বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতে গিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। তবে সম্মুখযুদ্ধে অস্ত্র নয়, তাঁর পছন্দ ছিল গ্রেনেড। এই গ্রেনেড ছুড়তে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান মাদারীপুরের সর্বকনিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার। যুদ্ধে অত্যন্ত দক্ষ আর অসম সাহসিকতার কারণে মাত্র ১৪ বছর বয়সী হলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের মণি।

শহীদ সরোয়ারের বাবা আবদুর রব শরীফ ঢাকা আর্ট কলেজে চাকরি করতেন। সে সুবাধে তাঁর শৈশব কাটে ঢাকায়। ক্রিকেট ও ফুটবল—দুটিই খুব ভালো খেলতেন। পড়তেন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুর রব শরীফ পরিবার নিয়ে মাদারীপুর শহরে চলে আসেন। ওঠেন কলেজ রোড এলাকার ‘শরীফ’ বাড়িতে । তাঁর পৈতৃক এই বাড়ির অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের দেখে আগ্রহী হন সরোয়ারও। কিশোর বয়সেই যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে, মাদারীপুর এলাকার আলোচিত খলিল বাহিনীতে। প্রথম দিকে সরোয়ার স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে নানা স্লোগান তৈরি করে পোস্টার সাঁটানো শুরু করেন। পরে তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় ভারতে। দুই মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন। একাধিক যুদ্ধে গ্রেনেড ছুড়ে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। ধীরে ধীরে সরোয়ার সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘গ্রেনেড ম্যান’ হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক নাসির উদ্দিন জমাদারের মাদারীপুর: মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিকথা বই থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর মাদারীপুরের শিবচর প্রথম হানাদারমুক্ত হয়। পরে ৪ ডিসেম্বর রাজৈর এবং ৮ ডিসেম্বর কালকিনি হানাদারমুক্ত হয়। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর মাদারীপুর সদরের সমাদ্দার ব্রিজের কাছে একটানা ৩৬ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ চলে। এতে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর। এই শেষ দিনের যুদ্ধেই শহীদ হন সরোয়ার।

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ভোররাতে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মাদারীপুর থেকে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যাবে, এই সংবাদ পান মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর বিভিন্ন অঞ্চলের ৩ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সদর উপজেলার ঘটকচর থেকে সমাদ্দার ব্রিজের পশ্চিম পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে অবস্থান নেন। ৯ ডিসেম্বর ভোর পাঁচটার দিকে হানাদার বাহিনী গোলবারুদ ও অস্ত্রে সজ্জিত গাড়িবহর নিয়ে মাদারীপুর থেকে রওনা দেয়। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘটকচর ব্রিজ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করেন। তাড়া খেয়ে হানাদার বাহিনী দ্রুত গাড়ি চালাতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা একটি গাড়ি ফেলে গুলি করতে দ্রুত বেগে এগোতে থাকে। হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া গাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। তাঁদের আক্রমণে ভীত হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে হানাদার ও তাদের দোসররা। তাদের একটি অংশ সমাদ্দার ব্রিজের দুই পাশে আগে তৈরি করে রাখা বাংকারে আশ্রয় নিয়ে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। ফলে সেখানে হানাদারদের সঙ্গে খলিল বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ৯ ডিসেম্বর সারা দিন সারা রাত এবং ১০ ডিসেম্বর সারা দিন সম্মুখযুদ্ধ চলে। শেষ দিনের যুদ্ধের একপর্যায় পাকিস্তানি সেনাদের বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে যান সরোয়ার। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। একটি গুলি লাগে সরোয়ারের মাথার পেছনের দিকে। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই আরও বেগবান হয়। একপর্যায় হানাদার বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। ১০ ডিসেম্বর বিকেলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ওই দলে ছিল হানাদার বাহিনীর মেজর আবদুল হামিদ খটক, ক্যাপ্টেন সাঈদসহ ৩৭ পাকিস্তানি সেনা ও ১৪ জন রাজাকার।

শহীদ সরোয়ার হোসেনের মা-বাবা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মারা যান। এখনো জীবিত আছেন তাঁর ভাইবোনেরা। সবাই থাকেন মাদারীপুর শহরের সেই শরীফ বাড়িতে। এই বাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অন্যদের মধ্যে রয়েছেন হারুণ-উর-রশীদ। তিনি শহীদ সরোয়ারের চাচা। খলিল বাহিনীর বাহাদুরপুর ক্যাম্প পরিচালনা করতেন তিনি।

হারুণ-উর-রশীদ বলেন, ‘সরোয়ার বয়সে সবার ছোট হলেও ওর মতো সাহসী যোদ্ধা কেউ ছিল না। যখন যেখানে বলতাম, সেখানেই সরোয়ার চলে যেত। অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিলেও গ্রেনেড হামলায় তার ছিল বেশি আগ্রহ। সরোয়ার তার সঙ্গে গ্রেনেড রাখত। গ্রেনেড দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর কয়েকটি সফল হামলা চালায় সে। মাদারীপুর হানাদারমুক্ত হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সরোয়ারকে হারিয়েছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ও সাহসিকতা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো বিষয়।’

জেলার সর্বকনিষ্ঠ যোদ্ধা সরোয়ারকে সমাহিত করা হয় সরকারি মাদারীপুর কলেজের প্রধান ফটকের পাশে। সমাধিস্থলে বসানো নামফলকে শহীদ সরোয়ারের নাম–ঠিকানা রয়েছে। সাহসী এই যোদ্ধার স্মৃতি ধরে রাখতে জেলা শহরে তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। পৌর এলাকার চানমারী থেকে পুরানবাজার পর্যন্ত এই সড়কের দৈর্ঘ প্রায় দেড় কিলোমিটার। এ ছাড়া জেলা শহরে শহীদ সরোয়ারসহ তিন মুক্তিযোদ্ধার নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের কথা থাকলেও পরে আর হয়নি।

ফরিদপুর: ইতিহাস ঐতিহ্য-১৩ বইয়ের এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরে এসেছিলেন। তখন তিনি জেলা শহরের কলেজ গেটের সামনে সরোয়ারসহ তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি সরকার।