বিজ্ঞাপন
default-image

আমার জন্ম ১৯৭০ সালে। বেড়ে ওঠা ক্ষত-বিক্ষত ইতিহাসকে ধারণ করা সমাজের কালবেলায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’-এর পরস্পরবিরোধী কথা শুনতে শুনতে বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। ১৯৭১ নিয়ে লেখা কোন বইটি সত্যি কথা বলছে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটেনি এখনো। মায়ের কাছে শোনা মুক্তিযুদ্ধের গল্প সবচেয়ে অথেন্টিক ইতিহাস আমার কাছে। মা যুদ্ধে যাননি। বাংলাদেশের আরও অনেক মানুষের মতো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মা কেমন করে বেঁচেছিলেন, আমাদের বাঁচিয়েছেন, কী তিনি দেখেছিলেন সেই কথা ছোটবেলা থেকে বহুবার শুনিয়েছেন আমাদের। আমার বড় খালু তখন থেকে নিখোঁজ। যুদ্ধ করতে যাননি। কিন্তু একাত্তর বড় খালার জীবন থেকে তাঁর স্বামী, আট সন্তানের বাবাকে কেড়ে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে তো জানি, এই সামান্য কিছু।

কান্দে আমার মা নামের একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলাম। দৈনিক অনুষ্ঠান। প্রামাণ্য। অতি স্বল্পদৈর্ঘ্যের অনুষ্ঠান।

এটিএন বাংলা টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি প্রচার হতো। শুরুতে দিনে একবার, পরে দুবার করে। এখনো এটিএন বাংলা অনুষ্ঠানটি পুনঃপ্রচার করছে বলেই জানি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁদের স্বজন চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছেন কিংবা মারা গেছেন, তাঁদের যুদ্ধস্মৃতি কান্দে আমার মা ধারণ করেছিল।

সেটা ২০০৮ সালের শুরুর দিকে। ইন্টারনেটে কম্বোডিয়ার একটি প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার পাওয়ার কথা পড়ি। ছবির নামটি মনে পড়ছে না এখন। তবে বিষয় ছিল কম্বোডিয়ার যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া পাঁচজন মানুষের কথা। পরিবারের মানুষেরা জানে না কী ঘটেছে তাদের। ওই ছবির বিষয় পড়তে গিয়ে চট করে মনে পড়ে যায় আমার বড় খালার কথা। খুব কাছাকাছি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শ্রুতিলোকন মাধ্যমে প্রামাণ্যকরণ বিষয়ে একটি কি-নোট পেপার লিখতে হয়েছিল আমাকে। লেখাটা তৈরি করতে গিয়ে মনে হলো, যুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছুই জানি না। আর জানতে চাইলেও প্রামাণ্য দলিলগুলো সব আমাদের হাতের কাছে নেই। তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধ আমার মাথায় গেঁথে যায়। প্রামাণ্যকরণের বিষয়টি। আসে কান্দে আমার মা অনুষ্ঠানের ভাবনা।

মুক্তিযুদ্ধ। সহস্র বীরত্বগাথায় পরিপূর্ণ আমাদের এই ইতিহাস। এই বীরত্বগাথাগুলোর ভেতরেই আছে অসংখ্য ট্র্যাজেডি, স্বজন-পরিজন হারানোর হাহাকার। ১৯৭১ থেকে আজ ২০১০। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রজন্মের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই, যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরাও এগিয়ে চলেছেন বিস্মৃতির পথে। কান্দে আমার মা সেই প্রত্যক্ষ প্রজন্মের যুদ্ধস্মৃতি ধারণ করার ব্রত নিয়ে নির্মিত। কান্দে আমার মা করতে গিয়ে আমার বড় খালার মতো এমন বহু মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়। যাঁরা শোক করার সময় পাননি। বুকের মধ্যে সেই নিদারুণ দুঃসহ যুদ্ধস্মৃতি পুষে নিয়ে জীবনযুদ্ধে পথ হেঁটেছেন।

২০০৯ সালের ২ মার্চ থেকে এ বছর (২০১০) ২৬ মার্চ পর্যন্ত কান্দে আমার মার মোট ৩১০টি পর্ব প্রচার হয়েছে। বাংলাদেশের লিখিত ইতিহাসে যাঁদের কথা পড়েছি এত দিন, তাঁরা মূলত শহরের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মানুষ। যুদ্ধ হয়েছিল বাংলার সর্বত্র। কোন সেই নিভৃত গ্রাম, যেখানে এখনো যাতায়াত সহজ নয়, সেই সব গ্রামের মানুষেরাও কিন্তু যুদ্ধ করেছেন, গণহত্যার শিকার হয়েছেন। সেই সব মানুষের কথা আমার মতো সাধারণ মানুষ জানি কম, বলতে হয় জানিই না। কান্দে আমার মা সেই সব মানুষের কথাই শুনতে চেয়েছিল বেশি করে। বাংলাদেশের ১০টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় ১০০টি ইউনিয়নে যাওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারা হাজারেরও বেশি মানুষের যুদ্ধস্মৃতি শোনার বেদনাদায়ক এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কান্দে আমার মার নির্মাণ দলের দেড় বছর কেটেছে।

কী বেদনার সেই স্মৃতি! প্রতিবার শুটিং করতে গিয়ে মনে হতো ‘হূদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’। তবুও ওই সব বেদনার ভেতর থেকে ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া গণহত্যার দিকে চোখ ফেরানোর প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়নি এখনো। যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি এখনো। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষ এখনো বুক ফুলিয়ে চলছে।

মৃত্যু—সে যুদ্ধের ময়দানে একরকম। কিন্তু সেই মৃত্যু যদি ডেকে নিয়ে আসে বন্ধুবেশী রাজাকার পুত্র? মনে পড়ছে, মানিকগঞ্জের হেলাচিয়া গ্রামের রবীন্দ্রনাথ সরকারকে। তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাঁরই সহপাঠী পিয়ারা। পিয়ারা মানিকগঞ্জ শান্তি কমিটি প্রধানের পুত্র! তারপর থেকে পুরো পরিবারের অপেক্ষা—শেষ হয়নি আজও।

যদি ঘুম ভাঙে গুলির শব্দে এবং একদিনে হারিয়ে যায় তরতাজা ৭০৩ জন মানুষের প্রাণ? এমনটাই তো ঘটেছিল কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাতিয়া গ্রামে। কী করে ভুলব আমি ফুলঝুরি নামে সুন্দর এক মায়ের মুখ, যিনি সেদিন হারিয়েছেন তাঁর প্রিয় স্বামীকে? জয়ন্তী, আয়েশা বেগম, আমেনা, ফুলু, রহিমা খাতুন, মিহিরন, কাসোয়ানী, গোলাপ কিংবা সাহেরা; আলতাফ হোসেন, মো. আমীর আলী, আহসান আলী, কত নাম বলব? চোখের সামনে তাঁদের স্বামী, বাবা, ভাই, পুত্রের মৃত্যু দেখেছেন। একই পরিবারের একাধিক স্বজন। কবর দেওয়ার জায়গা নেই। শোক করার সময় নেই। পালাতে হবে, খেতে হবে। আহা! এমন মৃত্যু দেখেও পিছু ফিরে তাকানোর ফুরসতটুকু ছিল না সেদিন তাঁদের। এখনো বুকের মধ্যে জ্বলন্ত সেই স্মৃতি।

মনে পড়ে ফরিদপুরের নগরকান্দার কথা। সেখানে শহীদনগর কোদালিয়া গ্রামের জাকির হোসেন নিলু, সুফিয়া বেগমসহ আরও অনেকের কথা, তারা পরস্পর আত্মীয়। তাদের পরিবারের ১৯ জন মানুষ একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন! কে কাঁদবে? কে সান্ত্বনা দেবে? কিংবা ফরিদপুর শোভারামপুরের শঙ্করী বালা সাহা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বৃদ্ধ, অসুস্থ, শয্যাশায়ী মাকে ঘরে রেখে নিজের প্রাণ নিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে মা কমলা বালা সাহার সঙ্গে একমাত্র সন্তান শঙ্করী বালার আর দেখা হয়নি। ফরিদপুর গোয়ালচামটের শেফালী রানী সাহা, তাঁর স্বামী অপরেশ সাহা পিন্টু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। স্বামীর মৃতদেহও দেখতে পাননি শেফালী রানী। সেই শোক কি ভুলেছেন তিনি? না। তাঁর ডুকরে ডুকরে আর্তনাদ আজও আমার বুকের মধ্যে গুমরে ওঠে। কী করে ভুলব আমি ফরিদপুর টেপাখোলার খগেনচন্দ্র সরকারকে। চোখের সামনে তাঁর ছোট দুই ভাই, সন্তোষচন্দ্র সরকার এবং নগেন সরকারকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরেরা গুলি করে মেরেছে। দখল করে নিয়েছে তাঁদের পৈতৃক ভিটা!

ফেনী সদরের মধ্যম ধলিয়া গ্রাম। এক বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে পাঁচ ভাইকে। কিছুতেই ভুলতে পারি না শরীফা খাতুনকে। তাঁর বাবা আবদুুর রহীম সেই রাতে শহীদ হন। নদীতে ভেসে যাওয়া শত শত লাশের মধ্য থেকে কিশোরী শরীফা খুঁজে বের করে বাবার মৃতদেহ। দুই বোন মিলে নদীর তীর ধরে বাবার লাশ ভাসিয়ে নিয়ে আসে ঘাটে । তবুও সত্কার হয় না শহীদ আবদুুর রহীমের। ওই দুই ছোট্ট মেয়ে বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনতে পারেনি শহীদ বাবাকে! তখন কে করবে কাকে সাহায্য? সবাই যে শোকের মাতমে মূক হয়ে আছে। পাঁচজন একসঙ্গে বিধবা। কোলে-কাঁখে-পিঠে সন্তানেরা।

চোখের জলে ভেসে যাওয়া দীপালি ভট্টাচার্য। ভুলতে পারি না কান্নায় কণ্ঠ রোধ হয়ে আসা দীপালিদিকে। মুন্সিগঞ্জের দীপালি ভট্টাচার্য হারিয়েছেন তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং বড় ভাই দেবীপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে। মুন্সিগঞ্জ সদরের হরগঙ্গা কলেজে হানাদার বাহিনী ক্যাম্প করেছিল। আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে তাঁরা সদর থেকে দূরে কেওয়ার জমিদারবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু হানাদার বাহিনীর দোসরেরা ঠিকই তাঁদের কথা জেনে যায় এবং এক রাতে ধরে নিয়ে যায় ১৩ জন পুরুষ মানুষকে। দীপালি ভট্টাচার্য তাঁর বাবার মৃতদেহ খুঁজে পাননি। কিন্তু নৌকা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছেন তাঁর ভাইয়ের মৃতদেহ ভাসছে নদীতে। ভাইকে ফেলে নিজের প্রাণ নিয়ে বাঁচতে হয়েছিল, এই গ্লানি কি কেবল দীপালি ভট্টাচার্যের?

জামালপুর জেলার মেলান্দহ সদর। ফিরোজা বেগম ও আনোয়ারা বেগমের ভাই লু্ত্ফর রহমান লেবু। লু্ত্ফর রহমান লেবু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এই অপরাধে মেলান্দহ সদরের রাজাকার-আলবদর বাহিনী তাঁর বাবা ও বড় ভাইকে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার শুরু করে। ষড়যন্ত্রমূলক খবর দিয়ে রাজাকার বাহিনী লু্ত্ফর রহমান লেবুকে মেলান্দহে ডেকে নিয়ে আসে এবং ১৫ দিন নির্মমভাবে অত্যাচার করার পর গুলি করে হত্যা করে। তারপর শহীদ ভাইয়ের মৃতদেহ জামালপুর সদরের শ্মশানঘাট থেকে উদ্ধার করেন ক্লাস নাইনে পড়া ছোটবোন ফিরোজা বেগম। যুদ্ধ শেষে রাজাকারদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। বিচার তো হয়নি কারও!

মেলান্দহের সমর উদ্দিন। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স মাত্র ১৫। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। মেলান্দহ থানায় নিজবাড়ির খুব কাছে পয়লা ব্রিজের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সেখানে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এরপর আর তাঁর খোঁজ মেলেনি। তাঁর বাবা মো. ইন্তাস মোল্লার কাছে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো শোকপত্রই পুত্রের একমাত্র স্মৃতি।

এসব দুঃসহ স্মৃতির কথা আর কত লিখব? দিনের পর দিন কেটে যাবে, তবুও কি লেখা শেষ হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস? ইতিহাসের পাতায় জায়গা না পাওয়া এমন বহু মানুষের কথা, ভাষ্য শোনার এক দুর্লভ সময় এসেছিল আমার জীবনে। সেই সব সাহসী, যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষ তাঁদের জীবনের গভীরতম ক্ষত প্রকাশ করে ইতিহাসের আরেক পাঠ দিয়েছেন আমাকে। কান্দে আমার মার আগের আমি আর এখনকার আমি এক মানুষ নেই। একাত্তর যে আমার জীবনে এমনভাবে আসবে, তাও কোনো দিন ভাবিনি আগে। বাংলাদেশের নদীগুলোর রং যে ২০০৯ সালের পর থেকে রক্ত-বর্ণ দেখব, কে জানত? লাখো লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আমার দেশ-মা, সেই মা যে কাঁদছে এখনো! কারণ, রাজনৈতিক দলাদলি, ক্ষমতার অদল-বদল, সমাজ-সংসারের পরিবর্তন-কাল ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব স্তর ভেদ করে মুক্তিযুদ্ধের সত্য অক্ষরমালা এখনো জ্বলজ্বল করে ওঠেনি আমাদের ইতিহাসের পাতায়। আমাদের এখনো শোনা-জানার বাইরে রয়ে গেছে আরও বহু মানুষের আত্মত্যাগ। সেই সব ত্যাগের সত্য আবিষ্কার হলেই দেশ মাকে আমরা প্রকৃত অর্থে ভালোবাসতে পারব।

ফৌজিয়া খান, চলচ্চিত্র নির্মাতা