বিজ্ঞাপন
default-image

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমাকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হতে অনুরোধ করায় আমি অবাক হয়েছিলাম। আইন-আদালত থেকে আমরা দূরে থাকতে ভালোবাসি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি বিশেষ আদালত। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে আরও অনেকের মতো আমি লেখালেখি করেছি বটে, কিন্তু ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার কোনো বাসনা ছিল না। সুতরাং, হঠাত্ এ অনুরোধে বিস্মিত হই। ‘কিন্তু কেন আমি?’ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই হয়। প্রসিকিউটর জেয়াদ-আল মালুম জানালেন, এ বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এ সাক্ষ্য নীতিনির্ধারক ধরনের বক্তব্য। সুতরাং, ইতিহাসের একজন চর্চাকারী হিসেবে আমার থাকাটাই বাঞ্ছনীয়; কেননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমি ঘাঁটাঘাঁটি করেছি।

আমাদের পরিবার-পরিজন ও সুহূদেরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইলেও চান না যে আমরা এর সঙ্গে জড়িত থাকি। তাঁদের ভাষ্য একটিই, জামায়াত সম্পর্কে যাঁর অভিজ্ঞতা আছে, তাঁর উচিত এসব থেকে দূরে থাকা।

গত প্রায় চার দশক কোনো না কোনোভাবে আমি যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত; গত দুই দশক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে। এ বিষয়ে গত দুই দশক নিরন্তর লেখালেখি করেছি। আজ যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, তা এই আন্দোলনের ফল। গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধের প্রতীক। স্বাধীনতাবিরোধিতার প্রতীক। সুতরাং, আমাকে যদি প্রথম সাক্ষী হিসেবে মনোনীত করা হয়, তা হলে সাক্ষ্য দিতে যাওয়া আমার কর্তব্য। শুধু তা-ই নয়, এটি আমার জন্য সম্মানেরও। মানুষের জীবন আর কতটুকু? শ্রেষ্ঠ সময় তো পেরিয়েই এসেছি। পেশাগত জীবনে একটি বিষয়ে সব সময় লক্ষ রেখেছি, যাতে কখনো কর্তব্যচ্যুত না হই। এক নম্বর সাক্ষী হতে রাজি হলাম।

সাক্ষী হতে রাজি হলেও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি ছিল। ক্ষণ-তারিখ ঘটনা অনেক সময় মনে থাকে না। আর গোলমেলে সাক্ষ্য দিলে মামলার ক্ষতিও হতে পারে। তখন সব তিরস্কার আমার প্রাপ্য হবে।

প্রথম দিন আদালতে গিয়ে এসব সংশয় কেটে গেল। ছোট একটি কক্ষ। দর্শকদের পেছন দিকে খাঁচার মতো কাঠগড়ায় গোলাম আযম। তার সামনে একটি কম্পিউটার। আমি গোলাম আযমকে কখনো সামনাসামনি দেখিনি। ইচ্ছাও হয়নি। প্রথম তাঁকে দেখে মনে হলো, এত মানুষের হত্যা, এত নারীর ধর্ষণের সঙ্গে যে লোকটি জড়িত, তিনি এত দিন কীভাবে সুস্থ জীবন যাপন করেছেন? আজীবন ক্ষমতালোভী মানুষটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কখনো পুরোপুরি পাননি, কিন্তু সে আকাঙ্ক্ষা এখনো রয়ে গেছে। এ ধরনের মানুষ অবলোকন করা একটি অভিজ্ঞতাও বটে।

প্রথম দিন কেটেছে আমার জবানবন্দি দিতে। এই জবানবন্দি আমি আমার মতো করে দিয়েছি। শুনেছি, এ ধরনের সাক্ষ্যের আগে সাক্ষীদের অনেক কিছু পড়িয়ে-শিখিয়ে দেওয়া হয়। আমার বেলায় তার কিছুই ঘটেনি। আমি স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করিনি। আমার সাক্ষ্য ছিল মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই—জামায়াতে ইসলামী কেন একটি যুদ্ধাপরাধের দল, এর কুশীলবরা কীভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন?

পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতার জন্য্রগঠিত হয়েছিল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী এবং শান্তি কমিটি। এই প্রতিটি বাহিনী ও কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল জামায়াতের ক্যাডাররা। তত্কালীন ছাত্র সংঘ রূপান্তরিত হয়েছিল আলবদরে। সুতরাং, তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখতে গেলে জামায়াত ও তার অঙ্গসংগঠনের সব সদস্য যুদ্ধাপরাধী এবং জামায়াতের নীতিনির্ধারক এবং তার প্রধান হিসেবে গোলাম আযমের ওপর সবকিছুর দায় বর্তায়, যাকে কমান্ড রেসপনসিবিলিটি অভিধাও দেওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধ, অবরুদ্ধ বাংলাদেশ, জামায়াতের নির্মমতা বর্ণনা করার সময় ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলো সামনে ছিল। একসময় প্রচণ্ড ক্রোধে মনে হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধ করে তারা এখনো কীভাবে বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এরা ক্ষমতায় গিয়েছে এবং আমাদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তখন যেমন, এখনো তারা একইভাবে ইসলামের নামে সব রকমের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।

এই জবানবন্দি দিতে হয়েছে হেসেখেলে। জবানবন্দি একই সঙ্গে কম্পিউটারে টাইপ করা হচ্ছিল। অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে তা সময় নিচ্ছিল। ফলে, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল মাঝেমধ্যে। আদালতে এ সময় আমি কোনো রকম অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হইনি। সাক্ষীর কাঠগড়াটা ছিল উঁচু। সেখানে আমার মতো ছোটখাটো লোক দাঁড়িয়ে বললেও কিছু দেখা যায় না। মনে হয় খাঁচায় বন্দী। বিচারক, প্রসিকিউশন, ডিফেন্স সব সময় অনুরোধ করেছেন আমাকে বসে বলতে। পরে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে বিচারকদের সামনে, নিচে চেয়ার পেতে দিয়েছেন আমাকে বসে বলার জন্য। জেরার সময়ও এ ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। এটি ছিল সম্মিলিতভাবে ট্রাইব্যুনালের সৌজন্য প্রকাশের ধরন।

আমার জেরা চলেছে প্রায় তিন দিন। জেরার সময়ই অনুধাবন করি, কেন বিচারকাজে এত সময় লাগছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ধরনটা নতুন। আমাদের বিচারক ও আইনজীবীরা এর ধরনের সঙ্গে পরিচিত নন। ফৌজদারি মামলার সঙ্গে অনেক সময় তাঁরা বিষয়টিকে এক করে ফেলছেন। কিন্তু সাক্ষ্য, আইন—এই দুই আদালতের সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন, একপর্যায়ে আসামিপক্ষের উকিল অভিযোগ জানিয়ে বললেন, ‘অধ্যাপক মামুন আমার প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি বাড়তি কথা বলছেন। সুতরাং, তাঁকে বাড়তি প্রশ্ন করতে হবে।’ বিচারকও তাতে সায় দিলেন। আমি বললাম, এটি ফৌজদারি মামলা নয় যে আমাকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে হবে।

আমি পলিসি স্টেটমেন্ট করতে এসেছি। আসামিপক্ষের উকিল তাঁর ইচ্ছামতো প্রশ্ন করছেন। আমি যা যথার্থ মনে করছি তা বলছি। ম্যানুয়েলে কোথাও লেখা নেই যে, তিনি যে রকম আশা করেন, সে রকম বক্তব্য দিতে হবে। আর আমি কীভাবে উত্তর দেব, আদালত তা নির্ধারণ করতে পারেন না।

এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক-বিতর্ক চলে এবং আমি আমার মতোই বক্তব্য দিই। একপর্যায়ে সব পক্ষ তা মেনে নেন। বিচারপতি নিজামুল হক সরলভাবেই বলেন, ‘বিষয়টি সবার কাছেই নতুন এবং আমরা ট্রায়াল স্যান্ড-এর মধ্যেই শিখছি।’ তাঁর এ বক্তব্য ভালো লেগেছে এ কারণে যে, তিনি বিচার পরিচালনায় আন্তরিক এবং এ কারণে সবার সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। মাঝেমধ্যে দুই পক্ষ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও তিনি স্মিতহাস্যে রসিকতা করে পরিস্থিতি শান্ত করেছেন।

আসলে গোলাম আযমের ব্যাপারে তাঁর পক্ষের উকিলদের তেমন করার কিছুই ছিল না। এটি তাঁরা জানেন না, তা নয়। গোলাম আযমের সব কর্মকাণ্ড ডকুমেন্টেড; ফলে বাড়তি সাক্ষীর দরকার নেই। আসামিপক্ষের আইনজীবী যেসব প্রশ্ন করছিলেন, আমার মনে হয়েছে, মামলার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সামান্য।

জামায়াত-বিএনপির হাইকমান্ড মনে করে, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে না। ক্ষমতায় থাকবে তারা এবং তখন বিচার বন্ধ করে দেওয়া যাবে। বিচারকেরা ‘স্বচ্ছতা’র কারণে, ‘নিরপেক্ষতা’র কারণে আসামিপক্ষের এই কৌশল মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এ প্রক্রিয়া নিয়ে ছিল ক্ষুব্ধ। ৩৯ দিন একজন আইওকে প্রশ্ন করা চলে না। আমি তৃতীয় দিনে এ নিয়ে আপত্তি তুলেছি। এই আপত্তিতে বিচারকেরা হয়তো অসন্তুষ্ট হয়েছেন, আসামিপক্ষের উকিলরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কিন্তু আমি সাক্ষী হয়েও আমার যুক্তিতে অটল থেকেছি।

একসময় বিষয়টি নিয়ে ভীষণ তর্ক-বিতর্ক হয় এবং বিচারক ঘোষণা করেন, তিনি সব পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এভাবে সাক্ষীকে জেরা চলতে পারে না। তিনি অবশ্যই আসামিপক্ষকে প্রসিকিউশন থেকে বেশি সময় দেবেন; তবে, সাক্ষ্য-বক্তব্যের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। এটি ছিল যৌক্তিক রুলিং। এবং এই রুলিংয়ের ফলে আজ বিচারকাজের প্রক্রিয়া তেমন শ্লথ নয়।

জবানবন্দ্রিশেষ হওয়ার পর জেরায় আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। কারণ, প্রশ্নের ধরন দেখে মনে হয়েছে, এসব প্রশ্নের ভিত্তি ফৌজদারি আইন ও বিচার-প্রক্রিয়া, যার সঙ্গে এই আদালতের কোনো সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া এটিও অনুধাবন করেছিলাম, প্রতিপক্ষের আসলে কিছু করার নেই। সবই ডকুমেন্টেড। এখানে সন-তারিখ-দিন—এসব তেমন মুখ্য বিষয় নয়।

আমার মনে হয়েছে, আদালতের বিচারকদ্বয় সব সময় চাইছেন বিচারটি যেন সুষ্ঠু হয়। সে জন্য তাঁরা আসামিপক্ষকে যথেষ্ট সময় ও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে আমি বলেছিলাম, গোলাম আযমদের জোট যখন ক্ষমতায় ছিল এবং আমাকে মিথ্যা মামলায় জেলে নিয়েছিল, তখন কিন্তু আমাকে বিন্দুমাত্র সুযোগ-সুবিধা দেয়নি। তবে আসামিপক্ষ আমাকে প্রশ্ন করার সময় যথেষ্ট সৌজন্য দেখিয়েছে, সম্মান করেছে, যা তাদের কাছ থেকে কেউ আশা করেনি। আজ জামায়াত-বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য সহিংস আন্দোলন করছে।

বিজয়ের মাসে তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ১৯৭১ সালের বিজয়ীদের প্রতি। এতে প্রমাণিত, সুশীলেরা যাকে দুই নেত্রীর ‘ঝগড়া’ মনে করেন, আসলে তা নয়। এটি একটি আদর্শগত লড়াই। আমরা সবাই বিভিন্ন স্বার্থে জড়িত, সে কারণে আমরা অনেকেই বলি—এসব বিচার-আচার কেন? জামায়াত তো গণতান্ত্রিক দল ইত্যাদি। বর্তমান সমাজে ডান পন্থার প্রভাবটা আমরা অটুট রাখতে চাই। কিন্তু অন্তিমে তা সম্ভব হবে না।

বিএনপি-জামায়াত এই বিচার বানচালের চেষ্টা করবে, তা স্বাভাবিক। এটি আদর্শগত ও দুই দলের যুদ্ধাপরাধীরা অভিযুক্ত। তারা ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যা জেতা সম্ভব নয়। রায় তাদের পক্ষে যাবে কি যাবে না, তা জানি না। ইতিহাসে এরা খুনি, ধর্ষক বা যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই বিবেচিত হবে, বাংলাদেশের মানুষ যাদের বিচার করতে পারেনি। এই দায় শুধু সরকারেরই নয়, ১৯৭১ সালের বিজয়ীদেরও। কথাটি সবাইকে ভেবে দেখতে বলব।

১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের প্রতীক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হতে পেরে আমি আনন্দিত। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের বিচার এটিই প্রথম, যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। শেখ হাসিনার অনেক সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু এই একটি কাজের জন্য ইতিহাসে তিনি সমাদৃত হবেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে আমি যুক্ত থাকতে পেরেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি। ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে আমি জানি, বিচারে জয়-পরাজয় যা-ই হোক, আমরা ইতিহাসের পক্ষে। ইতিহাসের বিপক্ষে অন্তিমে কোনো জয় পাওয়া যায় না। এই সৌভাগ্য কয়জনের হয়?

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত