যুদ্ধ শেষে কিছুদিন গত হয়। একসময় জমিলা বুঝতে শেখেন সবকিছু। যখন তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখনই বুঝতে পারলেন, এত দিন যেসব প্রশ্ন তাঁর ভেতরে প্রতিনিয়ত জেগেছে, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর কারও কাছেই নেই। এর মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, তাঁরা হলেন মুক্তিযোদ্ধা, যাঁরা পঙ্গু বা আহত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাঁরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের নিয়ে দেশ, জাতি ও সমাজের কী গর্ব আর অহংকার। তাঁর আরও মনে হয়, ‘আমি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি, তাই আমার কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমার গোপনাঙ্গে আঘাত করেছে পাকিস্তানি হায়েনারা, এ জন্যই কি লোকজন আমাকে ঘৃণা করে? এ আবার কেমন কথা? কোথায় আমাকে দেশ ও জাতি সান্ত্বনা দেবে, তা না করে আমাকে ঠেলে দেওয়া হলো অন্ধকারে!’
১৯৭১-এ কুমিল্লার লালমাইয়ের ‘ফ’ আদ্যাক্ষরের ওই মেয়েটিকে ভয়াবহভাবে অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাদের নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাত্রা এমন ছিল যে কোমরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল মেয়েটির। সেই যুদ্ধদিনের বাস্তবতায় চিকিৎসার সুযোগ তো তেমনভাবে ছিল না। আর ওঁর মা-বাবা দরিদ্র হওয়ায় যুদ্ধ–পরবর্তীকালেও তাঁর সুচিকিৎসা হয়নি। তথাপি যুদ্ধের পরে পরে ‘ফ’ আদ্যাক্ষর বা জমিলার জন্য বাস্তবতাও ছিল যথেষ্ট বিরূপ। ফলে উপযুক্ত চিকিৎসা না হওয়ায় কোমরের হাড়সংক্রান্ত যন্ত্রণা ভোগ করতেই হয়েছে তাঁকে।
ফেরা যাক আবার সেই সময়ের গল্পে। জমিলা যেহেতু যুবতী এবং চোখে পড়ার মতো সুন্দরী, তাই তাঁর বিয়ের প্রস্তাব আসে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু বিয়ে আর হয় না। এর কারণ একটাই, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর ইজ্জত হরণ করেছে, ফলে তিনি কলঙ্কিত। কলঙ্কিত মেয়ের বিয়ে এ সমাজে হয় না।
১৯৭১ সাল। চারদিকে প্রচণ্ড গরম। বিকেল না হতেই খেলায় মেতে উঠেছে একদল কিশোর-কিশোরী। দেশে যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। কিশোর-কিশোরীর খেলা দেখে কুমিল্লার সদর উপজেলার লালমাই ইউনিয়নের একটি গ্রামের ‘ফ’ আদ্যাক্ষরের মেয়েটি আর ঘরে থাকতে পারেননি। এই লেখায় আমরা তাঁকে ছদ্মনামেই সম্বোধন করব। ধরা যাক, তাঁর নাম জমিলা।
যেদিন থেকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই জমিলাকে বাড়ির সবাই সব সময় সাবধানে চোখে চোখে রাখতেন। তবে কতক্ষণই-বা আর একটা মানুষ ঘরবন্দী অবস্থায় থাকতে পারে। তার ওপর তখন তাঁর আবার কিশোরী বয়স। জমিলা বন্দী, কিন্তু তাঁর মন তো মুক্ত। তাঁর স্বপ্ন উড়ছে আকাশে-বাতাসে চঞ্চলা হয়ে। তাই নিজের অজান্তেই জমিলা বন্ধুদের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন খেলতে। তবে মেয়ে যে ঘরে নেই, বাড়ির কেউ সেটি খেয়াল করেননি। প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে ঘরে আসেন জমিলার মা। এসে দেখেন, ঘরে নেই তাঁর মেয়ে। ততক্ষণে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন জমিলার মা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাত নয়টা-দশটার সময় রক্তাক্ত-অজ্ঞান অবস্থায় ‘ফ’ আদ্যাক্ষরের সেই মেয়েটি, এখানে পরিচয় গোপন রাখার জন্য আমরা যাঁকে ডাকছি জমিলা ছদ্মনামে, তাঁকে পাওয়া যায় পুকুরের পাশে ছনের খেতে। এ ঘটনার কয়েকমাস পর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়।
দেশ এখন স্বাধীন। কিন্তু জমিলার জীবন থেকে সব আনন্দ-উল্লাস, সুখ-শান্তি চলে গিয়েছে। তাঁর মনে সারাক্ষণই একটা কথা ঘুরপাক খায়, ‘এ আমার কী হলো, কেন এমন হলো? আমার তো কোনো দোষ ছিল না। তারপরও কেন সমাজ আমার এবং আমার পরিবারের ওপর এত অন্যায়-অবিচার করছে? মা-বাবা আমার দিকে তাকাতে পারছেন না, আমিও মা-বাবার দিকে তাকাতে পারছি না। কেন, কেন?’ প্রশ্নগুলো জমিলার বিবেককে কুরে কুরে খায়। অন্যদিকে এই মেয়েকে মানতে পারে না সমাজ, সব দোষ ওঁর ওপর চাপিয়ে দেয় সমাজের লোকজন।
১৯৭১ সালে কিশোরী বয়সে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা যখন জমিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, ধর্ষণ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। উপরন্তু মনে ছিল অনেক প্রশ্ন, কেন লোকে তাঁকে কলঙ্কিনী বলে, কেন তাঁকে দেখলে মানুষ থুতু ছিটায়, ছি ছি করে, অন্যদের সঙ্গে তাঁকে মেলামেশা করতে দেওয়া হয় না কেন? এসব ভাবতে ভাবতে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েন জমিলা।
জমিলা ভাবতে থাকেন, ‘সবাই কেন আমাকে কলঙ্কিত বলে? আমি তো স্বেচ্ছায় এ কাজ করিনি। জোরপূর্বক আমার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। এখানে আমার দোষটা কোথায়? জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন জানোয়ার আমাকে ধর্ষণ করল, সেই দোষ আবার আমার ওপরই পড়ল! বিনা অপরাধে আমার শাস্তি হলো স্বাধীন দেশে!’ মনের কথা মনেই গুমরে মরে, মুখ ফুটে তার কিছুই বলতে পারেন না জমিলা। এক প্রতিকূল বাস্তবতায় বসত করেও তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন অন্য আর দশজনের মতো তিনিও সুন্দর জীবনযাপন করবেন, তাঁরও থাকবে স্বামী-সংসার-সন্তান।
আমরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে কুমিল্লার গ্রামে গিয়েছি, তখন ওঁর কণ্ঠে ছিল কেবলই আক্ষেপ, ‘মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই একই পরিবারের মতো ছিলাম, একজনের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তাম অন্যজন। মনে হতো, এ বিপদ তো আমার নিজেরই। নয় মাস যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি যেন পরাধীন হয়ে গেলাম। কেবল আমিই হয়ে গেলাম অন্ধকারের কাছে বন্দী।’
অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, আবার বিয়ে ভেঙেও গেছে। একসময় তাই জমিলা মনে মনে ঠিক করলেন, বিয়ে আর করবেন না। এবার বাড়ির সবাই তাঁকে অনেক বোঝালেন। আর এই বোঝানোতে কাজও হলো। মত পরিবর্তিত হলো তাঁর। ফলে তাঁদের বাড়িতে আবারও শুরু হলো পাত্র খোঁজার তোড়জোড়। খোঁজাখুঁজির পর পাত্রের সন্ধান মিলল। তবে এবারও ১৯৭১-এ ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাই বাধা। আবারও আস্তে আস্তে পুরোনো কথা চলে আসে। জমিলা যতই ভুলতে চেষ্টা করেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবর্ণনীয় অমানবিক বর্বরতার কথা, সমাজ যেন ততই তাঁকে মনে করিয়ে দেয় সেই জঘন্য স্মৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের দু-তিন বছর পর বিয়ে হলো জমিলার। যাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলো, তাঁর নামের আদ্যাক্ষর ‘ম’ এবং পেশায় তিনি দারোয়ান। ওই ‘ম’ আদ্যাক্ষরের মানুষটির বাড়ি জমিলাদের এলাকা থেকে অনেক দূরে। আর বলাবাহুল্য যে, ‘অতীত’ গোপন করেই জমিলাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘অতীত’ গোপন থাকেনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তিনি যে নির্যাতিত হয়েছিলেন, এটা একসময় জেনে যান জমিলার স্বামী। তারপর যা ঘটার তাই ঘটল, স্ত্রীকে ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। এরপর আবার বিয়ে হলো জমিলার। সেই সংসারে এক ছেলে, এক মেয়ে থাকলেও জমিলাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করলেন তাঁর দ্বিতীয় স্বামী। ফলে সংসার করার স্বপ্ন তাঁর কাছে অধরাই রয়ে গেল।
১৯৭১-এ কুমিল্লার লালমাই ইউনিয়নে যে কিশোরী নির্যাতিত হয়েছিলেন, যাঁর নামের আদ্যাক্ষর ‘ফ’ এবং এই লেখায় যাঁকে আমরা ডেকেছি জমিলা নামে, প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর আর সংসার করা হয়নি। একাত্তরের ‘বীরাঙ্গনা’—এই পরিচয় নিয়ে সেই কবে থেকে তিনি দিনক্ষয় করছেন। জীবনসায়াহ্নে এসে এখনো তাঁর প্রশ্ন, ‘দেশ স্বাধীন হলো, আমার জীবন আঁধারে ঢাকা পড়ল কেন?’
সুরমা জাহিদ: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত