মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের সব স্মৃতিবিজড়িত স্থানের তথ্য আর ছবি এক মলাটে প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছিলেন আমিরুল হক। সেই কাজের প্রেরণা থেকে তিনি নেমেছিলেন নতুন কাজে। খুঁজে ফিরেছেন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাষাসংগ্রাম ও স্বাধীনতাসংগ্রামের স্মৃতিস্তম্ভ। চলতি মার্চে শেষ হয়েছে তাঁর তথ্য ও ছবি সংগ্রহের কাজ। সেসব দিয়ে এখন নতুন প্রকাশনায় হাত দিয়েছেন। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতেই কাজটি শেষ হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের সন্তান আমিরুল হক। তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯৯ সালে ছাত্র থাকাকালে চিন্তাটা মাথায় ঢোকে। মনে হতে থাকে, মুক্তিযুদ্ধে কত না স্মৃতি আর আত্মত্যাগের গল্প একেকটি শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভে? সিলেট অঞ্চলের এ রকম সব স্মৃতিবিজড়িত স্থানের তথ্য আর ছবি এক মলাটে রাখার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে কিছু দিনের মাথায় পাড়ি দেন যুক্তরাজ্যে। এরপরও প্রকাশনার কাজটি আমিরুলের মন থেকে নামেনি। ওই কাজের জন্য ২০০০ সাল থেকেই তৎপর হন আমিরুল। একটানা ১০ বছর কাজ করেছেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত যখনই যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন, তখনই ছুটে বেড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও শহীদ মিনারের ছবি ও তথ্য সংগ্রহে। সিলেট বিভাগের ৪ জেলার ১০১টি স্থান চিহ্নিত করে ছবি ও তথ্য নিয়ে একটি প্রদর্শনী করেন। এরপর সেসব ছবি ও তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ/সিলেট বিভাগ নামের বইয়ে।
বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা চৈতন্য। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জাহিদুল হক চৌধুরী বলেন, শহীদ মিনার বা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান নিয়ে সিলেট বিভাগে এমন কাজ এটাই প্রথম। আমিরুল হকের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ বইটি ২০১৯ সালে একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণের বইটির সিলেটে ও লন্ডনে প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের গবেষকেরা একবাক্যেই বলেছেন, আমিরুল হকের বইটি মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ স্মৃতি নিয়ে অন্তঃপ্রাণ একটি কাজ।
সিলেট বিভাগের চার জেলার জন্য চারটি ভাগে শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের ছবি ও তথ্য যুক্ত করা হয়েছে বইয়ে। সেই সঙ্গে রয়েছে জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও। মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় ইতিহাস গ্রন্থের বরাতে এসেছে নানা কাহিনি। কোনো কোনো স্মৃতিবাহী স্থান আগে কেমন ছিল, আর এখন কেমন—তার সচিত্র পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে বইয়ে। বীরত্বের অনেক কাহিনি আর সেই সব স্মরণে স্মৃতিকথাও রয়েছে। আছে উপমহাদেশের প্রাচীন চা-বাগান মালনীছড়ার ম্যানেজার শহীদ শওকত নাওয়াজের বীরত্বপূর্ণ চিঠির প্রসঙ্গ। শওকতের চিঠির ভাষা ‘ভীরু কাপুরুষের মতো মরব না’ যেন হাজারো শহীদের মুখের ও মনের ভাষার প্রতিধ্বনি। হবিগঞ্জের চান্দপুর চা-বাগানে নিবারণ স্মৃতিসৌধের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। আছে লালচান চা-বাগানে ১১ শহীদ স্মৃতিচিহ্নের স্থানটির ছবিও। মৌলভীবাজারের শমশেরনগর বধ্যভূমি ও সুনামগঞ্জের নারায়ণতলার স্মৃতি সংরক্ষণচিত্র স্থান পেয়েছে বইটিতে।
কোন শহীদ মিনার কোথায়, কখন নির্মাণ হয়েছে, তারও বর্ণনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠিক কী কারণে স্থানগুলো স্মৃতিবিজড়িত, তারও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে স্থানীয় ইতিহাস সূত্রে। কোনো তথ্য ঘাটতি থাকলে তা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন আমিরুল হক।
এবার বাংলাদেশের ভাষাসংগ্রাম ও স্বাধীনতাসংগ্রামের বিষয়ে বহির্বিশ্বে কী তথ্য-তালাশ করছেন আমিরুল হক? সম্প্রতি মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে যুক্তরাজ্য থেকে তিনি জানালেন, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী সামনে রেখে শুরু করা কাজটা গুছিয়ে এনেছেন। চলতি মার্চেই তাঁর প্রকাশনার কাজ চূড়ান্ত হবে।
কীভাবে কাজগুলো করছেন, তা জানতে চাইলে আমিরুল বলেন, ‘এখন তো সবাই গুগল সার্চ দিয়ে অনেক তথ্য নিয়ে নেয়। আমি সেই পথের ওপর নির্ভর করিনি। বহির্বিশ্বে এসব তথ্য এভাবে মেলেও না। এ কারণে আমার কাজে সময় বেশি লেগেছে।’
আমিরুল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই কাজ শুরু করেছিলেন। গত দেড় বছরে তিনি যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করেছেন। প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই তিনি সশরীর গেছেন। সীমাবদ্ধতার কারণে দু-একটি জায়গায় যেতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে নির্ভর করেছেন নিজের বিশ্বস্ত মানুষজনের ওপরে। এভাবে দেশে দেশে ২১টি শহীদ মিনার তৈরির গল্প পেয়েছেন আমিরুল। সবই শহীদ মিনার। তার ভেতরেই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি খুঁজে ফিরেছেন। কারণ, শহীদ মিনারগুলো নির্মিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস সব উদ্যাপনের জন্য।
আমিরুল যে ২১টি শহীদ মিনারের গল্প তুলে এনেছেন, তার মধ্যে প্রথমটি নির্মিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ওল্ডহাম শহরে। এটি ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর স্থাপিত। আর সর্বশেষ শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছে ফ্রান্সের তুলুজ শহরে, গেল ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দুটিসহ মোট ২১টি শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির তথ্য ও ছবি তিনি সংগ্রহ করেছেন। সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা তিনি প্রকাশনায় রেখেছেন। কিন্তু তাঁর সংগ্রহ করা তথ্য চুরির শঙ্কা রয়েছে, এ জন্য এখনই সবকিছু প্রকাশ করছেন না তিনি।
আমিরুল জানান, এই ২১টি শহীদ মিনারের মধ্যে ১৮টি নির্মিত হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে। ৩টি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ। পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধগুলোর নির্মাণশৈলী ভিন্ন। কোনোটির মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা খচিত আছে। ওই তিনটি স্মৃতিসৌধের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে দুটি, কানাডায় একটি।
বহির্বিশ্বে তথ্য-তালাশের কাজটি আমিরুল হকের জীবনে এক অনন্য স্মৃতি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে প্রবলভাবে ভালোবাসার নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশের নেই। বিষয়টি আমি বিদেশে তথ্য খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি।’
কাজটি শেষ করার পর আরেকটি ইচ্ছের কথাও জানালেন আমিরুল, ‘দুটো প্রকাশনা থেকে যে টাকা আসবে, তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও ভাষাশহীদ স্মরণে দুটো শহীদ মিনার নির্মাণ করব। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমার এই কাজ হবে নতুন প্রজন্মের জন্য।’