বিজ্ঞাপন
default-image

শহর ছাড়িয়ে আসতেই রাস্তার দুই দিক থেকে কুয়াশা ছুটে এসে হাঁটু গেড়ে বসল দক্ষ সৈনিক দলের মতো, মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য তৈরি হয়ে। তাদের সঙ্গে এল হাড় কাঁপানো শীত যার ছড়ানো হাত সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতো ঢুকে গেল বন্ধ মাইক্রোবাসের ভেতর অনায়াসে। ভেতরে সাতজন জড়াজড়ি করে বসে থাকলেও এখন হঠাত্ তারা শীতে জবুথবু হয়ে গেল। গলার স্বর এল জড়িয়ে এবং শোনাল ভারী হয়ে। সামনের রাস্তায় ততক্ষণে একটা স্মোক স্ক্রিন তৈরি করে ফেলেছে কুয়াশা, যার জন্য মাইক্রোবাসের গতি শ্লথ হয়ে এল। অ্যাডভান্স টু অ্যাটাক, মনে মনে বলল কামরুল। সে ১৯৭১ সালে সেক্টর ক্যাপ্টেন ছিল।

রকিব কাঁপুনে গলায় বলল, শহরে থেকে শীতের দাপট টের পাই না আমরা। গরম কাপড় পরার সুযোগই হয় না। বলাবলি করি, শীত চলে গেল আসতে না আসতেই। অথচ দ্যাখ শীত ঠিকই আছে, আগের মতোই। বাতাস এসে স্পর্শ করলেই শরীর কাঁপায়। শহরে কংক্রিট-কাচের ভিড়ে, ট্রাফিকের ধোঁয়া, পথের ধুলোয় আর মানুষের ভিড়ে শীত বেচারা ঢুকতেই পারে না। আর যদি পারেও তাহলে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে এখানে-সেখানে, যেন পালানোর পথ খুঁজছে। রকিব গলাবন্ধ সোয়েটার টেনে দিল। তার মোটা শরীর আরও স্ফীত হয়ে উঠেছে গরম কাপড়ে। সাদা-পাকা চুল উড়ছে এলোমেলো। পুরু ঠোঁট নীল হয়ে এসেছে।

জাফর বলল, শীত পালায়নি, চলেও যায়নি। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, কিওতো প্রটোকল, এসব ফাঁকা আওয়াজ। আমরাই শহরকে জনাকীর্ণ করে, ফাঁকফোকর সব বন্ধ করে শীতকে ঢুকতে দিই না। ঢুকলেও তেড়ে আসি হইচই করে দূরে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তার কৃশ শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। সাদা চামড়া জাগায় জাগায় লাল দেখায়। নাকের নিচে সূক্ষ্ম গোঁফ যেন বরফ জমাট।

কামরুল বলল, হ্যাঁ। সেটাই ঠিক। আর সে জন্য শীত দেখতে হলে গ্রামে আসার বিকল্প নেই। অন্য কারণ তো আছেই, কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শীতের এই চেহারা দেখার আকর্ষণও কম নয় আমার কাছে। তারপর ঝাকড়া চুল নাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, অবশ্য ওদের দেখার জন্য যেতেই হয়, শীত থাকুক আর না-ই থাকুক।

জমির দুই হাত পকেটে রেখে বাইরে তাকিয়ে ছিল, যেন অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিল। তাকে কিছুটা বিষণ্নও দেখাচ্ছিল, যদিও লাল সোয়েটার পরে ফুর্তিবাজ ভাব এনেছে কিছুটা। সে বলে, শীতের সময় ওদের দেখতে যাওয়ার অর্থ আর ব্যঞ্জনা ভিন্ন। একটা এলেজি, শোকগাথার আবহ রয়েছে এই সিজনে। কেমন রিক্ত, শীর্ণ ভাব চারদিকে, একটুও বাহুল্য নেই প্রকৃতিতে। প্রায় সব গাছ পত্রশূন্য। সবাই যেন শোকাহত। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেই কথাগুলো বলে।

তার কথা শুনে মাইক্রোবাসের ভেতর বাকি ছয়জন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। মাইক্রোবাসের ইঞ্জিন দ্রুত গতি হারিয়ে ফেলে অস্ফুট স্বরে গর্জন করে। মসৃণ পথের ওপর টায়ারের রাবার সর সর শব্দ তোলে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। জমিরের দুঃখভারাক্রান্ত কথা হঠাত্ সবার ভেতর ভাবান্তর আনে। তারা নিজের মতো করে অতীতে চলে যায়।

গুমোট আর বিষণ্নতা ভাঙার জন্যই যেন তুষার পেছন থেকে বলে, ক্যাসেটে গান হোক। দেশাত্মকবোধক গান নেই?

মাইক্রোবাসের ড্রাইভার এক হাতে গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট খুলে অন্য হাতে হাতড়াতে হাতড়াতে কয়েকটা ক্যাসেট বের করে। সবই হিন্দি, মুম্বাই সিনেমার জনপ্রিয় গানের ক্যাসেট। জানে মন, ডন-২, বিবাহ, উহ লমহে—এইসব। আইয়ুব বাচ্চুর একটা ক্যাসেট পাওয়া গেল, আর একটা ফরিদা পারভীনের। তুষার বলল, ফরিদা পারভীনই চলুক। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়’। রিনরিনে গলায় তীক্ষ স্বরে কথাগুলো একটু পরই মাইক্রোবাসের ভেতরটা ভরে ফেলে, ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় নিবেদন আর আকুতির স্বর।

রহিম বলে, খালাম্মার পিঠার স্বাদই ভিন্ন। শহরে এখন প্রায় দোকানেই পিঠা পাওয়া যায়। খেতে মন্দ না, কিন্তু খালাম্মার হাতে তৈরি পিঠার মতো হয় না। এবার নাকি নতুন পিঠা তৈরি করেছেন, বলে পাঠিয়েছেন তিনি। কথা শেষ করে সে প্রফুল্ল চোখে তাকায়। তার গায়ে সাদা উলের আলোয়ান, কুমিল্লার তৈরি। গোলগাল মুখে চর্বি জমেছে। অধ্যাপক অধ্যাপক ভাব।

জালাল বলল, সেই সঙ্গে তার বাগানের খেজুর গাছের রস। চমত্কার কম্বিনেশন। আহা। কথা শেষ হওয়ার পর তার লিচুর মতো বড় বড় চোখ চকচক করে উঠল। সে আজকাল বেশ ভোজন রসিক হয়ে গেছে।

রকিব বলল, খালাম্মা এক রকমই রয়ে গেলেন। বাড়িটার সংস্কার করলেন না, পুকুরের ঘাটলা আগের মতোই রেখে দিয়েছেন। খেজুর বাগান, আমবাগান, বাঁশের ঝাড় সবই আগের মতো। সেখানে গেলে ১৯৭১-এর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে হয় এই তো সেদিন এসে গেলাম। থেকে গেলাম। খুব তাড়াহুড়ো ছিল তখন।

জাফর বলল, স্মৃতি। বলেছেনই তো তিনি, পুরোনো সবকিছুতে স্মৃতি যেমন জেগে থাকে, বদলালে তা চলে যায়। তিনি সেই জন্য কিছুই বদলাতে চান না। এই যে বছরের একটা দিনে সবাই মিলে স্মৃতির দিকে তাকানো, সেটাও তো তিনি কেবল আমাদের এই কজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। অথচ এখানে বিজয় দিবসের উত্সব হতে পারত। তাহলে গানবাজনা হতো। ফুলের মালা আর স্তবক নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেত নানা বয়েসের মানুষ। টেলিভিশন, রেডিও ছুটে আসত প্রোগ্রামের জন্য। তিনি এসব কিছুই হতে দিলেন না। শুধু প্রথম বছর ছাড়া। অদ্ভুত স্বভাব বটে। তার কথায় পুরোনো কথা মনে করার আভাস।

জমির হতাশার ভঙ্গিতে বলল, আমরা চেষ্টা করেছি। বাট উই ফেইলড। কী করা যাবে? তার নিজের জায়গায় তিনি যদি কিছু করতে দিতে না চান তাহলে আমরা শহর থেকে এসে কী করতে পারি? বলে সে কাঁধ ঝাঁকুনি দিল।

কামরুল বলে, তারা আমাদের বন্ধু ছিল। সহযোদ্ধা ছিল। আমাদেরও দাবি আছে। খালাম্মা এটা অস্বীকার করতে পারেন না।

তুষার বলে, খালাম্মা বলেন তারা তার ছেলে। তাদের ওপর তার অধিকারই বেশি। এর ওপর আর কোনো কথা চলে না। তারপর একটু থেমে বলে, তার দৃষ্টি দিয়ে আমরা কেউ ঘটনাগুলো, মানুষগুলোকে দেখি না। যে ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটেছে, যেসব মানুষ হারিয়ে গেছে তারা তার কাছে অন্য অর্থ নিয়ে, ভিন্ন আলোয় দেখা দেয়। আমরা খালাম্মার মনের ভেতর ঢুকতে পারি না। যতই কাছ থেকে দেখি না কেন।

রহিম বলে, অদ্ভুত মহিলা। এই এত বছর হয়ে গেল। একটুও বদলালেন না। কোনো সরকারের কাছে হাত পাতলেন না। কাগজে ছবি ছাপালেন না, বিবৃতি দিলেন না। যেন খুব সাধারণ মানুষ একজন। তাকে নিয়ে হইচই করার মতো কিছু নেই। তার কথাগুলো স্বগতোক্তির মতো শোনাল।

জালাল বলল, শুনেছি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত খেজুর বাগানের মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিড় বিড় করেন নিজ মনে। কখনো হেঁটে বেড়ান মাঠের ভেতর সাবধানে পা ফেলে ফেলে। নাম ধরে ডাকেন। কবরগুলো নিজেই পরিষ্কার করেন। ঘাস কাটেন, দূর্বা দিয়ে জেগে ওঠা মাটি ঢেকে দেন। সবুজ ঘাসে মসৃণ করে রাখেন প্রতিটি কবর। কোনো চিহ্ন নেই, নাম লেখা নেই, কিন্তু সব তার মুখস্থ। এক নজরেই বলে দিতে পারেন কে কোথায় শুয়ে আছে। এইডা হলো গিয়া হামদু। হামদুরে চিনলা না? আরে একাই দশটা পাঞ্জাবিরে মারছে। হাতে গুলি লাগছিল। আমার বাড়িত আইয়া হুইয়া থাকল দশ দিন। ডাক্তার নাই, কবরেজ নাই। নিজেই বাইন্ধা দিলাম কাপড় দিয়া। ক্যামনে ক্যামনে সাইরা গেল। ভালা হইতে না হইতে আবার গেল গিয়া বর্ডার পার হইয়া। বর্ডার তো ওই দেহন যায়। ঢিল মারলে ওইখানে গিয়া পড়ে। হেইবার ফিরল তোমাগো কাঁধের উপর শুইয়া। খুব বড় জখম হইছিল। ভালা করতাম পারলাম না এইবার। খুব শক্ত আছিল পোলাডা, একটুও যন্ত্রণায় কাতরায় নাই। বলতে বলতে খালাম্মা হামদুর কবরে সবুজ ঘাস মসৃণ করে দেন দুই হাতে দিয়ে। যেন সস্নেহে আদর করছেন।

তারপর উঠে পাশের কবরটার দিকে তাকিয়ে বলেন, সাত্তার। এই হানে সাত্তার। গুলিতে মাথাটা ভাইঙ্গা টুকরা টুকরা হইয়া গেছিল। চেহারা দেইখা চেনন যায় না। কিন্তু আমি ঠিকই চিনতাম পারছি। ক্যান পারুম না? কত দিন খাওয়াইছি পাশে বহাইয়া। খাইতে কি চায়? খালি কয়, যাই গা, দেরি হইয়া যাইতাছে। অপারেশনের টাইম হইয়া গ্যাছে। হগলে অপেক্ষা করতাছে। বড় চঞ্চল আছিল। সাত্তার। তার মা-বোন আইছিল স্বাধীনের পর। খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি তাদের কইছি, সাত্তার কষ্ট পায় নাই। খুব শান্তিতেই মরছে সে। আমার কোলে মাথা ধরা ছিল। ভাঙ্গা, রক্তমাখা মাথা। বলতে বলতে খালাম্মার স্বর ভারী হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, তারা আইত বছরে একবার। তারপর তার মা মইরা গেল। বইনটা গেল গিয়ো বিদেশ। যাউক গিয়া। খালাম্মা তো রইছে। দেখা-হুনার মানুষ আছে। সাত্তারের আছে, হামদুর আছে, তমিজের আছে, আলমের আছে, সালামের আছে, রাসেলের আছে, হাকিমের আছে। খালাম্মা গড়গড় করে নামগুলো বলে যান। তারপর একে একে কবরগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যান। একটু সময় নিয়ে থামেন প্রতিটির পাশে, দাঁড়িয়ে থেকে বিড় বিড় করে কিছু বলেন। মনে হয় যেন কথা বলছেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে। খুব তন্ময় হয়ে থাকেন তিনি। চারপাশে কারও প্রতি কোনো কিছুর প্রতি মনোযোগ থাকে না তখন।

কাজের ছেলেটা বলে, খালাম্মা প্রায় বিকেলেই এভাবে একা একা ঘোরেন মাঠটার চারদিকে। মাটির ঢিবিগুলো পরিষ্কার করেন নিজ হাতে। একটা শুকনো পাতাও পড়তে দেন না, মরা ঘাস থাকতে দেন না। সবুজ, সতেজ চেহারা নিয়ে উঁচু হয়ে থাকে পরপর সাজানো ঢিবিগুলো। ২২টা ঢিবি। স্থানীয় লোকজন নাম দিয়েছে বাইশা বীরের মাঠ। ২২ বীরের মাঠ। প্রথম দিকে খবরের কাগজে ছবি উঠেছিল, প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। এখন এই এত বছর পর সেসব আর হয় না। খালাম্মাও পছন্দ করেন না। শুধু তাদের সাত বন্ধুকে আসতে বলেন ডিসেম্বর মাস এলেই। দিনটা তিনি ভোলেন না।

রকিব স্বগতোক্তির মতো বলে, খালাম্মার বাড়িতে কত রাত কাটিয়েছি সেই সময়। গরম গরম ভাত, মাছ, ডাল। মনেই হতো না কষ্টে আছি।

জাফর বলল, ঘুমিয়েও নিয়েছি তার বাড়িতে। মেঝেতে এজমালি বিছানা পাতা। যখন খুশি ঘুমিয়ে নাও। ঘুম থেকে উঠে নাশতা করো, খানা খাও। যেন আর্মি মেস। খালাম্মা নিশ্চয়ই তার সব সঞ্চয় খরচ করেছিলেন সেই সময়। অথচ আমরা কী করছি না-করছি সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না একটুও। শুধু বলতেন, তোমরা সব ভালা ছেলে। চেহারাই কইয়া দেয়। তোমরা খারাপ কাম করতে পারো না। তোমরা দ্যাশের ভালা করতাছ।

মাইক্রোবাসটা রাস্তা ফাঁকা পেয়ে হঠাত্ স্পিড বাড়িয়ে দেয়। কুয়াশা সরে গিয়েছে রাস্তার দুই পাশে। সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে পিচের মসৃণ রাস্তা। মাইক্রোবাসের দ্রুত গতিতে ঝাঁকুনি খেল ভেতরের সবাই। ফরিদা পারভীন তখন গাইছে, ‘আমি একদিনও না চিনিলাম তারে।’ উল্টো দিক থেকে একটা বাস এসে ধাক্কা দেওয়ার মতো বাতাসের ঝাপ্টা দিল মাইক্রোবাসের গায়ে। মাইক্রোবাস একটু দুলে উঠল সেই ধাক্কায়। ভেতরে তারা নড়েচড়ে বসল।

জালাল সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এবার খালাম্মাকে রাজি করাতে হবে। প্রত্যেকের নাম আর মৃত্যু তারিখ নিয়ে ফলক ঝোলাব আমরা। স্মৃতিফলক। এপিটাফ।

কামরুল বলে, খালাম্মা রাজি হবেন বলে মনে হয় না। তিনি সব ন্যাচারাল রাখতে চান। গাছ, ঘাস, ফুল, প্রজাপতি—এই সবই তার কাছে স্মৃতিফলক। আর নাম? সব তো তার মুখস্থ।

তুষার বলে, তার মুখস্থ। অন্যদের তো মুখস্থ নেই। তিনি, বলে সে একটু থামে। তারপর বলে, তিনি চলে গেলে কেউ কি বলতে পারবে কে কোথায় শুয়ে আছে?

তার প্রশ্ন শুনে মাইক্রোবাসের ভেতর একটা স্তব্ধতা নামে। সবাই যেন একটু চিন্তায় পড়ে। নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকে তারা।

রহিম মাথা নেড়ে সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, এবার খালাম্মাকে রাজি করাতে হবে। সব ব্যবস্থা আমরাই করব। নাম লেখা, কংক্রিটের স্তম্ভ তৈরি, এসব করার দায়িত্ব আমাদেরই। তিনি শুধু সম্মতি দেবেন।

জমির বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখা যাক। বলতে ক্ষতি কী? তিনি মত বদলাতেও পারেন। তাঁর বয়স বাড়ছে, দুর্বল হচ্ছেন। স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই। এত নাম, তাদের ঠিকানা এসব মনে করতে পারবেন কেমন করে, সেই চিন্তা কি তারও হয় না? নিশ্চয়ই হয়। আজ বলব আমরা।

জালাল বলে, আমি সেই দৃশ্যটা এখনো ভুলতে পারি না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বর্ডার পেরিয়ে খালাম্মার বাড়িতে পৌঁছে দেখি রাজাকারেরা খালাম্মাকে ঘিরে ফেলেছে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে রেখে লাথি মারতে মারতে বলছে—বল শালি, তারা কয়জন? কহন কহন আহে এহানে? এক্ষনি ক দেহি। না হইলে শ্যাষ করা ফালামু।

খালাম্মা গোঙানোর স্বরে বললেন—হ্যারা আমার পুত। আমারে দেখবার আইছিল। আবার ফিরা গ্যাছে।

রাজারকারদের একজন লাথি মেরে বলল—তোর পুত? তোর সব পুতই তো কলেরায় মরছে। তারা ফিরা আইলো ক্যামনে?

খালাম্মা শোনা যায় না এমন স্বরে বললেন, মরে নাই। কেউ মরে নাই। সব বাইচা আছে।

রাজাকারের নেতা সবাইকে উদ্দেশ করে বলে—থাক। এ্যাহন মারিস না। আস্তে আস্তে কথা বার করন যাইব। এইহানে বইয়া পাহারা দে তোরা। হালারা আইলেই ধইরা ফালাইবি। খুব মজা পাইছে, বর্ডারের কাছে ক্যাম্প বানাইছে। হ। আমি ক্যাপ্টেন সাবরে খবর দিতাম যাই।

বুঝলি। রাজাকার নেতাকে কমান্ডারের কাছে যেতে দিইনি। বাঁশঝাড়ে ঘাপটি মেরে ছিলাম আহত পা নিয়ে। রক্ত ঝরছে তখনো। পাশ দিয়ে যেতেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরেছিলাম মাথায়। টুঁ শব্দও করতে পারেনি ব্যাটা। কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গিয়েছিল ভেজা মাটিতে। টেনে এনে লুকিয়ে রেখেছিলাম খানাখন্দকের ভেতর, কচুঘেঁচু গাছে ঢাকা পড়েছিল। ব্যাঙ লাফ দিচ্ছিল, কাক উড়ে গেল ভয় পেয়ে ডাক দিতে দিতে। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। তারপর খোঁড়া পা নিয়েই খবর দিতে গেছি তোদের। যেন তোরা রাজাকারদের ফাঁদে না পড়িস।

জহির বলে, হ্যাঁ। সময়মতো এসেছিলি। না হলে সবাই শেষ হয়ে যেতাম। আমরা অপারেশন শেষ করে খালাম্মার বাড়ির দিকেই রওনা হয়েছিলাম। তার কথায় অতীতের গন্ধ।

জালাল হঠাত্ জোর গলায় বলে, খালাম্মাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া উচিত ছিল।

কামরুল ঠোঁট উল্টে বলল, তিনি তার তোয়াক্কাই করেননি। প্রথমবার শুনতেই বললেন, আমারে আবার খেতাব ক্যান? যুদ্ধ করছো তোমরা, খেতাব পাইলে তোমরাই পাইবা। আমারে ক্যান? আমি আর কী করছি? হ্যাদের বাঁচাইতে পারছি? ২২টা পোলা আমার। বলতে বলতে তিনি চোখ মুছেছেন। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থেকেছেন সামনে। খেজুর বাগানের মাঠে ২২টা মাটির ঢিবি রোদে ঝলকে উঠছে, যেন সবুজ ধোঁয়া উঠছে।

খালাম্মার গ্রামের বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। আরও আগে পৌঁছানো যেত, কিন্তু রাস্তায় দুটো বাস মুখোমুখি সংঘর্ষে উল্টে গিয়েছিল। রাস্তা বন্ধ, বেশ জটলা ছিল সেখানে। আহতদের আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়েছিল। নিহতদের রাস্তার পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছিল সারি দিয়ে। বীভত্স এবং মর্মান্তিক এক দৃশ্য। মাইক্রোবাসে বসেই সাত বন্ধু দেখছিল আর তাদের মনে পড়ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের কথা। ভেতরে বসে অপেক্ষা করছে, সেই সময় একদল লোক এসে তাদের বলেছিল মাইক্রোবাসটা দেওয়া যায় কি না আহতদের উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তারা মাইক্রোবাসটা আহতদের নেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছিল। রাস্তার পাশে একটা প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে বসে ছিল তারা, যতক্ষণ মাইক্রোবাসটা ফেরেনি। ঘণ্টা দেড়েক পর মাইক্রোবাস ফিরলে তারা রক্তমাখা সিট ধুয়ে নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসেছিল। গ্রামের লোক তাদের জন্য ডাব কেটে এনেছিল, সঙ্গে মুড়ি। তারা খায়নি। ক্ষুধার কথা মনেই হয়নি কারও। বাকি পথ চুপচাপ বসেছিল তারা। অচেনা লোক, তবু তাদের লাশ দেখে বেশ শোকার্ত হয়ে পড়েছিল তারা। তখন তারা জানত না যে এই শোক অনেক দূর গড়াবে।

খালাম্মার গ্রামে পৌঁছে দেখা গেল সেখানে অন্যান্য বছরের তুলনায় লোকজনের সমাগম বেশি। তাদের দেখে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার আর প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার সামনে এগ্রিয়ে এলেন। যেন তাদেরই অপেক্ষা করছিলেন তারা।

যেন নয়, সত্যিই তাদের অপেক্ষায় ছিলেন তারা এবং গ্রামের অন্যান্য মানুষ। তাদের কাছ থেকে সব শুনল তারা মুহ্যমান হয়ে। মাইক্রোবাসে শেষ পর্যায়ে যেমন চুপচাপ আর বিষণ্ন হয়েছিল তারা, সেই ভাবটা আরও গভীর হয়ে মনকে বিপর্যস্ত করে দিল। তাদের তখন অনেক কথাই মনে পড়ল, অনেক দৃশ্যই ম্যাজিক লণ্ঠনের ছবির মতো চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, ফিরে এল। কখনো সম্পূর্ণ হয়ে, কখনো খণ্ডে খণ্ডে। তারা নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে থাকল।

বিকেলের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে গেল। সবাই বেশ ক্লান্ত আর বিষণ্ন। আস্তে আস্তে কথা বলছে আর দেখছে চারদিক। খেজুর বাগানের মাঠে নতুন ঢিবিটা একটু উঁচু হয়ে আছে, মাটি আর ঘাস আলগা। সবাই সেই ঢিবিটা দেখছে। মাথার ওপর দিয়ে তখন একঝাঁক টিয়া পাখি উড়ে গেল। সবাই দেখল মুখ উঁচু করে। অনেকদিন এমন দৃশ্য দেখেনি তারা। যেন একটা সবুজ চাদর উড়তে উড়তে চলে গেল, মাঝখানে লাল ছোপ।

গ্রামের মানুষ এখন মাঠটার নাম দিয়েছে তেইশা। ২৩ জনের মাঠ। আগের মতো পরিষ্কার-পরিচছন্ন থাকে না, চোরকাঁটা বড় হয়ে বাদামি ছোপ লেগে থাকে সবুজের ভেতর। ঢিবিগুলো ঢেউয়ের মতো দেখায়। অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় ঢেউয়ের মতো উঠছে-পড়ছে ঢিবির সারি। প্রায় বিকেলে সবুজ টিয়ার দল উড়ে যায়। মনে হয় সবুজ একটা কাপড় উড়ে যাচ্ছে, মাঝখানে লাল ছোপ। গ্রামের লোক বলে এর আগে এত টিয়া পাখি উড়ে যেতে দেখেনি তারা।