বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলা একাডেমীর একটি অসাধারণ কর্ম হচ্ছে স্মৃতি ১৯৭১। এর আগের ইতিহাসটাও বলা প্রয়োজন। মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কিছু কাজ করার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে মনজুরে মাওলা বাংলা একাডেমীতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে তিনি নির্দেশ দিলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে একটি প্রদর্শনী করা যায় কি না। মাত্র ১৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর ব্যবহূত জিনিসপত্র নিয়ে আমরা যে প্রদর্শনীটি করলাম, সেই প্রদর্শনী দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সারি বেঁধে প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশ করতেন। কী ছিল সেখানে? একজন বুদ্ধিজীবীর ব্যবহূত জামা, লুঙ্গি, যেমন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার ব্যবহার করা সিগারেটের প্যাকেট, মুনীর চৌধুরীর চশমা, আলতাফ মাহমুদের হারমোনিয়াম, সিরাজুদ্দীন হোসেনের ব্যবহূত কলম, সামান্য কিছু কিছু জিনিস নিয়ে যে প্রদর্শনী, তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে যে বুদ্ধিজীবী প্রদর্শনীগুলো হয়, তাতে প্রায় ২০০-র মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর ব্যবহূত জিনিসপত্র নিয়ে প্রদর্শনী হয়। এটা একটা ইতিহাস।

আর প্রধানত যে ইতিহাসের কথা বলতেই হবে, সেটা হচ্ছে প্রয়াত মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ১৯৮৮ সালে ৬ নভেম্বর আমাকে বললেন যে নতুন কিছু করা যায় কি না। অর্থাত্ নিহত বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়স্বজনদের লেখা নিয়ে একটি সংকলন করা যায় কি না। প্রমাদ গুনেছিলাম। তা সত্ত্বেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আমরা (আমি ও আমার সহকর্মী মো. মোতাহার আহমেদ) কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর বাড়িতে গেলাম। প্রথমেই যাঁর নাম উল্লেখ করব, তিনি হচ্ছেন শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা যখন বললেন যে তাঁর শরীরে যে তিনটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল, সেগুলো তাঁর কাছে আছে। অর্থাত্ তাঁর শরীর ভেদ করে যে বুলেট গিয়ে দেয়ালে লেগেছে, সেই বুলেটগুলো। আমার শরীর শিউরে ওঠে সেই বুলেট তিনটি দেখে। এভাবেই শহীদদের নানা জিনিসপত্র জোগাড় করলাম।

আমার এখনো অবাক লাগে, ৬ নভেম্বর ১৯৮৮ আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাকে দায়িত্ব দিলেন, আমি দু-একদিন পরই লেখা সংগ্রহ করে একের পর এক যোগাযোগ করতে থাকি। ১৯ নভেম্বর পাঁচটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা সংগ্রহ করি। একদিকে কম্পোজ হচ্ছে, লেখা সংগ্রহ হচ্ছে, প্রুফ দেখা হচ্ছে, এভাবে ডিসেম্বরের ৯ তারিখে ৩৯টি লেখা নিয়ে স্মৃতি ১৯৭১ বের হলো। যেখানে আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেছিলেন, ২০/২৫টি লেখা হলেই চলবে, সেখানে ৩৯টি লেখা সংগৃহীত হওয়ায় তিনি দারুণ খুশি হয়েছিলেন।

এখানে একটি কথা আমি সবিনয়ে বলতে চাই, স্মৃতি ১৯৭১-এর সম্পাদক হিসেবে আমার নাম মুদ্রিত হয় ঠিকই, কিন্তু আমি নিজেকে কখনো সম্পাদক হিসেবে দাবি করি না। যিনি শহীদ হয়েছেন, তাঁর নিকটতম আত্মীয়ের যে কষ্ট, শূন্যতা, হাহাকার, বেদনা—সেগুলো সম্পাদনা করা কী সহজ কথা? আমি সবাইকে একটা কথা বলেছি যে আমি বড়জোর বানান সংশোধন করতে পারি, তথ্যগত বিভ্রান্তি থাকলে সেটা সংশোধন করতে পারি, কিন্তু মূল আবেগের বিষয়টিতে আমি হাত দিতে রাজি নই এবং আমি তা করিনি।

একটা বলার বিষয়, স্মৃতি ১৯৭১ ১৩টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই ১৩টি খণ্ডে ছাপা হয়েছে তিন শতাধিক লেখা। এর ভেতর প্রকৃত লেখক আছেন ২৫ থেকে ৩০ জন। আর অবশিষ্ট? এখানে বলার বিষয় হচ্ছে, অনেকে বলেছেন, আমি তো কখনো লিখিনি। আমি তাঁদের বলার চেষ্টা করেছি, আমি আপনাদের কাছ থেকে সৃষ্টিশীল গল্প-উপন্যাস চাইছি না। আমি চাইছি আপনার নিকটতম আত্মীয়, যিনি শহীদ হয়েছেন, তাঁর সম্পর্কে আপনার সহজ-সরল স্মৃতিচারণামূলক লেখা। পাঠক, আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। এমন অনেক লেখা আছে, যার লেখক কোনো দিন লেখেননি, যাঁর লেখা পড়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কারণ এই, বোঝাই যায়, তাঁর নিকট আপনজন সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তাঁর ভেতর গভীর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে, আমি যেন তাঁর রক্তক্ষরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, স্মৃতি ১৯৭১ নিয়ে একসময় রাজনীতির খেলা চলেছিল। আপনারা লক্ষ করবেন, সপ্তম খণ্ডটি ১৪ ডিসেম্বর বের হয়নি। কারণ, সে সময় বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ। তিনি আমাকে বললেন যে অনেক খণ্ডই তো হলো, আপাতত থামো। এ রকম একটা কথা বলেছিলেন। ইতিমধ্যে কিন্তু বেশ কিছু লেখা সংগৃহীত হয়ে গেছে। তার পরে আমি ফাইল পাঠাই মহাপরিচালকের অনুমতি চেয়ে। সেই ফাইল আর আসে না।

যত দূর মনে পড়ে, ফাইলটি পাঠিয়েছিলাম সেপ্টেম্বর মাসে। সেপ্টেম্বর গেল, অক্টোবর-নভেম্বর গেল, ফাইল আর আসে না। ফাইলের কথা বলি, মহাপরিচালক বলেন, হবে হবে। অত্যন্ত বেদনার কথা হচ্ছে, ডিসেম্বর মাসে ট্রেনে আসার পথে হারুন-উর-রশিদকে বাংলা একাডেমীর পরিচালক সুব্রত বডুয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কোনো জবাব দেননি। ইতিমধ্যে শহীদ পরিবারের সন্তানেরা জেনে গেছেন, এবার স্মৃতি ১৯৭১ বুঝি বের হবে না। তাঁরা ১৩ ডিসেম্বর অধ্যাপক হারুণ অর রশীদের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কাল কি স্মৃতি ১৯৭১ বের হচ্ছে? হারুণ সাহেব এমন এক অভিনয় করে বললেন, এটা তো রশীদ হায়দার করে, সে-ই বলতে পারবে। তখন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহীদ রেজা নূর বলেছিলেন, আপনি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, আপনি জানেন না যে কাল স্মৃতি ১৯৭১ বের হচ্ছে কি না, আপনি আরেকজনের কথা বলছেন! তখন হারুণ অর রশীদ সাহেব বলেছেন, সব দায় কি আমার? শহীদদের সন্তানেরা তাতে আঘাত পেয়েছিলেন। তখন তৌহীদ আবার বলেছিলেন, আপনি মনে রাখবেন, যে চেয়ারে বসে আপনি কথা বলছেন, ওই চেয়ারে আমার বাবার রক্ত মিশে আছে। আপনার মনে থাকা উচিত, মনে রাখা উচিত, যে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তমাখা চেয়ারে বসে আপনি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হয়েছেন, আর আপনি জানবেন না, কাল স্মৃতি ১৯৭১ বের হচ্ছে কি না!

মহাপরিচালক সব দায় আমার ওপর চাপালেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন। তার আগেই একটা ছেলে গিয়ে আমাকে খবর দিয়েছিল, আপনাকে কিন্তু এ ব্যাপারে এক্ষুনি ডাকা হবে। কিছুক্ষণ পর টেলিফোন এল। আমি গেলাম। মহাপরিচালক প্রথম থেকেই আক্রমণে গেলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, কাল স্মৃতি ১৯৭১ বের হচ্ছে না? আমি বললাম, আপনার কাছ থেকে তো এ পর্যন্ত অনুমোদনই পাইনি। তখন সুব্রত বড়ুয়ার ট্রেনের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। বললাম, আমিও একাধিকবার আপনার কাছে জানতে চেয়েছি, বলেছি, আপনি কিছু বলেননি। তখন লক্ষ করলাম, তিনি থরথর করে কাঁপছেন। তিনি বললেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমি ঘোষণা দিয়ে দেব যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে স্মৃতি ১৯৭১ বের হবে। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, পরদিন ১৪ ডিসেম্বর তিনি সেই ঘোষণাটিও দিলেন না। পাঠকেরা লক্ষ করে থাকবেন যে সপ্তম খণ্ডটি ১৪ ডিসেম্বর বের না হয়ে পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৩টি খণ্ডে যে তিন শতাধিক লেখা ছাপা হয়েছে, তার ভেতর থেকে যে তথ্যগুলো উঠে এসেছে, বোঝাই যায় যে অনেক লেখাই রক্ত দিয়ে লেখা। সমস্ত অনুভূতি এত অকৃত্রিম যে এর ভেতরে কোনো প্রকার সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। অর্থাত্ বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু সম্পর্কিত যে তথ্যাদি, এটা থেকে কিন্তু ইতিহাসের অনেক উপাদান উঠে আসে। অনেক ক্ষেত্রে কারা হত্যা করেছে, কোথায়, কোন সময়, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে—এগুলো তো ইতিহাসের উপাদান বটেই, সেগুলো আমাদের ইতিহাসের জন্য খুব বড় আকর। এখনো অনেক বুদ্ধিজীবীর কথা আমরা জানি না। আমার মনে আছে, স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ সরকার শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিত্সক প্রমুখের নিয়ে প্রায় ৬৩৯ জনের তালিকা তৈরি করেছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থে এ তথ্যটি আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছি, ২০০০-এরও বেশি বুদ্ধিজীবী একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন।

একটা সময় প্রশ্ন এল, বুদ্ধিজীবী কারা? কাদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলব। বাংলা একাডেমী এ নিয়ে যে কমিটি করে, তার সভাপতি ছিলেন কবি আবুল হোসেন। সদস্য ছিলেন সানাউল হক, ফারুক আজিজ খান, শামসুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেন ও আমি। সেখানেই সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়, বুদ্ধিজীবী হিসেবে কারা বিবেচিত হবেন। এই শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিত্সক, আইনজীবী, সমাজসেবী, অর্থাত্ যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন, তাঁদেরই বুদ্ধিজীবী বলা হবে।

স্মৃতি ১৯৭১-এ কাজ করতে গিয়ে তার দু-একটি উদাহরণের কথা বলতে গিয়ে আমার বুকটা ফেটে যায়। যেমন, চট্টগ্রাম পোর্ট কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. শামসুজ্জামানের মেয়ে সালমা চৌধুরী বলেছিলেন—ভাই, আমি তো কোনো দিন লিখিনি। তাঁকেও বলেছিলাম, আমি তো আপনার কাছ থেকে গল্প-উপন্যাস চাইছি না। তিনি একটি দীর্ঘ লেখা দিলেন, তার ভেতর একটা জায়গায় আছে, দুপুরবেলা তাঁর বাবা একটা নির্দিষ্ট সময়ে খেতে আসতেন। সেদিন তিনি আসছেন না। একটু পরপরই তিনি বলছেন, আব্বার তো আসার কথা। তিনি তো এখনো আসছেন না। বাবা রওনা দিয়েছেন কি? কোনো রকম অতিশয়োক্তি নেই, বিশেষণের ব্যবহার নেই, উক্তিতে বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু বোঝাই যায় যে বাবা যে আসছেন না, সেটা বলতে তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। এটা আমি সত্যি সত্যি অনুভব করেছি।

আলমগীর নামে এক বৈমানিক শহীদ হয়েছিলেন। দেয়ালে টানানো তাঁর যে ছবি ছিল, তাঁর ছেলেকে জিজ্ঞেস করলে বলত, আমার বাবা দেয়ালে টানানো ছবির মতো। কী যে বুক ফাঁকা একটি কথা! কেউ কেউ ওই বাবার রক্তমাখা জামা, লুঙ্গি, সম্বল করেই বেঁচে আছেন। তাঁরা জানেন যে এটাই তাঁর বাবা। এসব স্মৃতিহীন স্মৃতির মতো মর্মান্তিক আর কী হতে পারে?

বুদ্ধিজীবীদের মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যায়। অজস্র উপাদান এখনও সঞ্চিত আছে, সেটা নিয়ে যদি কেউ কাজ করেন, তবে তা ইতিহাসে বড় সংযোজন হবে।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত