বিজ্ঞাপন
default-image

যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা ও মুক্তিসংগ্রামে আরও সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আঁচ করতে পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকেও অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুরোধে সাড়া দেয়। মধ্য অক্টোবরের মধ্যে ভারতে সোভিয়েত সামরিক সহায়তা আসতে শুরু করে। বয়রার যুদ্ধের পরই ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আইনি ও প্রক্রিয়াগত সহায়তার সব বন্দোবস্ত করে ফেলে (বয়রা যশোর সীমান্তবর্তী শহর, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ হয়)। দিল্লি থেকে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের একটি অগ্রগামী দল কলকাতায় যায়। আমার যত দূর মনে পড়ে, সময়টা ছিল নভেম্বরের ২৮ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে। যৌথ কমান্ড গঠনের লক্ষ্যে ভারত ও মুজিবনগর সরকারের মধ্যে একটি খসড়া মতৈক্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা সেখানে যায়। এ সিদ্ধান্তও হয় যে কমান্ড গঠনের পর অভিযান শুরু হলে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন। ডিসেম্বরের ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত মিসেস গান্ধী কংগ্রেসদলীয় কিছু সংযোগ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় অবস্থান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা বিষয়ে মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা করার কথা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়া এবং পরে তাতে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মতৈক্য থাকলেও নভেম্বরের শেষের দিকে যৌথ কমান্ড গঠনের ব্যাপারটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় সেনা কমান্ড এ ব্যাপারে তাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। ভারতীয় বাহিনী একটি প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযানে অংশ নেবে বলে সেনা কমান্ড একটি সমন্বিত কেন্দ্রীভূত চেইন অব কমান্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। জেনারেল (এ অ্যাসাইনমেন্টের জন্যই তাঁকে এই পদ দেওয়া হয়) ওসমানীকে যৌথ কমান্ডের যুগ্ম সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করায় আমাদের সেনাবাহিনীর উচ্চ কমান্ড খুব একটা খুশি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন মনে করেন, তাঁর সরকারের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা এবং মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের শৃঙ্খলা ও আনুগত্য বজায় রাখতে হলে কর্নেল (অব.) ওসমানীসহ মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের যৌথ কমান্ডের উচ্চপদে রাখতে হবে। শেষমেশ ইন্দিরা গান্ধীর পীড়াপীড়িতে ডি পি ধর ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চ কমান্ডকে এ প্রস্তাবে রাজি করান যে ওসমানী ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডিং ইন চিফ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সমান্তরালে থেকে কাজ করবেন।

default-image

১৯৭১ সালের ১ থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথ কমান্ড গঠনের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সিদ্ধান্ত যুদ্ধে সরাসরি কার্যকর হওয়ার কথা ডিসেম্বরের শেষের দিকে। ভারত জানত, তারা একবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে মূল কাজটি তাদেরই করতে হবে। মুক্তিবাহিনী হয়তো দেশের ভেতরে প্রশাসন ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অংশের সমন্বয় ভেঙে দিতে পারবে। তবে এটাও পরিষ্কার ছিল যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এর নেতৃত্ব দিল্লি ও কলকাতায় সামরিক সদর দপ্তরের হাতেই থাকবে। যৌথ কমান্ড আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও সংবেদনশীলতার প্রতি সম্মান রেখেই গঠন করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে সেই অক্টোবরেই। সে সময়ই ভারতীয় কমান্ডো ও মেরিন সেনারা নানা দলে ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকা শুরু করে। তারা আসলে বিশেষায়িত দক্ষতা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অভিযানে পেছন থেকে সমর্থন জুগিয়েছে।

প্রশিক্ষিত ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতিতে গেরিলাযুদ্ধের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। ভারতের সামরিক সমন্বয় কর্মকর্তা বিচ্ছিন্ন যোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি ও তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিরসনেও ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেক গ্রুপই স্বতন্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। টাইগার কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এ রকম একটি দল ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে ছিল আরেকটি দল। এর সঙ্গে সাবেক সামরিক, আধা সামরিক, পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যই জেনারেল ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) নেতৃত্বে যুদ্ধ করছিলেন।

৩ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যেই মিসেস গান্ধী কলকাতায় তাঁর কাজ সারেন। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে তিনি দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা ছাড়েন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বা সাতটায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডি পি ধর, পশ্চিমবঙ্গের দু-একজন রাজনীতিক এবং আমার ও পিটার সিনাইয়ের মতো মধ্য পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা, যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেন।

বিমানটি লক্ষ্ণৌয়ের কিছুটা পূর্বাকাশে পৌঁছালে পাইলট ডি পি ধরের কাছে এসে বলেন, তাঁকে একবার ককপিটে যেতে হবে। কারণ, দিল্লি থেকে একটি জরুরি বার্তা এসেছে, ধর সাহেবকে একটু কথা বলতে হবে। তিনি তিন থেকে চার মিনিট ককপিটে অবস্থান করে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নিজের আসনে ফিরে এলেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘যা ধারণা করা হয়েছিল, বোকাটা ঠিক তা-ই করেছে।’ তিনি বললেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জম্মু, পাঞ্জাব ও রাজস্থানের বিমান ঘাঁটিতে যুদ্ধপূর্ব অতর্কিত বিমান হামলা চালিয়েছে। তিনি আরও বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের ভূখণ্ডেও হামলা চালিয়েছে। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ইতিমধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছেন। পাকিস্তানের বিমান হামলার আশঙ্কায় ভারতের উত্তর ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায়ই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

দিল্লিতে অবতরণের বদলে মিসেস গান্ধীর বিমান লক্ষ্ণৌয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করার পর রাত ১০টার দিকে আমাদের বিমান লক্ষ্ণৌ ছেড়ে যায়। আমরা ১০টা ৪৫ মিনিটে পালামে অবতরণ করি। বিমানবন্দরে মিসেস গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম অপেক্ষা করছিলেন। আমরা সবাই সেখান থেকে সরাসরি দক্ষিণ ব্লকে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে চলে যাই। মিসেস গান্ধী, জগজীবন রাম, সরন সিং ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি অপারেশন রুমে প্রবেশ করেন। জেনারেল মানেকশ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে পাল্টা আক্রমণ হিসেবে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা মিসেস গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রীদের অবহিত করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ শুরু করার জন্য মিসেস গান্ধীর অনুমতি চান, প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দেন। এরপর মিসেস গান্ধী দক্ষিণ ব্লকের পশ্চিম শাখার মন্ত্রিপরিষদকক্ষে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য যান। বৈঠকটি তিনি বিমানে থাকাকালে আহ্বান করেছিলেন। মন্ত্রিসভায় অবিলম্বে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া ও নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন চালু করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

৪ ডিসেম্বরের সকালে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করে। ভারতীয় নৌ ও বিমান বাহিনীকে অবিলম্বে আক্রমণ শুরু এবং পাকিস্তানের জাহাজ ও বিমান চলাচল বাধাগ্রস্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৫ ডিসেম্বর মিসেস গান্ধী ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। সংসদ সর্বস্মতিক্রমে তা অনুমোদন করে এবং সামরিক অভিযানের প্রতিও অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। পূর্ব পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত বাংলাদেশের সর্বজ্যেষ্ঠ কূটনীতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে ভারতে বাংলাদেশের প্রথম চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর মর্যাদা স্বীকৃত হয় এবং সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার মতো বিরল সম্মানও লাভ করেন তিনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অংশগ্রহণের সমর্থন আদায়ে ভারত কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু করে। ভারত কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরন সিংয়ের তরফ থেকে সংকটের পূর্বাপর ব্যাখ্যাসহ সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে বার্তা পাঠানো হয়।

ক্রমবর্ধমান এই সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি অধিবেশন ডাকা হয় ৪ ডিসেম্বর। জাতিসংঘে পাকিস্তানের দূত আগা শাহী যুক্তরাষ্ট্রের দূত জর্জ বুশ ও চীনা দূত হুয়াং হুয়ার সমর্থনে দাবি করেন, নিরাপত্তা পরিষদ যেন ভারতের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়। সোভিয়েত দূত জ্যাকব মালিক ভারতকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। তিনি ভারতের পদক্ষেপের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। নিরাপত্তা পরিষদ ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় যুদ্ধের বিষয়ে তার গভীর চিন্তার কথা জানালে ভারতীয় দূত সমর সেন ৪ ডিসেম্বর পরিস্থিতির সারসংক্ষেপের সঙ্গে ভারতের প্রত্যয়ের কথা জানান, ‘কেউ প্রস্তাব পেশ করে বা অনুরোধ করে আমাদের পথ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। যে যুদ্ধবিরতির কথা আমি ইতিমধ্যে বলেছি, তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়। সেটা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে। ফলে এ ব্যাপারে বেশি অগ্রসর হওয়ার আগে আমাদের তাদের কথা শুনতে হবে।’

জে এন দীক্ষিতের িবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড: ইন্ডো-বাংলাদেশ রিলেশন্স বই থেকে প্রতীক বর্ধনের অনুবাদ

জে এন দীক্ষিত: তৎকালীন ভারতীয় উপ সচিব; পরে পররাষ্ট্র সচিব

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত