বিজ্ঞাপন
default-image

সাতাশ নম্বর ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে ছিল নীলুফার জাহানের ‘অন্য ছন্দ’ প্রদর্শনীর প্রেস কনফারেন্স। শিল্পসঞ্চালক বন্ধু সুবীর নীলুফারের সঙ্গে আমাকেও বসিয়ে দিলেন ওর কাজ নিয়ে কথা বলার জন্য। অনাবাসী কবি-লেখকদের বন্ধুবান্ধবের জন্য এমন সুযোগ মিলে যায়। আর তাতে বর্তে গিয়ে আমি এত কথা বলতে শুরু করেছিলাম যে আমার আবেগবদ্ধ বাচালতার জন্যই বোধকরি তরুণ সাংবাদিকেরা বেশ আগ্রহান্বিত হয়ে উঠল। কনফারেন্স শেষে বেঙ্গলের হেলদি নিরামিষ আর চিনিগুঁড়ো ভাতের সঙ্গে একটু একটু করে মিষ্টি দই মুখে দিতে দিতে তাদের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিতে থাকি।

দীর্ঘদিন বিলেতে বসবাস বলে জনকণ্ঠের সাইফুর ছাড়া এসব তরুণ সাংবাদিকের কাউকেই চিনি না। একজন তরুণী চিত্রসাংবাদিককে দেখে মনে হলো তার দেহের ওজনের চেয়ে ক্যামেরার ওজনই বেশি। ব্যাক ব্রাশ আর রাবার ব্যান্ডে বাঁধা টানাচুলের একজন সুদর্শন তরুণ হেসে হাত বাড়িয়ে এসে বলেন, আমি সাগর লোহানী। এ কণ্ঠস্বর ও আচারের সঙ্গে কার যেন মিল! সে এক মুহূর্ত মাত্র। আমি উচ্চকিত স্বরে বলে উঠলাম, আপনি কামাল লোহানীর কেউ নন তো?

যুবক স্মিত হেসে বলেন, তিনি আমার বাবা। এ কথা শোনার পর গেল আমার রসিয়ে খাওয়া আর অন্যদের সঙ্গে কথা বলা। স্বভাবের তারল্যে এবার ওদের হারিয়ে আমি তাকে জোর করে পাশে বসিয়ে আমার একটি গল্প শুনিয়ে ছাড়লাম। বেচারা!

২.

গল্পটি একটি আগল খোলা গ্রেনেড আর কয়েকটি বন্দুকবিহীন বুলেটের। এর সবই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আমার কাছে রয়ে গেছিল। যুদ্ধের পরপর যখন অস্ত্রশস্ত্র মহাসমারোহে জমা দেওয়ার পালা শুরু হয়েছে, টিভিতে দেখছি আর ভাবছি আমার কাছেও তো যত্সামান্য কিছু আছে। বন্দুকবিহীন গোলা আর ডেটনেটর খোলা গ্রেনেড। সত্যিই যত্সামান্য। এগুলো আবার ঘটা করে জমা দেওয়ার বিষয় হলো? কলোনির পাশের ডোবায় ফেলে দিলেই হলো। তাই দিলাম। কিন্তু প্রাণ ধরে সবটা পারলাম না। তাবিজ খসে গেলেও তা রয়ে গেল তাগার মতো।

অধিকার ও বিজয়ের অনুভূতি এমন এক ব্যাপার, সে আয়াস বা অনায়াসে হোক আয়ত্তে এলে আমি তো একটা কুটো, কোনো বড় মানুষও তা ছাড়তে চায় না। দু-তিনটা গুলি গলার লকেট করব বলে (কোনো ধারণা ছিল না—এ দিয়ে গয়না হয় কি না। বানাতে গেলে তা ফুটে কারুকার অক্কা পেতে পারে কিনা) ব্যাগে রেখে দিলাম। গ্রেনেডগুলোকে করলাম অন্তঃসারবিহীন। ক্ষমতা হরণ করে নিরীহ মাটির ঢেলার মতো শুইয়ে দিলাম সুটকেসে, সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিলি করা জেরক্স ইশতেহারগুলোর সঙ্গে। পাশে রাখলাম সোনালি সরু ধাতব, এর ভেতর থেকে খাপখোলা গোলাপি লিপস্টিকের মতো বাকি দু-তিনটি বুলেট। রাখলাম খাটের নিচে ছোট্ট সুটকেসে—ঢাকাই বিটি আর তাঁতের শাড়ির সঙ্গে পুরোনো পারফিউমের বোতলের সঙ্গে গয়নার মতো। গয়নার যেমন বস্তুমূল্যের অতিরেক থাকে তার উেসর ইতিহাসের মূল্য, ভাবাবেগের সম্মান—আমারও তা-ই।

যুদ্ধের সময় ওপার থেকে আমাদের ‘পারাপার’ নাট্যগোষ্ঠীর বাবু (চিত্রগ্রাহক আহসান নেওয়াজ, প্রয়াত) আর জনের দেওয়া সেসব প্রচারপত্রে থাকত পাকবাহিনীকে সহায়তা না করার আহ্বানসহ উদ্দীপক লেখা ও যুদ্ধের তথ্য। আমি আর বাবলী (তত্কালীন ললনাখ্যাত বাবলী হক) সেসব বিলাতাম নানা অজুহাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধিকৃত পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা স্টেশনসহ টিএসসি, রোকেয়া হল, আর্ট কলেজ এসব স্থানে। রেডিওতে অনুষ্ঠান করব বলে ঢুকে পাক স্টাফদের সহায়তাকারী বাঙালিদের নামের লিস্ট নিয়ে একদিন বেরুনোর সময় গেট হাউসে দুই পাকিস্তানি সেনা আমাদের লাইনে দাঁড় করাল ব্যাগ দেখবে বলে। ওরা নির্ঘাত বাংলা পড়তে পারত না—কিন্তু আমাদের ভয় হলো ডিউটি অফিসারের রুম থেকে চুরি করা ইংরেজিতে ছাপানো আর্টিস্ট লিস্ট এবং প্রচারপত্রে স্বাধীন বাংলার পতাকার ছবি।

পুরোনো ঢাকায় উর্দু রোডে বড় হওয়া বাবলী দু-একটা উর্দু কথা পারত। কিন্তু নার্ভাসনেসে ওই লাইনেই দাঁড়ানো অবস্থায় পা ঘষে ঘষে কী করে যে ছিঁড়ে ফেলল তার নতুন স্যান্ডেলের ফিতে, সে বোধকরি নিজেও বোঝেনি। আমাদের চেকিংয়ের ঘরে নেওয়ার আগে সে প্রায় তেল মাখানো বাঁশের মতো দুই পা সামনে যায় তো একপা পিছিয়ে জুতোর ফিতা টানে। আমি আতঙ্কে শুরু করলাম এক অদ্ভুত হাসি। যেন মহা এক কমেডি হচ্ছে। আমাদের সে হাসি ও অতিকথনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওরা ব্যাগ না চেক করেই বলে, ‘আচ্ছা আচ্ছা আবলোগ বাহার চলিয়ে’। বেরিয়ে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে দে দৌড় এবং উড়ন্ত সসারের মতো চলমান একটি রিকশায় গেঁথে সোজা রোকেয়া হলের ভেতরে। শিরীষ গাছের নিচে, তারপর আধঘণ্টা কী বিপুল হাসাহাসি!

এ সময় বাড়িতে আমার কাজ ছিল প্রতিদিন তেলহীন মসলাহীন কেবল পাঁচফোড়নে বিশাল মিষ্টি কুমড়ো কেটে ভাজি করা আর আশ্রিতসহ আমাদের জন্য অর্ধশতাধিক আটার রুটি বেলা। রুটি বেলতে বেলতে আমার হাতের মাসলই টোন্ড হয়ে ব্লাউজের হাতা টাইট হয়ে গেল সত্যি! সে সময় শুক্রাবাদে, সোবহানবাগের ফ্ল্যাটে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে হঠাত্ ফুলকির মতো উদয় হয়ে প্রয়োজনীয় খবর দিতে আসত সে (যাকে ষোলই ডিসেম্বরে শেষ দেখেছিলাম বন্দুক হাতে বিজয়ের আনন্দে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এসেছিল) দেখা করতে। দরজা খুলতেই পা ছুঁয়ে টুক করে আমাকে সালাম! আমার মতো একটি তরুণীকে দিদির মর্যাদা দিয়ে স্বাধীনতার মতো এত বড় অর্জনে সালাম করছে! এ যে কী বড় ঘটনা একটা। আমার উপলব্ধির আহার পেটে পড়ার আগেই সে আবারও বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই যে গেল আর তাকে পাইনি। তারপর অনেক খুঁজেছি। আশ্চর্য, আজ তার নামও মনে করতে পারছি না। এখনো খুঁজি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া অনুজপ্রতিম ভাইটিকে! তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার সময় খিদে নেই বললেও প্রায়ই জোর করে খাইয়ে দিতাম। আর সে কিনা কবারই ওই বিস্বাদ কুমড়োর ভাজি খাওয়ালে পর ডান গালে টোল ফেলে ফরসা মুখে মহাতৃপ্তির হাসি জাগিয়ে বলত, ‘মজা হয়েছে—আপা এবার যাই।’

এখনকার পিজি হাসপাতাল তখন ছিল শাহবাগ হোটেল। এর যে দিকটা এয়ারপোর্ট রোডের দিকে তাকিয়ে আছে, সেই কোনার উল্টো পাড়ে ছিল বাংলাদেশ রেডিও ঢাকার ট্রান্সমিশন কেন্দ্র ও অফিস।

দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র তিন মাস। তখনো সাপটে ধরে আছি সেই নয় মাসের অসম্ভব সময়গুলো। এমনই হওয়ার কথা! যুদ্ধাহততে ভরা হলিফ্যামিলিসহ অন্যান্য হাসপাতাল। ডাক্তারের অপ্রতুলতা তো আছেই, আরও আছে নার্সেরও। আমি আর বাবলী হলিক্রস হাসপাতালে স্বেচ্ছা সেবা করতে গিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা আহত বীরের প্রায় প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম। অন্যান্য রুমের বেডগুলো সেরে ওর কাছে গিয়ে শুনতাম যুদ্ধের গল্প।

লম্বা পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন কামাল ভাই (লোহানী) তখন হাল ধরেছেন রেডিওর। তখন আমরা কয়জন যারা নয় মাস আগে স্টুডেন্টস ফোরাম ও অন্যান্য অনুষ্ঠান করতাম তারা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রেডিও স্টেশন গড়ার জন্য ‘যখন যা লাগে’ ভিত্তিতে কাজে লেগে গিয়েছিলাম। ঘোষণা, নাটক, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, কোরাসে গান গাওয়া থেকে শুরু করে নেট-ওয়ার্কিং সবই করছি বিনা পারিশ্রমিকে। দরকারে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী আর রাশিদুল হাসানকে নিয়ে সাহিত্যের অনুষ্ঠান করছি। সে যে কী তুমুল আনন্দ!

এরই মধ্যে আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো ২৩ এপ্রিল। এক বিলেত-ফেরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। ফেব্রুয়ারিতে চোখে দেখেছি, কিন্তু বাসায় কোনো টেলিফোন নেই, তাতে সে ঠেকে থাকল না। পাশের বাসার ফোনে আমাকে ডেকে ডেকে এমন একটি আনরোমান্টিক নামের লোকটি চাটগাঁ থেকে বিলেতি হিউমারের বাঁশি বাজিয়ে আমার কাছে রোমান্টিক হয়ে উঠতে শুরু করল। তাকে ফোন করতে কী আমার যে প্রবল ইচ্ছা!

ভাবলাম রেডিও প্রোগ্রামের জন্য পিপি মোজাক্কের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করব। আর সেই সুযোগে ওর পারমিশন নিয়ে তার রুম থেকে আজাদকে একটা ফোন করব। নম্বর দিলে সে-ই আমাকে পাল্টা ফোন করতে পারবে। আমাদের বিয়ের কথা রেডিওর সবাই জানেন। হেমায়েত ভাই (হেমায়েত আহমেদ), সুফিয়া (খানম) আপা, (আশরাফুল) আলম ভাই—সবাই ভালোবাসেন আমাদের দলটাকে। নার্সিংয়ের শিফট থাকত সকালে আর দুপুরে থাকত রেডিওর কাজ। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হওয়ায় আম্মা আমার শিফট বাদ দিয়ে শুধু রেডিও ও বিশ্ববিদ্যালয়—এ দুটোতে গেঁথে দিলেন নিশানা। তবু বেরোনোর আগে উষ্মা ঝরান—‘সিলেটর নিয়ম, বিয়া ঠিক অইলে কন্যা গরর বাইরে পারা দিত না।’ আব্বার কথার ছাতা মাথায়, ‘আহা যাউক্না কয়টা দিন ওউত্ত’—আমি বেরিয়ে পড়ি। বেরোনোর সময় বড় বোন শিরিনের প্রশ্রয়-ঝিলিকে ব্যাগে ভরে নিই আজাদের ফোন নম্বর।

সে সময় আমার বড় বোন, বুজান তার যমজ ও দুর্দান্ত দুটো আড়াই বছরের ছেলে নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকত—দুলাভাই তখন লন্ডনে। আমার বিয়েটা হলেই ওরা চলে যাবে। বুজান অনেকটা কাবুলিওয়ালার মিনির মা। যার সর্বক্ষণই মনে হয়, ‘পৃথিবীর অকাণ্ডগুলো তাহাকে কেন্দ্র করিয়া ধাবিত হইতেছে।’ সারাটা যুদ্ধের সময় এমনই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল যে তার প্রভাবে তার শিশুরা এমন এয়ার রেইড প্রিকোশন ট্রেইন্ড হয়েছিল যে তখনো সোবহানবাগের পাশের মিরপুর সড়ক থেকে আচমকা কোনো গাড়ির বড় ভেঁপু শুনলে, ‘কাইরন, কাইরন ( সাইরেন)’ বলে দৌড়ে গিয়ে ওষুধের বাক্স থেকে কানে তুলো গুঁজে দিয়ে বোমার শব্দের জন্য অপেক্ষা করত।

রিকশায় উঠতেই মনে হলো এপ্রিলের হাওয়ার জাল নকশি শামিয়ানা দোলাচ্ছে আমার মাথার ওপর—পরেছি গোলাপি পাড়ের সাদা ঢাকাই শাড়ি। পিঠে মেহেদি সুবাসিত ভেজা চুল। আমাকে ফরসা বিয়ের কনে বানানোর জন্য তখন প্রতিদিনই যে কাঁচা হলুদ আর মধু গায়ে ঘষা হচ্ছে। গন্ধ ভুর ভুর করে মনে হয় যেন চড়েছি পুষ্পকরথে প্রিয়ের সঙ্গে কথা বলব বলে। এতে খেয়ালই থাকে না কখন ফেলে যাচ্ছি ডান দিকে রেডিও স্টেশন। চিত্কার করে উঠে অতি বৃদ্ধ রিকশাচালককে বলি, ‘থামেন থামেন’। রিকশাঅলার উদোম পিঠে ঘাম শুকিয়ে যাওয়া মানচিত্রের নুনে দিই দ্বিধান্বিত হাত। আমার ঠান্ডা হাত পিঠে লাগতেই তিনি এমন ব্রেক দিলেন যে সেখানটাতেই রিকশা গেল উল্টে আর তা থেকে উগড়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম আমি। শাড়ি ছিঁড়ে গেল, হাঁটু ছড়ে গেল। ব্যাগের ভেতরের সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে গেল শুকনো নর্দমায় ও রাস্তায়। আমার বুড়ো রিকশাঅলা একদিকে কাত হয়ে কঁকাতে শুরু করলে লোকজন তাকেই বকতে লাগল—কেমনে চালাও মিঞা? কে একজন আমার হাতে শূন্য ব্যাগটা দিল। শুকনো ড্রেন ও রাস্তার বালি থেকে একে একে উঠে আসতে লাগল লিপস্টিক, রুমাল, খুচরো পয়সার ব্যাগ। আমি টলতে টলতে ড্রেনের পাড় থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তার সরু আইল্যান্ড পেরিয়ে কোনোমতে ওপারে রেডিওর গেট হাউসের দিকে হাঁটতে থাকলাম।

ঘটনার আকস্মিকতায় পনেরো-কুড়ি মিনিট কিছুই ভাবতে পারিনি। গেট হাউসে কেউ চেনা নেই পুলিশ ছাড়া। তারই এক গম্ভীরমুখো সার্জন এসে বলল, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?’

—রেডিওতে।

—আপনার ব্যাগের জিনিস আমাদের কাছে কিন্তু দেওয়া যাবে না। আপনি আন্ডার অ্যারেস্ট!

—মানে?-

—সেখানে বুলেট পাওয়া গেছে।

তার শীতল কঠিন স্বরে বুঝে গেছি দুর্ঘটনার আবহাওয়া। আমি বলেছি রেডিওতে আসছিলাম, তবে সঙ্গে ব্যাগে গুলি কেন? নার্ভাস হয়ে সাতে সতেরো বলে আরও গোল পাকিয়ে ফেলি। তাতে সার্জন কড়া আদেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসেন’। জনগণের শব্দ শুনি—আমাকে কেন্দ্র করে রেডিওর ছোট্ট গেটের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়া মাঝারি সাইজের জনতাকে উদ্দেশ করে আবার আরেকটি আদেশ দেন। ‘আপনারা চলে যান। এখানে তামাশা দেখার কিছু নাই।’ কেউ শোনে বলে মনে হয় না। একটি উনিশ-কুড়ি বছরের যুবতী মেয়ে রিকশা থেকে শাহবাগের সামনে পড়ে যাওয়ার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আটকেছে—মাত্র তিন মাস আগে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের রাজধানীতে এটা একটা ইন্টারেস্টিং খবর। কাজেই ভিড় বাড়তেই থাকে। কে একজন চিত্কার করে তার বন্ধুকে ডাকে, ‘দেখে যা, একটা মেয়ে ধরা পড়েছে।’

তবু জনতা থেকে পুলিশের হাতে পড়ায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে রেডিও বাংলাদেশের গেট হাউসে স্টিলের চেয়ারে বসে এই প্রথম তাকাই নিজের দিকে। আমি কাঁপছি। মুখের কি অবস্থা? রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার পর পনেরো মিনিটে যা যা ঘটে গেছে তার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমনকি এখনো ঘটনা আমার হাতে নেই ভাবতেই প্রথমে আমার যে আশঙ্কা হয়েছিল, তা এত বছর পর বলতে যথেষ্ট সংকোচ হচ্ছে। ‘আমার বিয়েটা ভেঙে যাবে না তো?’ আর কী হতে পারে? উঠতি কবি শামীম তরফদারের কৌতুককর পুলিশি জেরা হিসেবে আমার ছবি পত্রিকায় উঠতে পারে। আমি হাজতে যেতে পারি। আমাকে ছাড়াতে আব্বাকে অসুস্থ শরীরে পাগল হয়ে ছুটতে হবে।

হায় হায় এই গাড়লদের কাছে কী করে প্রমাণ করি এ বুলেট দলছুট। ভুলে রয়ে গেছে ব্যাগে। মাই গড্, তা বলা যাবে না, তাহলে ভ্যান নিয়ে ছুটবে বাসায়। লোকে বলে পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর আমি কিনা নিজের ইচ্ছায় পুলিশের পেখমে পা দিয়েছি।

হঠাত্ সামনে পড়া এক পিয়ন ভাইকে কাতরভাবে বলি, ভেতরে যাকে পারেন খবর দেন। রেডিওর গেট হাউসের টয়লেটে ঢুকে পাই জিপারের ভেতর চুপচাপ শুয়ে থাকা আরেকটি বুলেট। এটাকে সেই মল গন্ধময় নিষ্কাশন পথে ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বেরুই। পুলিশরা আমাকে দেখতে থাকে মহা মজায়। ততক্ষণে রেডিওর বড় কর্তা সাংবাদিক কামাল লোহানী পর্যন্ত খবর চলে গেছে। হঠাত্ দেখি তারাই কজন সদলবলে গেটে। গেটপুলিশকে আশ্বস্ত করে কামাল ভাইয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিয়ে আমাকে বসালে ঘামতে ঘামতে কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বলি। তারা হাসির হুল্লোড় তোলেন, ‘শামীম বলো তোমার বরের নম্বর। আমরা কথা বলি! কারণ আমরা যে তোমার হয়ে একটি মুচলেখা তৈরি করব ভাবছি পুলিশের জন্য, ওটা তাকে দিয়ে লেখাই, কি বলো?’ আমি হাসি না। আমি নিশ্চিন্ত হই না।

ভাবি বাবলীকে বলব ফোন করে বলি বাড়ির সুটকেস খালি করতে। কিন্তু সে তো তখন তার শ্বশুড়বাড়ি। অগত্যা আমার আতঙ্কগ্রস্ত বোনকে পাশের বাড়ির ফোনে বলি, বলি সংক্ষেপে। বলি আমার যুদ্ধের স্মৃতি-সম্পদ সোবহানবাগের সামনের ডোবায় ফেলে দিতে। আমি বাড়ি আসার আগেই। বলা তো যায় না, আমি এখানে থাকতেই পুলিশ যদি বাড়ি রেইড করে! সে ভীত ও অস্থির হয়ে কীসব বলতে থাকে—আমি লাইন কেটে দিই। ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ির স্থানে, ছড়ে যাওয়া হাঁটুতে হাত বোলাই।

কফি খেয়ে পুরো ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে চিঠিতে সই করলাম আর আমার দায়িত্ব নিলেন ওরা চারজন। এবার একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াতেই সুফিয়া আপা (খানম) ধমকে ওঠেন, কোথায় যাচ্ছ আবার একা? চলুন আমরা বিয়ের কনেকে অফিসের জিপে করে পৌঁছে দিই। সঙ্গে গেলেন জালাল ভাই (উদ্দিন রুমী) ও মোজাক্কের ভাই।

সবাইসহ সোবহানবাগের দোতলায় উঠে কলবেল টিপতেই ভেতরে ছোটাছুটি বুঝে অবাক হয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ পর বুজান দরজা খুলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে, ‘ও আপনারা। আমি জিপ দেখে ভাবলাম পুলিশ।’

ততক্ষণে ওর দুই যমজ ছেলে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কানে গোঁজা তুলো।

ওরা বেরিয়ে গেলে আম্মা আবার আব্বাকে বলেন, ‘এর লাগি উ কইন বিয়ার কন্যারে গর তনে বারইতে দেইন না। শামীমরে অখন বান্দা লাগব, নাইলে তাইর বিয়া অইতো নায়।’

৩.

না আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে বিয়ে ভাঙেনি। পত্রিকাতেও ওঠেনি। আজ সে কাহিনী উঠল।

লন্ডন

[email protected]