অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ১৯৭১। আজ ৪০ বছর পর এই তিনটি শব্দ দু-তিন জেনারেশনের কাছে অর্থহীন। কিন্তু আমরা যারা এখন পৌঢ় বা বৃদ্ধ, তখন ছিলাম যুবক বা মধ্য বয়সী, তাদের কাছে এই তিনটি শব্দের অর্থ ভয়, হত্যা, লুট, গ্রেপ্তার, ধর্ষণ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রথম অবরুদ্ধ হয় ঢাকা শহর। প্রথম এক সপ্তাহ, প্রতিদিন রাতে দেখা যেত লেলিহান আগুনের শিখা আর শোনা যেত গুলির শব্দ। সকালে দেখা যেত ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ। কারফিউ তো বলবত্ ছিলই, কিন্তু যখনই একটু শিথিল হতো, তখনই দেখা যেত রাজপথ ভরে উঠছে মানুষে। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। খোঁজ করছে আত্মীয়স্বজনের। আবার কারফিউ, আগুন, গুলি।
অন্যান্য শহর এক সপ্তাহ থেকে হয়তো তিন সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্ত ছিল। কিন্তু তারপর সেগুলোও চলে যায় হানাদারদের দখলে। সেই সব শহরেও হানাদার বাহিনী একই কার্যক্রম শুরু করে। তারপর তা আরও ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেগঞ্জে।
দখলের পরই হত্যা বন্ধ হয়ে যায়নি। পরে তা একটা প্যাটার্নে পরিণত হয়। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের আদেশ হিসেবে রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি গঠন করল, তখন সিস্টেমেটিক্যালি বা শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে হত্যাযজ্ঞ চলতে লাগল। প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সমর্থক, তারপর হিন্দু, তারপর যুবক, তারপর সবাই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কর্নেল নাদের আলী যখন ফরিদপুরে যায়, তখন আরেক কর্নেল তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘স্কোর কত?’ অর্থাত্ কত হত্যা করলে? নাদের আলী পরে মানসিক ভারসাম্য হারায়। এক সাংবাদিক লিখেছেন, তাকে এক পাকিস্তানি অফিসার বিদেশি এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, যখন স্কোর লাগে তখন কিছু [মানুষ] শিকার করে আসি। রাজাকার, আলবদর বা শান্তি কমিটির সদস্যরা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। হত্যায় অংশ নিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী-খালের ওপর তৈরি সাঁকো বা কালভার্ট তখন ব্যবহূত হয়েছে বধ্যভূমি হিসেবে। নিরালা জায়গা, জলাভূমিও ছিল বধ্যভূমি।
সঠিক তালিকা হয়নি, তবে আমরা পড়ে যা জেনেছি, তাতে বধ্যভূমির সংখ্যা হাজারের ওপরে। আমি প্রায় দুই দশক আগে স্বরূপকাঠির ভেতরে এক নির্জন গ্রামে গিয়েছিলাম, যা তখনো ছিল অগম্য। সেখানেও পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। এই সব মনে রাখলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখের ওপরে বাঙালি শহীদ হয়েছেন। এক চুকনগরেই তো এক দিনে হত্যা করা হয়েছিল ১০ হাজারের ওপর।
হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল লুট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেসব বাড়ি থেকে কাউকে ধরা হতো, বিশেষ করে শহরের বাইরে, সেখানে সে বাড়ি লুট হতো। পাকিস্তানি সৈন্যরা ছাড়া জামায়াত বা মুসলিম লীগের হার্মাদরা তাতে যোগ দিত। পাকিস্তানে এক নারী, যিনি বিশ্বব্যাংকের কনসালট্যান্ট ছিলেন, বলেছিলেন আমাকে, মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। দেশি হার্মাদরাও হিন্দু বা আওয়ামী-সমর্থকদের বাড়িঘর নিয়মিত লুট করত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মজা দেখার জন্য গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হতো বা মুক্তিযোদ্ধারা যেন সমর্থন না পায়, সে জন্য পোড়ামাটি নীতি হিসেবে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হতো।
খুন, লুট, জ্বালাও, পোড়াওয়ের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ছিল ধর্ষণ। কত ধর্ষিত হয়েছিল? স্বাধীনতার পরপর বিবিসি বা অন্যান্য সংবাদ সংস্থা বলত, ১০ লাখ। তারপর দেখা গেল সাত লাখ। এখন বলা হয় চার লাখ। এই সংখ্যা জেনেশুনেই স্বার্থান্বেষীরা ক্রমাগত হ্রাস করেছে।
এই হত্যা, এই ধর্ষণ, এই তুলে নিয়ে যাওয়া বা গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য মানুষ অনবরত ছুটে বেড়াল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা। সবার কাছে থাকত আইডেনটিটি কার্ড বা ‘ডান্ডি কার্ড’, সবই জাল। যেমন: আমারটি ছিল বিদ্যুত্ মিস্ত্রির। যাঁরা চলে যেতে পেরেছিলেন সীমানা পেরিয়ে, তাঁরা বেঁচেছিলেন অন্তত নিত্যদিনের ভয় থেকে। যাঁরা পারেননি, তাঁরা প্রায় নির্ঘুম কাটাতেন। কখন জানি দরজায় কড়া নেড়ে ওঠে। কিন্তু ওই ভয় নিয়ে, শঙ্কা নিয়ে প্রায় ছয় কোটি মানুষ বাংলাদেশ পাহারা দিয়ে রেখেছে।
পাহারা দিয়ে রাখার কথাটা উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, এই মানুষগুলো না থাকলে তো মুক্তিযুদ্ধে জেতা যেত না। গেরিলারা যাঁরা পাকিস্তানিদের পরাজয়ের কারণ, তাঁরা তো আশ্রয়, খাদ্য পেয়েছেন অবরুদ্ধ দেশে থাকা মানুষগুলোর কাছে। এই আশ্রয় দেওয়া, খাবার পৌঁছে দেওয়া, খবরাখবর আদান-প্রদান করা, ত্রাণসামগ্রী-ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, এগুলোও তো কম গুরুত্বপূর্ণ আর সাহসী কাজ ছিল না। আলতাফ মাহমুদ তো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাননি, কিন্তু কে বলবেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? অনেক পরিবার তো মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েই মৃত্যুবরণ করেছে, পরিবারের মেয়েরা ধর্ষিত হয়েছে। বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিদিন ভয়-শঙ্কা নিয়ে থাকা, প্রতিদিন খুন, লুট, ধর্ষণের খবর শোনা, প্রিয়জন হারানো, আশ্রয়চ্যুত হয়ে থাকা, যেখানে কোনো আশ্রয়ই নিরাপদ নয়, সেখানে ছয় কোটি মানুষ নয়টি মাস পেরোল কীভাবে?
অবরুদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার সম্বল ছিল, প্রতি রাতে গোপনে, অতিগোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা, বিবিসি ও আকাশবাণী এবং অন্যান্য রেডিওর খবর শোনা, কখনো কখনো ফুটপাতে বা কারও কাছ থেকে পাওয়া বিদেশি সংবাদ-সাময়িকপত্র। প্রতিদিনের খবর, গান, মানুষকে বেঁচে থাকতে উজ্জীবিত করত এই আশায় যে, স্বাধীনতা এল বলে। মাঝেমধ্যে রাতে শহরে গ্রেনেড বা বোমা নিক্ষেপ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খতম হওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে রাখত। এই প্রথম বাংলাদেশে সাম্য প্রতিনিধি হয়েছিল, সবাই সবার ভাই, বোন, সবাই সবাইর দুঃখ-বেদনা, আনন্দের সাথি। ওই রকম ঐক্য বাংলাদেশে আর কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হবেও না। জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। এত দুঃখ, এত বেদনা, এত অশ্রু, এত রক্তের পরও আশা ছিল, দেশ তো স্বাধীন হলো বলে। সোনার বাংলা তো প্রতিষ্ঠিত হবে। আমি না থাকি, আমার উত্তরাধিকার তো থাকবে স্বাধীন দেশে।
এভাবে পরস্পরের হাত ধরে আমরা বেঁচে ছিলাম ১৯৭১-এ। জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল দেখেই খুনি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয়দোসরেরা এত হত্যা, এত লুট, এত ধর্ষণের পর অবরুদ্ধ দেশবাসীকে নোয়াতে পারেনি এতটুকু। অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছেন এক ফ্রন্টে, অবরুদ্ধরা লড়েছেন আরেক ফ্রন্টে। এই দুই ফ্রন্টের লড়াইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আজ ৪০ বছর নিজের কাছেই সেই সব দিনে বেঁচে থাকা এক অবিশ্বাস্য কাহিনি বলে মনে হয়।
মুনতাসীর মামুন: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত