বিজ্ঞাপন
default-image

লাইসেন্স করা কয়েকটি বন্দুক, কিছু টুটু বোর রাইফেল আর লাঠি, ফালা ও তির-ধনুক। এ নিয়েই পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ গড়েছিলেন মুক্তিকামী জনতা। একাত্তরের ২৮ মার্চ মধ্যশহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এলাকার এই যুদ্ধে জনতার রোষে পরাস্ত হয় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত হয় আরও ১৭টি খণ্ডযুদ্ধ। এই প্রতিরোধের পর ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত থাকে পাবনা জেলা।

সেই যুদ্ধের বীরত্বগাথা আজও পাবনাবাসীর হৃদয়জুড়ে আছে। সেদিনের সেই সম্মুখযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনো জীবিত। যুদ্ধের আদ্যোপান্ত জানতে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। কথায় কথায় উঠে আসে প্রতিরোধযুদ্ধের একটি চিত্র।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দেশব্যাপী ছড়াতে থাকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা। পাবনায় পৌঁছায় তিন প্লাটুন (১৩০ জন) সেনা। অবস্থান নেয় জেলা শহরের বিসিক শিল্পনগরীতে। এসেই তাঁরা নির্বিচার সাধারণ মানুষকে হত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে তারা নিজস্ব ভ্যান ও জিপ নিয়ে পুরো শহরে টহল দিতে থাকে। ঘোষণা করে কারফিউ। পাবনা বড়বাজারের তৎকালীন পাহারাদার উজির খান পাকিস্তানি সেনাদের শহরের পথঘাট চেনাতে থাকে। আর সেনারা বিভিন্ন মোড়ে জিপ থামিয়ে গুলি চালাতে থাকে। এতে বহু নিরীহ মানুষ হতাহত হন।

২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা শহরে বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনজীবী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ বেশ কিছু মানুষকে আটক করে। ২৭ মার্চ রাতে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে তারা যাকে সামনে পায়, তাকেই গুলি করতে থাকে।

এর আগে ২৫ মার্চ সকালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান রফিকুল ইসলাম বকুল স্থানীয় যুবসমাজকে নিয়ে শহরের গোপালপুর মহল্লায় জরুরি সভা করেন। সেখানে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অস্ত্র বলতে কিছুই ছিল না তাঁদের। কয়েকটি বোমা, পাইপগান, ছুরি, ফালা, সড়কি ও তির-ধনুক নিয়েই শুরু হয় আক্রমণের প্রস্তুতি। সার্বিক অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত হয় অস্ত্র সংগ্রহের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আনা হয় কয়েকটি লাইসেন্স করা বন্দুক ও টুটু বোর রাইফেল।

সেদিনের সম্মুখযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা মধ্যশহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও টেলিগ্রাম অফিসে পাহারা বসায়। একই সঙ্গে তারা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রশাসন ও পুলিশ। এতে ক্ষিপ্ত হয় সেনারা। তারা জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খানের বাংলো ঘেরাও করে। তিনি পালিয়ে শহরতলির একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান রফিকুল ইসলাম বকুলসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে জেলার তৎকালীন এমপিএ (গণপরিষদ সদস্য) আবদুর রব বগা মিয়া উপস্থিত ছিলেন। সবাই মিলে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে সবাই হাতে হাত ধরে শপথ নেন।

সেদিনের আরেক সম্মুখযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম বলেন, আত্মসমর্পণের নির্দেশ না মানায় জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান জীবনের ঝুঁকিতে ছিলেন। তিনি জীবনের মায়া করেননি। তৎকালীন যুবসমাজকে যুদ্ধে উৎসাহ জুগিয়েছেন। পুলিশ বাহিনীর আন্তরিকতায় পুলিশ লাইনসের অস্ত্রভান্ডার খুলে দিতে সহযোগিতা করেন। সেদিন জেলখানা থেকে মুক্ত হন কয়েদিরা। অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। খবর পেয়ে ২৮ মার্চ ভোরে পুলিশ লাইনসে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ।

সেদিনের আরেক সম্মুখযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম বলেন, সেদিনের প্রতিরোধযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ চাকু, ছুরি, দা, বঁটি, যার যা আছে, তা নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সেনারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থান নিয়েছিল। সেখান থেকেই গুলি ছুড়ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা রক্ষা পায়নি। তাদের চারপাশ থেকে আক্রমণ চালিয়ে পরাস্ত করা হয়েছিল।

অন্যদিকে বিসিক শিল্পনগরীতে পাকিস্তানি আর্মিদের ঘেরাও করে রেখেছিলেন সাধারণ জনতা। সেখানে জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করা হচ্ছিল। একপর্যায়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার খবরে থেমেছিল পাকিস্তানি সেনারা। খুঁজছিল পালানোর পথ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বলেন, আটকে পড়া সেনাদের উদ্ধার করতে রাজশাহী থেকে আরও সেনা আসে বিসিক এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলা চালায়। এতে এলাকা ছাড়ে সাধারণ জনতা। পাঁচ থেকে ছয়জন শহীদও হন। সুযোগ বুঝে গ্রামের রাস্তা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু তাতেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। জেলার দাশুড়িয়া, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন স্থানে সাধারণ জনগণের বাধার মুখে পড়ে তারা। গুলি চালাতে থাকে সাধারণ মানুষের ওপর। বাড়িঘর পোড়াতে শুরু করে। কিন্তু মুক্তিকামী জনতার রোষে শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয় পাকিস্তানি সেনারা। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়া পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিকামী সাধারণ জনতার ১৭টি খণ্ডযুদ্ধ হয়। নিহত হয় ১৫০ জন পাকিস্তানি সেনা। ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত থাকে পাবনা জেলা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম বলেন, ১১ এপ্রিল থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত আবারও জেলাব্যাপী গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের প্রতিরোধ করতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এপ্রিল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, বহু শহীদের রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৮ ডিসেম্বর পাবনা শত্রুমুক্ত হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম বলেন, ‘টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এলাকা যখন জঙ্গলময় থাকে, মাদকসেবীরা আখড়া বসায়, তখন ব্যথা অনুভব করি। জীবন বাজি রেখে যে স্থানটিতে প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছিল, নতুন প্রজন্মের জন্য সেই স্থান সংরক্ষণ ও ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদা প্রদানের তাগিদ অনুভব করি।’