বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনা যদি বলতে হয়, তাহলে আমাকে পারিবারিক পরিস্থিতির কথা একটু উল্লেখ করতে হবে। আমার মা সুফিয়া কামালকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এবং আমরা দুই বোন সক্রিয়ভাবে ওই কাজে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন আমরা নানাভাবে তথ্য আদান-প্রদান, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা—এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চলছিলই। হঠাত্ করে এপ্রিল মাস থেকে আমরা জানতে পারলাম, তখনকার কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। তখনকার পত্রপত্রিকায় সেই খবরগুলো অত্যন্ত ফলাও করে ছাপা হচ্ছিল। কাজেই, সেই ঘটনাগুলোর সঙ্গে কারা কারা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নামও আমরা জানতে পারি। ঘুরেফিরেই জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, মুসলিম লীগ—এই দলগুলোর নাম উঠে আসতে থাকে। তখন একটি নাম খুব বেশি করেই আমাদের চোখে পড়ত, সেই নামটি হলো গোলাম আযম, যিনি টিক্কা খান এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য নেতাদের সঙ্গে প্রায়ই মিলিত হতেন এবং কীভাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতেন এবং বক্তৃতা ও বিবৃতি দিতেন।

এরপর আমরা দেখতে পাই, তারা মে মাসে রাজাকার বাহিনী নামে একটি বাহিনী তৈরি করে। যত দূর মনে পড়ে, রাজাকার বাহিনীর প্রথম সূচনা হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে, খুলনায়। আমরা এও জানতে পারি, তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। আলবদর, আলশামস নামে দুটি বাহিনী ওই উদ্দেশ্যে গঠন করেছে। তারা খুব গোপনে এ কাজগুলো করবে মর্মে জেনেছিলাম। আমরা তখন জানতে পাই, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র ও তরুণ কর্মীদের নিয়ে এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। সর্বক্ষেত্রেই এসব কর্মকাণ্ডের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নামই বারবার উল্লিখিত হয়েছে। প্রায়ই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে টিক্কা খানসহ অনেকে গোলাম আযমের নাম ধরেই প্রশংসা করেছেন যে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্যই তিনি এত কাজ করছেন। সেই সময় গোলাম আযম পাকিস্তান পর্যন্ত সফর করেন। সেখানে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন এবং বারবার এ কথা বলেন যে, তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত।

১৯৭১ সালের জুন মাসে আমার ছোট বোন সাইদা কামাল, যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৫ এবং আমি (মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৮) সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলায় যেতে বাধ্য হই। আমরা ১৬ জুন ঢাকা থেকে স্থলপথে রওনা হয়ে নদী পার হয়ে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে রিকশায় করে আগরতলার সোনামুড়ায় পৌঁছাই। আমাদের পূর্বপরিচিত একজন ডাক্তার ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদ, যিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তিনি তখন সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলোতে একটি ছোট চিকিত্সাকেন্দ্র খুলেছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সা করার জন্য। তিনি ও তাঁর স্ত্রী খুকু আহমেদ সেখানে ছিলেন এবং তাঁরা দুজনই আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করি এবং আমরা দুই বোন তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে যোগ দিই। সেই চিকিত্সাকেন্দ্রটি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তত্কালীন মেজর খালেদ মোশাররফ। তাঁর সঙ্গে আমরা দেখা করলাম।

তিনি আমাদের অনুমতি দিলেন সেখানে কাজ করার এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিবন্ধিত হলাম। সেখানে থাকতে থাকতে একটি বড় হাসপাতালের পরিকল্পনা নেওয়া হলো, যেটি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে পরিচিত হয়েছিল। আগরতলা থেকে ৬০ মাইল ভেতরে বিশ্রামগঞ্জ নামক স্থানে আমরা হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করি। আমরা সেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে, যাঁরা বাংলাদেশে ভেতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করছিলেন এবং যোগাযোগ রাখছিলেন, তাঁরাও সেখানে এসে হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। যাঁদের মধ্যে অধ্যাপক জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নীলিমা, ডা. ডালিয়া, ডা. শামছুদ্দিন উল্লেখযোগ্য। আমরা সবাই একত্রে সেই হাসপাতালে কাজ করেছি।

২ নম্বর সেক্টরের যেসব মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করতেন, তাঁদের মাধ্যমে আমরা সেসব অপারেশনের খবর পেতাম এবং যারা দেশের অভ্যন্তরে এই স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করত অর্থাত্ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস—তাদের কার্যাবলির খবরাখবরও আমরা পেতাম। শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমী, বদি, আলম, বাদল, চুল্লু, সামাদ, আলভী গংদের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের ঘটনা—সবকিছুই আমরা নিয়মিত ওই হাসপাতালে বসে পেতাম। আমরা খবর পেতাম রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির লোকজন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরের সব খবরাখবর প্রদান করত। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পরিবারবর্গের সব খবরাখবর, তাদের বাসস্থান, তাদের কার্যাবলি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে প্রদান করত। আমরা আরও খবর পাই, তারা বিভিন্ন বয়সের নারীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে এবং বাংকারে প্রদান করত। যার ফলে ক্রমাগত যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে তাদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এবং অনেকেই নির্যাতনের কারণে সেই ক্যাম্প কিংবা বাংকারে মারা যায়। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নেতা হিসেবে অনেকের নামের সঙ্গে অধিকাংশ সময়েই আমরা গোলাম আযমের নাম শুনতাম। তাঁর সঙ্গে আমরা আরও অনেক নাম শুনেছি।

যেমন, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আব্বাস আলী খান। তবে তাঁদের মধ্যে সর্বদাই জামায়াতের নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নাম উচ্চারিত হতো। আলবদর, আলশামস, রাজাকার—এই বাহিনীগুলোর নেতা হিসেবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তেমনি এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। সেই সময় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—এদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে, প্রাণ রক্ষার্থে তাদের দেশের ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালাতে হচ্ছে, ভারতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে এবং তাদের শুধু ধর্মের কারণে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। আমরা আরও অনেক ঘটনা শুনেছি, তাদের সব সম্পত্তি ফেলে শুধু নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। চার্চের মধ্যে ঢুকেও তাদের হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু ধর্মীয় কারণে তাদের এভাবে অত্যাচারিত ও ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে। শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদেরই একই উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তা নয়, জাতিধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের ওপর হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে।

আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বেতারের মাধ্যমে, যা সেই সময়কার তথ্য সরবরাহের মূল মাধ্যম ছিল, জানতে পারি এই সমর্থনের এবং সহযোগিতার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এবং শান্তি কমিটিরও অন্যতম শীর্ষ নেতা গোলাম আযম। আমরা এও জেনেছি যে ১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট এবং ৩১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর ও হায়দরাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছেন, মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষ করা যেতে পারে, সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, সেখানে জামায়াতে ইসলামীর দুজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের সংবর্ধনা দিতে গিয়ে গোলাম আযম বলেন, ঠিক যে লক্ষ্যে শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে, একই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এখানে একটি প্রশ্ন পরিষ্কার করা প্রয়োজন, শান্তি কমিটি কখনো সশস্ত্র কোনো অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে কি না। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তারা কখনো কখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল, সেটা সবারই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ করি, ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর যখন মুক্তিযোদ্ধারা জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখনো গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন যে, মুক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি দম্ভভরে এ কথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট। লক্ষণীয় যে, একজন ব্যক্তি একটি গণহত্যা পরিচালনাকারী সরকারের কতখানি কাছের লোক এবং আস্থাভাজন হলে ওই সময়ে তাদের নেতার সাক্ষাত্ পান এবং তাদের পক্ষে কথা বলেন। আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর মরিয়া ও নৃশংস আচরণ প্রত্যক্ষ করি ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়, নািস আমলেও অনেক হত্যাকাণ্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি, রাজাকার, শান্তি কমিটি এবং আলবদর ও আলশামস—এসব বাহিনীর দার্শনিক ও কৌশলগত পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আযম।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে এই প্রত্যাশা রাখি যে, পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার সঙ্গে যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল, যারা নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়ে ও সহযোগিতা দিয়ে এই গণহত্যাকে সমর্থন জুগিয়েছে এবং মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি লোককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে, দেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল, তাদের অনবরত ভীতিকর অবস্থায় নিজের বাড়িঘর, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জন্য ছুটতে বাধ্য করেছে, দুই লাখ নারীকে ধর্ষণের শিকার এবং আরও লাখ লাখ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছে, কোটি কোটি পরিবারকে বিপর্যস্ত করেছে, বিচারের মাধ্যমে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবে। আমি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি প্রদান করেছি। অধ্যাপক গোলাম আযম আজ ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত