গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি হলো। তখন স্পষ্টই মনে হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারণাটাকে কথার কথায় পরিণত করা হচ্ছে। এই আইনে অন্তত ১৪টি ধারায় আটককে অজামিনযোগ্য বলা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে পরোয়ানা ছাড়া স্রেফ সন্দেহবশত তল্লাশি ও আটকের অধিকার। আইনটির ভেতরে ঠেসে দেওয়া আছে ঔপনিবেশিক ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ও।
এই আইন বলা, লেখা, দেখার স্বাধীনতাকে ১৯৭১-এর বহু পেছনে নিয়ে গেছে—এটা বলছেন অনেকে। কিন্তু বাংলাদেশের বহু মানুষ, বহু ‘সচেতন’ ব্যক্তিত্ব, বহু সাংবাদিক-গবেষক-বুদ্ধিজীবীকে চুপ থাকতে দেখেছি। সমাজে শব্দদূষণ থেকে নদীদূষণ পর্যন্ত বহু বিষয়ে হামেশা বক্তব্য-বিবৃতি দেন তাঁরা। মাত্র তিন-চার মাস আগের ঘটনা; আমার স্মৃতি এখনো তরতাজা রয়েছে। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ডান-বাম-ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদের অনেককে কিছু বলতে দেখিনি। তাঁদের চাই শক্তিশালী এক ‘রাষ্ট্র’। তাঁরা নিজ নিজ স্বাধীনতাকে সর্বাত্মক এক ‘রাষ্ট্র’-এর হাতে সঁপে দিতে কুণ্ঠিত নন। অবলীলায় সঁপে দিয়েছেনও। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মধ্য দিয়ে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এই আইন কার্যকর হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৭তম বিজয় বার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সক্রিয় নজরদারিতে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ নতুন এক কালপর্বে প্রবেশ করেছে।
তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে নাগরিক স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক আইন এ দেশে হয়নি। চুয়াত্তরের বিশেষ ক্ষমতা আইনের কথা অনেকের মনে পড়বে। এখনো বহাল তবিয়তেই জারি আছে সেই আইন। কিন্তু চুয়াত্তরের সঙ্গে আজকের পার্থক্য হলো, তখন ওই আইনের বিরুদ্ধে বড় আকারে আপত্তি ছিল। সোচ্চার প্রতিবাদ ছিল। আজ যা নেই। আজকের নির্লিপ্ত নাগরিক সমাজের আপাতত স্বাধীনতা প্রয়োজন নেই। ৪৭ বছর পর আসলেই আমরা এমন একসময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যখন নাগরিকদের বিরাট অংশ শোনা-বলা-দেখার স্বাধীনতার প্রয়োজন বোধ করছে না। এ রকম নাগরিক সমাজ যে জনপদে তৈরি হয়, সেখানে যে রকম রাষ্ট্র গড়ে ওঠে—৪৭ বছর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেখানে এসেই দাঁড়িয়েছে। নাগরিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যেভাবে চেয়েছে সে রকম এক রাষ্ট্রই তার সামনে হাজির। যে ‘রাষ্ট্র’ আপাদমস্তক ঔপনিবেশিক মননে আচ্ছন্ন—যে রাষ্ট্র তার সুশীল মোড়ক ছুড়ে ফেলে দিতেও কুণ্ঠিত নয় আর।
১৯৭১-এর চিত্রটি ছিল ভিন্ন। সেদিন শহুরে তারুণ্য থেকে গ্রামের চাষি, সবাই চাইছিল কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বিলোপ। জাতিগত আধিপত্যের অবসান। এবং এমন এক গণতন্ত্র, যা নিচ থেকে উঠে আসবে। যা হবে অংশগ্রহণমূলক। যে রাষ্ট্র কেবল কতিপয় পরিবারের সম্পদ তৈরির মেশিন হয়ে উঠবে না। যেখানে প্রশাসন ‘সমাজ’-এর প্রতিনিধিত্ব করবে, তারা কারাগারের প্রহরী হবে না। যে রাষ্ট্রে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থাকবে নীতিনির্ধারণে।
আজ যদি কেউ হিপোক্র্যাট না হয় এবং যদি সত্যি সত্যি নির্মোহভাবে একাত্তরের চাওয়া-পাওয়াকে মিলিয়ে দেখার হিম্মত থাকে—তাহলে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক—কোনো ক্ষেত্রেই উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কোনো অর্জন খুঁজে পাবেন না।
এ রকম মূল্যায়নের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। অন্তত বাংলাদেশের বিশাল অর্থনীতির উদাহরণ আসবে। বিশাল আকারের ব্রিজ, ওভারব্রিজগুলোর কথা বলা হবে। বাহাত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের বাজেটের আয়তন ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। আজ সেটা প্রায় চার শ গুণ বড় হয়েছে। অর্থনীতির এই উল্লম্ফন বিস্ময়কর বৈকি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। কিন্তু সম্পদ কার হাতে পুঞ্জীভূত সে প্রশ্নটি তোলা কি জরুরি নয়? একাত্তরে সম্পদশালী হওয়া নয়, সম্পদের সুষম বণ্টনের স্বপ্নই ছিল প্রধান। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম তাত্ত্বিক রণধ্বনি। সেটা হয়নি। সেটা পায়নি বাংলাদেশ। সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে খোঁজাও অজামিনযোগ্য করে ফেলা হচ্ছে।
ফলে আজকের সম্পদ বৃদ্ধিতে আত্মশ্লাঘা থাকলেও তাতে মুক্তিযুদ্ধ আছে কি? যাঁরা অর্থনীতির বিশাল আকার-আকৃতির গল্প শোনান, তাঁরা এটা চেপে যান, বর্তমানে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু ঋণ প্রায় ৮৩ হাজার টাকা। গত সেপ্টেম্বরের সর্বশেষ হিসাবে দেশে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। দফায় দফায় পুনঃতফসিল করার পর খেলাপি ঋণের অঙ্ক এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এটা সত্য, মাথাপিছু ঋণ এবং খেলাপি ঋণের মতোই মাথাপিছু আয়ও ১৯৭২-এর চেয়ে বেড়েছে। অন্তত ১২ গুণ বেড়েছে। কিন্তু সেটা হলো গড় হিসাব। পরিসংখ্যানে প্যাঁচানো তথ্যমাত্র। ঋণগুলো সম্পদ আকারে গুটিকয়েকের কোষাগারে জমা হচ্ছে—এটাই আসল বাস্তবতা।
সবচেয়ে ধনী ওপরতলার ১০ শতাংশের মাথাপিছু গড় আয় পাঁচ হাজার ডলারের বেশি এখন, যা নিচুতলার ১০ শতাংশের গড় আয়ের চেয়ে অন্তত ১৮ গুণ বেশি। মহাধনী ৫ শতাংশের কাছে জাতীয় আয়ের ২৫ শতাংশ পুঞ্জীভূত হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পদ ও জনগণের সম্পদের মধ্যে একধরনের বিপজ্জনক ধোঁয়াশা অবস্থা তৈরি হয়েছে। উপরন্তু গুটিকয়েকের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদ পাচার হচ্ছে। মোটাদাগের এক সম্পদ-পাচার সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে আজ বাংলাদেশ ‘বিজয় দিবস’ উদ্যাপন করছে। এ ‘বিজয়’ কার—তার উত্তর স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত কে ‘বিজয়ী’ হলো বাংলাদেশে—সেটাও দুর্বোধ্য নয়। স্বাধীনতা–পূর্ব ‘ছয় দফা’ ও ‘এগারো দফা’, নব্বইয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘দশ দফা’ এবং ‘তিন জোটের রূপরেখা’র সঙ্গে আজকের বিজয় ‘উদ্যাপন’কে মিলিয়ে দেখলে পাওয়া যাবে চাওয়া-পাওয়ার বড় ব্যবধান। দেখা যাবে নজিরবিহীন ব্যর্থতা। বিশ্বাসভঙ্গ। দেখা যাবে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামে বিজয়ের পরও উপরিউক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রনৈতিক লক্ষ্যের নির্মমভাবে দলিত ও পিষ্ট হওয়ার দৃশ্য।
আবার এই ব্যর্থতা ও বিশ্বাসভঙ্গের উল্টো দিকেই দেখ যায় নাগরিকদের বাঙালি-পাহাড়ি, ভারতপন্থী-পাকিস্তানপন্থী, আস্তিক-নাস্তিক, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ইত্যাদি বহুভাবে বিভক্ত রাখার সূক্ষ্ম-সচেতন চেষ্টা। সময় যত গড়াচ্ছে, এসব ‘প্রচেষ্টা’ তত শক্ত-সবল হচ্ছে। এসব প্রচেষ্টা ধনী-গরিবের ব্যবধান জারি রাখা এবং পাচারপ্রক্রিয়ার রাজনীতির সঙ্গে মানানসই, জরুরিও হয়তো। এভাবেই ১৯৭১-এর ডিসেম্বর এবং ১৯৯০-এর ডিসেম্বরের সঙ্গে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের অনেক অনেক ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
তরুণেরা এসব কারণেই হতাশ। বিক্ষুব্ধ। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার মতো প্রবণতা বাড়ছে। আত্মহত্যাকে প্রতিবাদের ধরন হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু তা–ই ঘটছে—দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে। এসব মৃত্যুর আগে-পরে চারপাশের ছোট সংঘগুলোতে তরুণেরা বলছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্রনৈতিক পুনর্গঠনের কথা। চলতি স্থিতাবস্থার মধ্যে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ত্রাসনির্ভর স্থিতাবস্থার পরিবর্তে তারা চাইছে মানবিক স্থিতিশীলতা। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র দুটোই চাইছে তারা। ‘মুনাফা অর্জন’ এবং তা নির্বিঘ্নে ‘বিদেশে প্রেরণ’-এর পাহারাদার হিসেবে যে রাজনীতি—তার বিপরীতে নতুন কিছু চাইছে তারুণ্য। যা কর্মসংস্থান তৈরি করবে। যা সারাক্ষণ দেশ ছেড়ে পালানোকে উৎসাহ জোগাবে না। যে রাজনীতি জানাবে—কোথায় জনগণের করের অর্থ খরচ হচ্ছে এবং কীভাবে খরচ হচ্ছে। যে রাজনীতি বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি সেগুলোর ভালো-মন্দ-লাভ-লোকসান নিয়ে কথা বলারও সুযোগ তৈরি করবে। যে রাজনীতি ঔপনিবেশিক ‘শাসনের আইন’গুলোকে ‘আইনের শাসন’-এর উপযোগী করে পুনর্গঠন করবে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপনের আগেই বাংলাদেশকে সেই রাজনীতি খুঁজে পেতে হবে।
যেখানে ক্ষমতার মালিকানা হবে জনগণের; কোনো গোষ্ঠী, দু-তিনটি রাজনৈতিক দল বা কয়েকটি পরিবারের নয়। যেখানে ভয়-ভীতি-বিভীষিকার বিপরীতে সংলাপ ও ভিন্নমতের নিরাপত্তা থাকবে। যেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হবে। এর জন্য আজকের ‘রাষ্ট্র’-এর অহিংস ও মানবিক রূপান্তর অপরিহার্য। সুতরাং ন্যায্যতই আগামী দিনের বাংলাদেশেও ‘মুক্তি’র প্রশ্নটিই থাকছে মুখ্য প্রশ্ন আকারে। যে মুক্তির ডাক একাত্তর তৈরি করেছিল—তার পুনর্জন্ম ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আর কোনো পথ নেই। ৪৭ বছর পরও বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিই প্রধান প্রশ্ন। ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার জরুরি। কিন্তু পুরোনো রাজনীতি ও রাজনীতিবিদেরা সেটা আর দিতে পারবেন বলে মনে হয় না।
একটি স্বাধীন দেশ দশকের পর দশক ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব ও দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে চলতে পারে না। স্বাধীনতা উপভোগ করতে হলে একটি বশীভূত সমাজের উঠে দাঁড়ানো প্রয়োজন। ফলে ভবিষ্যতে দ্রুতই বাংলাদেশকে তার স্বাধীনতা ও মুক্তির দর্শনকে খুঁজে পেতে হবে আদি-অকৃত্রিম-উজ্জ্বল মহিমায়।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে আজকের তরুণ-তরুণীদের রাজনীতিবিদ হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা নির্মাণ করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে কোনো দ্বিতীয় রাষ্ট্রনৈতিক বিকল্প নেই। এটাই এখনকার বনিয়াদি আকাঙ্ক্ষা।
গত ১০০ বছরে এ অঞ্চলের তরুণেরা দুবার স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের সংগ্রামেও তারা বিজয়ী হবে।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক।
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত