটির ক্রলিং করে এগিয়ে যাওয়া যেন শত্রু দেখতে না পায়, সে জন্য অনবরত মুক্তিযোদ্ধারা জানালার দৃষ্টিতে গুলি করতে থাকবে। ছেলেটি দুটি গ্রেনেড ছুড়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত এই গুলিবর্ষণ অব্যাহত থাকবে।
মৃত্যুর এতটুকু তোয়াক্কা না করে ছেলেটি পরিকল্পনামতো এগিয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা সবই দেখতে পাচ্ছে। পাকিস্তানিরা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, কিছু অনুমানও করতে পারছে না। প্রথম গ্রেনেডটি নিক্ষেপিত হলো। বিকট শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত করে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হলো। হতাহত যা-ই হলো, বাইরে থেকে কিছুই দেখা গেল না। তবে শত্রু যে হতভম্ব হয়ে গেছে, বেশ বোঝা গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ওদের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেল। এবার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ছোড়া হলো। নিষ্ঠুর নিয়তি এবার বাদ সাধল। গ্রেনেডটি জানালার শিকে লেগে সবার চোখের সামনে ছেলেটির পিঠের ওপর এসে পড়ল। মুহূর্তেই বিকট শব্দে কচি কিশোরটির দেহ ছিন্নভিন্ন করে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হলো।
এভাবে কি ক্ষণজন্মা হতে হয় বীরদের?
৭.
আমাদের সন্তানদের বলি।
কলঙ্কের সঙ্গে কেউ থাকতে চায় না, মানুষ থাকতে চায় গর্বের সঙ্গে। তোমরা স্ফীতবক্ষে গর্বের সঙ্গে বলো, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তোমরা কি দেখেছ কেউ গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কখনো বলেছে, আমার বাবা জেলা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন বা রাজাকার কমান্ডার?
গর্ব করার অন্তত উপকরণ এ জাতি তোমাদের দিয়েছে। বুকভরা অহংকারের সঙ্গে মাথা উঁচু করে তোমরা বলবে—মাতৃভাষার সম্মান এবং মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার জন্য যুগপত্ রক্ত দিয়েছি গোটা পৃথিবীতে শুধু আমরাই। স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তোমরা নিশ্চিত করবে।
সূর্য হেলে পড়েছে। অদূরে ঘণ্টাধ্বনিও শুনতে পাচ্ছি। একাত্তরের ঘন কালো রক্ত এ দেশের অবারিত শস্যখেতে আর ধূসর ধুলায় হারিয়ে গেছে। আজকের এই বাংলাদেশ অনেক কষ্টের আর অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া। এ পবিত্র আমানত তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। জীবদ্দশায় স্বাধীন দেশে অনেক কষ্ট পেয়েছি, মরণের পর তোমরা আর কষ্ট দিয়ো না।
চোখ বোজার সময় হয়ে এল। তোমরা দেখ, চোখে পানি নিয়ে যেন আমাদের চোখ বুজতে না হয়।
মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.): মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক। চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ।