বিজ্ঞাপন
default-image

পুঠিয়া থেকে উত্তরে তাহেরপুরের দিকে দশ-বারো কিলোমিটার গিয়ে ডানদিকে খানিকটা এগোলেই দেশের সুবিস্তৃত হূদয়স্থানে পৌঁছুনো যায়, টের পাওয়া যায় তার স্তিমিত মৃদু হূত্স্পন্দন। নিশ্চিন্ত এইটুকুই যে—এখনো চলছে। এখানে একটি বড়ো সাঁওতালদের গ্রাম। নির্ভেজাল সাঁওতাল কিংবা ওরাঁও গ্রাম এখন আর বেশি মিলবে না বাংলাদেশে, ঘেরাও হয়ে যাচ্ছে সংখ্যাগুরু মানুষদের ঘর-গেরস্থালির বেষ্টনে। রাজশাহীর তানোর, নাচোল, গোদাগাড়ীর দিকে এইরকম দু-একটি গ্রাম এখনো আছে, যেখানে শুধু সাঁওতাল বা ওরাঁওদের বাস।

কিন্তু সে-সব জায়গায় দ্রুত খুন হয়ে যাচ্ছে সাঁওতালরা, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে, মেয়েরা যত্রতত্র ধর্ষিত হচ্ছে। ভিটেমাটি, জমিজমা এখনো ওদের যেটুকু আছে, ভূমিদস্যু, জমিডাকাতদের তা সহ্য হচ্ছে না। তবে গরিব বাঙালিরা তাদের উচ্ছেদ করছে না, যারা করছে তারা বড়োলোক, অনেক জমির মালিক, অঢেল জমির দখলদার। তবু যতোই থাকুক তাদের আরো চাই। সে জন্য আলফ্রেড সরেনদের মতো মাথা-উঁচু সাঁওতালদের মেরে ফেলা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর নেই।

তবে কি বিনাশ হতে চায় এক একটি জনগোষ্ঠী? তাদের রক্ত যে মাটিতে ঝরে, সেই মাটিই আবার ঝাড়ে-বংশে তাদের জন্ম দেয়। কিছুতেই তারা নিকেশ হতে চায় না। ভূমিগ্রাসীদের লোভের চোখ চকচকও করে আবার তাতে বালি পড়ে কখনো কখনো করকরও করতে থাকে। দু-চারটি নির্ভেজাল সাঁওতাল-ওঁরাও গ্রাম এ জন্যই এখনো বজায় রয়েছে। রাজশাহীর নাচোল, তানোর, নওগাঁর মহাদেবপুর, বদলগাছির মতো রাজশাহীর পুঠিয়া এলাকায় এই গ্রামটিও তেমনি একটি খাঁটি সাঁওতাল গ্রাম, নাম পশ্চিমবাগ বাঁশবাড়িয়া।

এই গাঁয়েই খুব ছোট্ট, খুব সামান্য একটি ঘটনা। আমি জানি, আমাদের এখনকার ইতিহাস এই ঘটনাকে জাতে ঠেলবে, কিছুতেই তাকে উঠতে দেবে না। তবু একদিন ইতিহাস তাকে তুলবেই। যতোদিন তা না ঘটছে, ততোদিন ইতিহাসের বর্তমানের জন্যে ঘৃণা আর দূরকালের জন্যে অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।

খুব ছোট্ট, খুব সামান্য ঘটনাটি এই: আদিবাসী শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে একটি স্মৃতিফলক স্থাপিত হচ্ছে। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি লেখার আগে বীর, মহান, সূর্য-সন্তান ইত্যাদি আর লিখছি না। এসব শব্দ এখন বড্ডো ফাঁকা আওয়াজ করে, ব্যবহার করলে আর শুনলে কৃত্রিম আবেগ চটচটে আঠার মতো দেহে-মনে যেন গ্লানির কাঁদা লেপে দেয়। তার চেয়ে বরং শুধু ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটিই অভিধানের গৌরবসূচক সমস্ত বিশেষণ একাই ধারণ করুক! কিন্তু সেটাও এখনি ঘটবে না। আপাতত একগাদা বিশেষণ ছাড়া শব্দটি আমাদের শূন্য হূদয়ের মতোই অর্থশূন্য একটা উচ্চারণ ছাড়া আর কিছু নয় তা জানি।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম লাডা হেমব্রম। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। একাত্তরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে নিজের বাড়ির সামনেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। মুক্তিযুদ্ধে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা অংশ নিয়েছিল এই সত্যটি নেহাত উল্লেখ না করলেই নয় এইভাবে কোনো কোনো বিবরণে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু নিগৃহীত, অধিকারবঞ্চিত সমাজের ও প্রান্তিক অবস্থানে থেকে-যাওয়া স্বতন্ত্র একটি নৃ-গোষ্ঠীর এই অংশগ্রহণ কতোটা মরিয়া ছিল, কতোটা বিস্তৃত ছিল, মুক্তিযোদ্ধা সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কী সম্পর্কে সম্পর্কিত ছিল, এসবের কোনো নির্ভরযোগ্য বিবরণ আমরা এখনো পাইনি। মুক্তিযুদ্ধে তারা কতোটা আমাদের কাছে এসেছিল জানি না, তবে মুক্তিযুদ্ধের পরে তাদের কতোটা অপাঙেক্তয় করে দূরে সরিয়ে রেখেছি আর ঘরবাড়ি-সহায়-সম্পদ থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে কতোটা কাছে এসে তাদের ওপর চড়াও হয়েছি, গত চৌত্রিশ বছরে তার অনপনেয় প্রমাণসহ উদাহরণ আমরা ইতিহাসে রেখেই চলেছি।

লাডা হেমব্রমের এবং সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক উন্মোচনের দিন গোটা সাঁওতাল-গ্রামটির মানুষ ভেঙে পড়েছিল। সেই কালো কালো চ্যাপ্টা-নাক, সরু-চোখ, কালো চুলের মানুষ—সবই বরাবরের মতো, কেবল স্বাস্থ্যটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত—অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে পচুইয়ের নেশা-ধরানো গন্ধে। তার সঙ্গে মিশেছে তেল আর মাটির গন্ধ। কয়েকটি এলাকা থেকে সাঁওতাল আর ওরাঁও মেয়ে-পুরুষ এসেছে নাচ-গানের জন্যে। মেয়েরা নাচে সেই চেনা ভঙ্গিতে। পরস্পরের কোমর ধরে আধা-বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে একবার এগিয়ে, একবার পিছিয়ে আসে। মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দের সঙ্গে চলতে থাকে একঘেয়ে মন্ত্রের মতো সুরে গান। মেয়েদের পরনে লালপাড়ের হলুদ শাড়ি, লাল ব্লাউজ, নাকে কানে হাতে রুপোর গয়না। ছেলেদের গা খালি, পরনে শাদা কিংবা হলুদ ধুতি।

তারা মাদল বাজায়, চড়বড় শব্দে ডুগডুগি বাজায়, হাপরের মতো হারমোনিয়াম টানে। নমুনার মতো একজন মাত্র স্বাস্থ্যবান, শালপ্রাংশুভুজ যুবক ছাড়া আর সবাই ভাঙা শরীরের ভাঙা মানুষ। চোখে কোনো আশা নেই। তবে এখনো আছে দুর্মর অত্যাজ্য সারল্য। আশ্চর্য, এখনো আছে!

ফলক উন্মোচনের সময় সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। নাচোল অঞ্চলের আর এক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা পর্দা সরিয়ে উন্মোচন করবেন এমপাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অব দি কমন পিপল-এর সাহায্যে আদিবাসীদের তৈরি করা ফলক। খুবই সাদাসিধে এই ফলক। জানি না এটি আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধ স্মারক হিসেবে প্রথম কি না? হয় তো প্রথমই। বৃত্তাকারে চার-পাঁচটি টকটকে লাল রঙের গোল স্তম্ভ বসানো, সেগুলোতে লম্বালম্বি সাদা চওড়া রেখা টানা। বৃত্তের মাঝের স্তম্ভটি আকারে একটু বড়ো, লম্বাও একটু বেশি। সাঁওতালদের লাল রঙ প্রিয়, সবুজ রঙও প্রিয় এবং অবশ্যই সাদা রঙ। ওরা খুব নির্মল জাত। সাদা রঙটা খুব পরে।

ফলক উন্মোচন হয়ে গেলে ফুল দেওয়ার জন্যে প্রথম ডাকা হলো লাডা হেমব্রমের ছেলেকে। খাটো মোটা তবে খুব ফর্সা ধুতি আর হাফশার্ট-পরা মানুষটি নেশায় একটু একটু দুলছে। ফুল দিতে গিয়ে সে বেদিতে উঠল না, উবুড় হয়ে সটান মাটিতে শুয়ে বলল, পরথমে মাটিতে পর্নাম তারপরে আমার বাবা যে মাটিতে মিশেছে তাকে পর্নাম। ওইভাবে শুয়ে শুয়েই সে হাত বাড়িয়ে ফুলগুলি এমনভাবে বেদিতে দিল যেন সেগুলি সত্যি সত্যিই তার শহীদ বাবার পায়ে পৌঁছুচ্ছে আর মাটির ধরিত্রীও সহাস্যে এই প্রণামরত সাঁওতাল প্রৌঢ়টিকে দেখছে।

এই ঘটনা চিরকালের ইতিহাসে যাবে না তো আর কিসের তাতে জায়গা হবে?

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত