আমার জন্ম ১৯৭৬ সালে। নিজের চোখে আমি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমার ধারণা, আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মেছি, মুক্তিযুদ্ধকে আবিষ্কারের জন্য আমাদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। সরাসরি দেখিনি বলেই আমাদের চোখের চশমাটি খানিকটা বিস্তৃত ও নির্মোহ। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ‘না দেখা প্রজন্ম’ হিসেবে বেড়ে উঠতে উঠতে আমরা অনেকেই বারবারই এমনটা দেখেছি যে যাঁরা নিজেদের চোখ দিয়ে কিছুটা দেখেছেন, তাঁরা শুধু নিজেদের দেখা দৃশ্যটিকেই বড় করে দেখেছেন, শুধু সেটিকেই আঁকড়ে থেকেছেন, শুধু সেই গল্পটিই বারবার বলেছেন। অন্যের দেখাকে নিজের দেখার চেয়ে ছোট করে দেখা কিংবা অগ্রাহ্য বা বাতিলের সুপ্ত বা প্রকাশ্য প্রবণতা তাঁদের থাকাটা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর যৎসামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমরা বড় হয়েছি এই দেখে দেখে যে মুক্তিযুদ্ধের লিখিত ও কথ্য ইতিহাস পরিবর্তিত হয়েছে নানা খেয়ালখুশিতে।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমার কাছে সে কারণেই অসংখ্য উৎস থেকে পাওয়া ইতিহাস, যার ভেতরে আছে নানা অস্পষ্টতা। পরের প্রজন্মের পাঠক হিসেবে এর সত্য–মিথ্যা নির্ভুলভাবে যাচাই করার উপায় আমার কাছে সে অর্থে নেই। আমাকে তাই অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয়েছে গল্প–বলিয়ের চরিত্র বিশ্লেষণের ওপর। যিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন, গল্পের বিষয়বস্তু না শুনে বারবার আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছি কঠোর কোনো পরীক্ষকের ভূমিকায়; গল্পকারের যোগ্যতা বিচারের তদন্তকারীর ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী কয়েক দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে এই অবিশ্বাস আমরা পেয়েছি অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে। আক্ষেপের বিষয়, এই প্রক্রিয়ায় গল্প–বলিয়েদের অন্ধ পক্ষপাতপূর্ণ রাজনৈতিক সাযুজ্যের ঐতিহ্যের স্রোতে, তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনভাবে হারিয়েছেন যে তাঁদের সম্পূর্ণ বয়ানে প্রজন্মগতভাবেই আমরা অনাগ্রহী ও উদাসীন হয়ে পড়েছি। কোনো ইতিহাসবিদ কী বলছেন, সেটি গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে তিনি কাদের হয়ে কথা বলছেন সে পরিচয়টি। ইতিহাসবিদের যে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য রাখার একটি দায়িত্ব আছে, নিজের পক্ষপাত স্পষ্ট রেখেও যা করা সম্ভব বলে মনে করি; বেদনার বিষয়, আমরা অনেকেই তেমনটা দেখতে পেয়েছি খুব কম।
এমন একটি অবস্থায় তাই আমরা অনেকেই আমাদের নিজস্ব সন্দেহ, প্রশ্ন ও পক্ষপাতের ছাঁকনি দিয়ে এবং গল্প–বলিয়েদের বিশ্বাসযোগ্যতার ছাঁকনির ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধকে পুনর্নির্মাণ করে নিয়েছি। তার মধ্যে সংগত কারণেই বড় বড় ফাঁক রয়ে গেছে। তবু নানাজনের স্তুতি দিয়ে সাজানো নানা সময়ের ক্ষমতাসীনের পৃষ্ঠপোষকতায় বহুল প্রচারিত জোড়াতালিমারা গল্পের চেয়ে এই অসম্পূর্ণ, সংশয়কাতর, অস্পষ্ট ও ছাড়া ছাড়া গল্পগুলোই আমাদের অনেকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। অন্ধ, গোঁড়া, পক্ষপাতদুষ্ট উত্তরদাতাদের উত্তরের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের প্রশ্নজড়ানো অনুসন্ধিৎসাকে আমরা বেশি গুরুত্বের জায়গায় রাখতে চাই।
এ রকম একটি প্রজন্মের একজন সত্যাগ্রহী উৎসুক নাগরিক ও শিল্পী হিসেবে আমার জ্যান্ত সব জিজ্ঞাসা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের পাতার চেয়েও বেশি খুঁজেছি কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে, গানে, সিনেমায়, নানা দেশি–বিদেশি প্রতিবেদনে, একাত্তরকে যাঁরা তাঁদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছেন তেমন সাধারণ মানুষের ভাষ্যে—যাঁরা তাঁদের ভাষ্য প্রচার করে কখনো কোনো সুবিধা চাননি।
এ অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে স্থির হয়েছি যে মুক্তিযুদ্ধের কোনো একটি রূপ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইলে আমিও সেই গোঁয়ার্তুমির ধারাবাহিকতাকেই পুষ্ট করব, যাঁরা সমান্তরাল আর সব ভাষ্যকে অগ্রাহ্য করে কেবল তাঁর নিজের গল্পটিকেই ‘পূর্ণ ইতিহাস’ করে রাখতে চান। খেয়াল রাখা দরকার, আমরা এমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার ভেতরে বসবাস করি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকেও একটি মুনাফার উপকরণ করার চেষ্টা চলে। মুক্তিযুদ্ধকে এই কারবারিদের কাছ থেকে নিজেদের মতো করে নেওয়ার জন্য আমাদের প্রজন্মকে অনেক কসরত শিখতে হয়েছে।
এত সব ভালো–মন্দ মিলিয়েই আমার প্রাণের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমার কাছে একটি গান, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ আপাতত এটুকু নিশ্চিত জানি, আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ভৌগোলিক স্বাধীনতা, একটি পতাকা, একটি নাম, একটি পরিচয়, মানচিত্রে একটি আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি আমরা নিশ্চয়ই পেয়েছি। এ জন্য কৃতজ্ঞতা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সব কুশীলবের কাছে—যাঁদের কাউকে আমরা চিনি, আবার অধিকাংশকেই চিনি না, তাঁদের কেউ কেউ প্রচারের আলোয় আসতে পেরেছেন, অনেকেই পারেননি।
সেই ফুলকে বাঁচিয়ে রাখার যাত্রা বা সেই বৃহত্তর মুক্তির যুদ্ধ নিশ্চয়ই এখনো চলমান। আমরা দেখেছি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে নিদারুণ অবহেলায় ও দারিদ্র্যে ক্ষয়ে যেতে। আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধে না গিয়েও কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেয়ালে সনদ ঝুলিয়ে বানানো গর্বে বুঁদ হয়ে থাকতে। আমরা দেখেছি, একদিন যিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন মৃত্যুর সব আশঙ্কা বরণ করে নিয়ে, তেমন কাউকে কাউকে স্বাধীনতার পরে লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। আমাদের কাছে এসব গল্পের মিশ্রণ এক দৃশ্যমান বাস্তবতা।
যুদ্ধের বিনিময়ে পাওয়া এই ফুলটির একটি পাপড়িও যদি মুমূর্ষু থাকে, আমাদের আনন্দ কীভাবে পূর্ণ হতে পারে? যেদিন আমার স্বাধীন বাংলাদেশের সব কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ নাগরিক খেয়ে–পরে প্রাণ থেকে বলবেন, ‘আমরা ভালো আছি’; সেদিন যুদ্ধের বিনিময়ে পাওয়া এই ফুলটির সৌন্দর্য ও ঘ্রাণ পূর্ণতা পাবে।
সায়ান সংগীতশিল্পী
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত