বিজ্ঞাপন
default-image

আমি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন গ্রাম এবং স্থানীয় মিল-কারখানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। পরে মিছিল করে ফুলতলা থানায় গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। থানার ওসি হাবিবুর রহমান আমাদের থানায় রক্ষিত ১৭টি রাইফেল ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেন এবং থানা পুলিশের সদস্যদের ফুলতলা বাজারসংলগ্ন যশোর-খুলনা রাস্তার উভয় পাশে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেন। আমরা সেই অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিই।

এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গাড়িবহর যশোর থেকে খুলনা অভিমুখে আসতে থাকে। ফুলতলা এলাকায় ওই গাড়িবহরের পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আমাদের সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয় এবং উভয় দলের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমরা এ সময় অনেককে হারিয়ে ফেলি। অনেকে গুলিতে নিহত হয়। এবং স্থানীয় বাজারের দোকানপাট পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ি। ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা আবার সংগঠিত হতে থাকি এবং বিভিন্নভাবে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকি। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর তাঁবেদার এ দেশীয় দোসররা, যারা শান্তি কমিটি নামে পরিচিত, আমাদের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে থাকে এবং আমাদের না পেয়ে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের ওপর অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন করতে থাকে।

আমরা জানতে পারি, ভারতে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তখন আমরা সংঘবদ্ধভাবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যাই। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের এলাকার শেখ আ. মান্নান, আ. কুদ্দুস, শেখ আলকাজ আলী, স ম রেজওয়ান আলীসহ প্রায় ১৫-১৬ জনের একটি টিম গঠন করে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যাই। প্রথমে ভারতে টাকি হাছানাবাদ ক্যাম্পে যোগদান করে এক মাস থাকার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বা গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিহারের বীরভূম ট্রেনিং ক্যাম্পে চলে যাই। বীরভূমের ট্রেনিং শেষে টাকি হাছানাবাদ হয়ে আমি হাকিমপুর ক্যাম্পে আসি। হাকিমপুর আসার পর আমাকে একটি এসএলআর দেওয়া হয়। ওই সময় আমরা হাকিমপুর ক্যাম্প থেকে যশোর ও খুলনার বিভিন্ন এলাকায় এসে অপারেশন পরিচালনা করতে থাকি এবং যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাঘাছাড়া বাজার, কাকডাঙ্গা, বাঁকড়া বাজার, মনিরামপুর, কেশবপুর এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধ। এরপর আমরা খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকি।

১১ ডিসেম্বর আমি, কুদ্দুস, আ. মান্নান, আলকাছ, রেজওয়ান ও গনি গাইড হিসেবে কাজ করে মেজর মঞ্জুরের বাহিনীকে ফুলতলার ১৪ মাইল নামের জায়গায় নিয়ে আসি এবং ১২ ডিসেম্বর আমরা মেজর মঞ্জুরের বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করি। মেজর মঞ্জুর ওই দিন বেনেপুকুর এলাকায় আমাদের মিত্র বাহিনীসহ সমবেত করে নকশার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা এবং আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা দেন। পরবর্তী সময়ে আমি ১৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর ৩২ ব্রিগেডের সঙ্গে যোগদান করে খুলনার গিলাতলার অদূরে দামোদর এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিই। ১৫ ডিসেম্বর আমাদের অর্থাত্ মুক্তিবাহিনীর দুটি দল মিত্র বাহিনীর সহায়তায় শ্যামগঞ্জ ও পূর্ব শিরোমনি দখল করি। ১৬ ডিসেম্বর আমরা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় পশ্চিম খুলনার শিরোমনি দখল করি। ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর শিরোমনির যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এখানে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে এসে দেখতে পাই, আমাদের বাড়ি-ঘরদোর সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আমি যুদ্ধে যাওয়ার পর আমার ছোট ভাই একবার পালিয়ে গ্রামে আসে। কিন্তু স্থানীয় শান্তি কমিটির দালালেরা তাকে রাজাকারদের হাতে তুলে দেয়। রাজাকারেরা তাদের ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পরে স্থানীয় কয়েকজন লোক তাকে ছাড়িয়ে আনে। কিন্তু নির্যাতনের কারণে সে আর বেশি দিন বাঁচেনি। যুদ্ধের সময় আমার পরিবারের লোকজন সীমান্ত এলাকায় পালিয়ে বেড়িয়ে কোনোভাবে বেঁচে ছিল। স্বাধীনতার পর গ্রামে ফিরে এসে আমার পরিবারকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে যে জমিজায়গা ছিল, তা বিক্রি করতে হয়েছে। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। স্ত্রী ও তিন ছেলে নিয়ে আমার পরিবার। তিন ছেলেকে অনেক কষ্টে পড়ালেখা শিখিয়েছি। তারা সম্প্রতি চাকরি পেয়েছে। তবে বড় কষ্ট পাই, যখন দেখি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদররা এ দেশে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

অনুলিখন: শেখ আবু হাসান, খুলনা

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত