বিজ্ঞাপন
default-image

রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেই অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমদ বুঝতে পারেন, এটাই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। মনে মনে নিজেকেও প্রস্তুত করতে শুরু করেন সিলেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এই চিকিৎসক। সামনে অনুপ্রেরণা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক লে. কর্নেল ডা. আবুল ফজল জিয়াউর রহমান। আহত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য আগাম ব্লাড ব্যাংক ও ইমারজেন্সি স্কোয়াড গঠন করেন শামসুদ্দিন।

২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারা দেশের মতো সিলেটেও গণহত্যা শুরু করে। তবে ২৬ মার্চ থেকে সিলেটে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে বেশ কয়েকবার পিছু হটতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। কিন্তু হারের শোধ নিতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। আরও সৈন্য ও প্রচুর অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে শুরু করেন অধ্যক্ষ জিয়াউর, ডা. শামসুদ্দিনসহ তাঁদের সহকর্মীরা। শামসুদ্দিন তখন মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিরোধযুদ্ধে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেন। শহরের কোথাও গুলির শব্দ শুনলেই নড়েচড়ে বসতেন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী। ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে আনতেন।

গণহত্যা শুরুর পর সিলেট শহরের জনসাধারণের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভয়ে অনেকেই ভারতে কিংবা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকেন। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নারী সহকর্মীদের হাসপাতাল ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলা হয়। আর পুরুষ চিকিৎসক-শিক্ষক-নার্সদের বুঝিয়ে চিকিৎসাসেবার কাজে রাখতে সক্ষম হন শামসুদ্দিন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাসপাতালে থেকে যান ডা. শ্যামল কান্তি লাল, নার্স মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলীসহ কয়েকজন। তাঁদের নিয়েই হাসপাতালে দিনরাত জরুরি স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে যেতে থাকেন শামসুদ্দিন। চিকিৎসকের সংখ্যা সীমিত থাকায় শামসুদ্দিনের মতো ডা. শ্যামলেরও ব্যস্ততা বেড়ে যায়। রাত কাটাতে শুরু করেন হাসপাতালেই।

default-image

এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় হানাদার বাহিনী সিলেট শহর ছেড়ে সালুটিকর বিমানবন্দরে আশ্রয় নেয়। তবে সারা দেশের মতো সিলেটেও দ্রুতই পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যেতে থাকে। এ অবস্থায় শামসুদ্দিন তাঁর বৃদ্ধ মা, সদ্য বিবাহিত বড় মেয়ে ও মেয়ের স্বামী, বড় ছেলে ও দুই মেয়েকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। তবে শামসুদ্দিনকে সহায়তা করতে শহরেই থেকে যান তাঁর স্ত্রী বেগম হোসনে আরা আহমদ। হাসপাতালে তীব্র নার্স-সংকট দেখা দিয়েছিল। ফলে হোসনে আরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রোগীদের সেবার কাজও করেছেন।

শহরে তখন ১৪৪ ধারা জারি ছিল। ৯ এপ্রিল ভোর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর মুহুর্মুহু যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্থলযুদ্ধে হেরে তারা বিমানের সাহায্যে আক্রমণ শুরু করে। এতে শহরে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছাড়েন। তখন পাকিস্তানি সেনারা শহরে ঢুকে পড়ে। নির্বিচার সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করে। আহত হয়ে অনেকে হাসপাতালে যান। শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে তাঁদের চিকিৎসা শুরু

হয়। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর কিছু সেনাও আহত হয়। তাদের চিকিৎসা করাতে শামসুদ্দিনকে সেনাছাউনিতে যাওয়ার নির্দেশনা দেয় হানাদার বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করেন শামসুদ্দিন। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা অব্যাহত রাখেন। বেলা ১১টা ১০ মিনিটের দিকে হঠাৎ হানাদার বাহিনীর সদস্যরা হাসপাতালে ঢুকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেও মুক্তিযোদ্ধাদের পায়নি। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক শামসুদ্দিন, শ্যামলসহ সবাইকে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যায়। তাঁদের নেওয়া হয় পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের বিপরীত দিকে একটি উন্মুক্ত স্থানে সবুজ চত্বরে। দুই চিকিৎসকের পাশাপাশি দাঁড় করানো হয় নার্স মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী, পিয়ন মো. মহিবুর রহমান, ওয়ার্ডবয় মকলিসুর রহমানসহ সাতজনকে।

হানাদার বাহিনী প্রথমে ডা. শামসুদ্দিনের ঊরুতে গুলি চালায়। পরপর তিনটি গুলি ছুড়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ডা. শ্যামলকে হত্যা করে। পরে অন্যদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে তারা। তাঁদের রক্তে সেদিন ভেসে গিয়েছিল হাসপাতালের সবুজ চত্বর। গুলিতে সবাই শহীদ হলেও সৌভাগ্যক্রমে মকলিসুর বেঁচে যান। গুলি লাগে তাঁর ডান হাতের হাড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। অন্যদের মতো মকলিসুরকেও মৃত ভেবে হানাদার বাহিনী সেখানেই ফেলে রেখে চলে যায়। পরে মকলিসুর কৌশলে সেখান থেকে সরে পড়েন। কারফিউ থাকায় সে সময়ে শহরে কেউ বেরোয়নি। টানা চার দিন তাঁদের লাশ সেখানেই পড়ে ছিল। ১৩ এপ্রিল কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে শামসুদ্দিনের চাচা মৌলভি মঈনউদ্দিন হোসেনসহ কয়েকজন হাসপাতালে যান। তাঁরা হাসপাতালের ভেতরেই দ্রুততার সঙ্গে সবাইকে কবর দিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। শ্মশানে নেওয়ার পরিবর্তে ডা. শ্যামলকেও অন্যান্য শহীদের মতো কবর দেওয়া হয়েছিল। যেখানটায় তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই এখন সিলেটের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ।

এদিকে ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব হন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ জিয়াউর রহমান। এ অবস্থায় ১৪ এপ্রিল তাঁকে নিজ বাসা থেকে হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞাত স্থানে হত্যা করে। কোথায় কখন কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সেই তথ্য আজ পর্যন্ত অজানা।

সিলেটের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধটি সম্প্রতি নতুন নকশায় পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি পরিসর বড় করার উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এই কাজ শুরু হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। এ কাজের অংশ হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ-লাগোয়া সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিসরও বড় করা হচ্ছে।